কলকাতা, 20 জুন : কোরোনার সংক্রমণের কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতি ও চলতে থাকা লকডাউনের জেরে আপাতত বন্ধ রয়েছে রাজনৈতিক সমাবেশ । এদিকে আগামী বছরেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন । এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমাবেশের জন্য ডিজিটাল মিডিয়ার উপরেই ভরসা রাখছে BJP । বিহার, ওড়িশার পর পশ্চিমবঙ্গ । একাধিক রাজ্যে ইতিমধ্যেই ভার্চুয়াল প্রচার সভা শুরু করে দিয়েছে BJP । পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে জনসংবাদ ব়্যালি । সেইমতো 8 জুন পশ্চিমবঙ্গে ভার্চুয়াল সভা করেন BJP-র চাণক্য অমিত শাহ । দিল্লিতে বসে বার্তা দিচ্ছেন তিনি । আর সেই বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে বাংলার প্রতিটি BJP কর্মীর ঘরে ঘরে । জনসংবাদ ব়্যালির মাধ্যমে জনসংযোগে BJP যে দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই । 2021-কে পাখির চোখ করে যদি BJP ভার্চুয়াল প্রচার সভার দিকে জোর দিতে শুরু করেছে বলেই মনে করছেন তাঁরা । এই পরিস্থিতিতে ডিজিটাল সভায় BJP-কে টেক্কা দিতে রাজ্যের শাসকদল কতটা প্রস্তুত?
ভার্চুয়াল সভা না করলেও এপ্রিল থেকে জ়ুম অ্যাপে লাগাতার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হচ্ছে রাজ্যের শাসকদল । এছাড়া ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে একাধিকবার দলীয় স্তরে বৈঠক করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । কিন্তু BJP-র জনসংবাদ ব়্যালির ব্যাপ্তির সামনে ডিজিটাল-তৃণমূলকে এখনও পর্যন্ত বেশ পিছিয়ে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল । সামনেই আসছে 21 জুলাই । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলার মনসদে আসার পর থেকে প্রতিবছরেই 21 জুলাইের শহিদ দিবস ঘটা করে উদযাপন করা হয় । তাহলে কি এবার 21 জুলাইকেই পাখির চোখ করে ভার্চুয়াল জনসভায় BJP কে টেক্কা দিতে চলছে রাজ্যের শাসক শিবির ?
একনজরে দেখে নেওয়া যাক BJP-র জনসংবাদ ব়্যালির গতিবিধি
- 7 জুন : বিহারে জনসংবাদ ব়্যালি । প্রধান বক্তা ছিলেন অমিত শাহ ।
- 8 জুন : মহারাষ্ট্রে জনসংবাদ ব়্যালি । প্রধান বক্তা ছিলেন রাজনাথ সিং ।
- 8 জুন : ওড়িশায় জনসংবাদ ব়্যালি । প্রধান বক্তা ছিলেন অমিত শাহ ।
- 9 জুন : বাংলায় জনসংবাদ ব়্যালি । এবারও প্রধান বক্তা সেই অমিত শাহ ।
- 10 জুন : মধ্যপ্রদেশে জনসংবাদ ব়্যালি । ভার্চুয়াল জনসভায় প্রধান বক্তা ছিল নীতিন গডকড়ি ।
- 14 জুন : গুজরাতের জনসংবাদ ব়্যালিতেও প্রধান বক্তা ছিলেন নীতিন গডকড়ি ।
- 14 জুন : জম্মু ও কাশ্মীরে জনসংবাদ ব়্যালির নেতৃত্ব দেন রাজনাথ সিং ।
- 14 জুন : কর্নাটকে জনসংবাদ ব়্যালি । প্রধান মুখ ছিলেন জে পি নাড্ডা ।
- 15 জুন : উত্তরাখণ্ডে জনসংবাদ ব়্যালি । নেতৃত্বে ছিলেন রাজনাথ সিং ।
- 16 জুন : কেরালায় জনসংবাদ ব়্যালিতে প্রধান বক্তা ছিলেন জে পি নাড্ডা ।
- 20 জুন : গোয়া, তেলাঙ্গানা ও রাজস্থানে জনসংবাদ ব়্যালি । নেতৃত্বে নিতিন গডকড়ি ও জে পি নাড্ডা ।
সামনের বছরেই বিধানসভা নির্বাচন । কিন্তু কোরোনার কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে যাবতীয় সমাবেশ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি । তবে দলের সাংগঠনিক বৈঠক বা সভার কাজ থমকে থাকছে না । রাজনৈতিক নেতারা এখন একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ভরসা রাখছেন ডিজিটাল মাধ্যমেই । শুধু তাই নয়, ডিজিটাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে দলীয় নেতৃত্বের তরফে লাগাতার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে নিচুতলার কর্মীদের । নিজেদের দলীয় প্রচারের কাজে ডিজিটাল মিডিয়াকে কোন দল কতটা ব্যবহার করতে পারছে তা নিয়েও চলছে জোর লড়াই । কয়েকদিন আগেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা BJP-র সর্বভারতীয় নেতা অমিত শাহ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পৃথক পৃথক ভাবে ভার্চুয়াল সভা করেছেন । BJP-র তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে 9 জুনের জনসংবাদ ব়্যালি লাইভ দেখেছেন দু'কোটি মানুষ । যদিও এই দাবি উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল শিবির ।
এবার দেখে নেওয়া যাক ভার্চুয়াল প্রচার সভায় BJP-কে টক্কর দিতে রাজ্যের শাসকদল কতটা তৈরি ?
- ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে 3 মে থেকে 6 মে পর্যন্ত লাগাতার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন তৃণমূল নেতা ডেরেক ও-ব্রায়েন, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সমীর চক্রবর্তী সহ অন্যরা ।
- এছাড়া ভিডিয়ো কনফারেন্সের মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোর পৃথক পৃথকভাবে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন ।
- লকডাউনের মধ্যে কালীঘাট থেকে 8 মে এবং 5 জুন দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে অনলাইন বৈঠক করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা দিচ্ছেন এই বৈঠক থেকে ।
- পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে নবান্ন থেকে নিয়মিত প্রশাসনিক বৈঠক করে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী ।
তবে রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছে, জনসংবাদ ব়্যালির মতো এত বড়মাপের কোনও ডিজিটাল গতিবিধি এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি তৃণমূল শিবিরে । সামনেই আসছে একুশে জুলাইয়ের সমাবেশ । তৃণমূল রাজ্যের মসনদে আসার পর থেকে প্রতিবছর ধর্মতলা চত্বরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হয় শহিদ দিবস । এবারও কি তবে সামাজিক দূরত্বকে মান্যতা দিয়ে ধর্মতলাতেই পালিত হবে তৃণমূলের 21 জুলাইয়ের কর্মসূচি ? বাস্তবিকভাবে দেখতে গেলে, এত বিশাল জনসমাবেশ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পালন করা কার্যত অসম্ভব । তবে কি BJP-র ভার্চুয়াল সভাকে পাল্লা দিয়ে এবার 21 জুলাইও ডিজিটাল জনসভা করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? শুরু হয়েছে জোর জল্পনা । যদিও এ-বিষয়ে এখনও পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটেই রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূল কংগ্রেসের অন্য শীর্ষ নেতারা । তবে তৃণমূলের ক্যালেন্ডারের সবথেকে বড় সমাবেশ এবার ভার্চুয়ালই হতে পারে বলে মনে করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল ।
তবে 9 জুন অমিত শাহের জনসংবাদ ব়্যালিতে কিন্তু BJP-কে বেশ চাপে ফেলে দিয়েছিল তৃণমূল শিবির । অমিত শাহের বক্তৃতা শুরু হতেই টুইটারে ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ ছিল #BanglarJanSamabesh । তৃণমূল শিবির থেকে পালটা হ্যাশট্যাগ চালু করা হয় #BengalRejectsAmitShah । একদিন পরে দুই শিবিরের হ্যাশট্যাগের তুলনা করে দেখা যায়, #BengalRejectsAmitShah তখনও কলকাতার ট্রেন্ডিংয়ে শীর্ষে ছিল । অন্যদিকে #BanglarJanSamabesh হ্যাশট্যাগ প্রথমে এক থাকলেও, পরে দুই ও শেষে ট্রেন্ডিং তালিকার থেকে হারিয়ে যায় ।
পাশাপাশি, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতির তত্ত্বাবধানে যুবশক্তি নামের একটি ফেসবুক গ্রুপও রয়েছে । সেখানেও দলীয় কর্মীদের সঙ্গে জনসংযোগ ব্যবস্থা আরও জোরদার করার চেষ্টা করা হচ্ছে ।
বিশেষ করে 2021 সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে একুশ জুলাইয়ের সভার গুরুত্ব রাজ্যের শাসকদলের কাছে অপরিসীম । সেক্ষেত্রে যদি ভার্চুয়াল সভা করা হয়, তবে তা কোন আঙ্গিকে রাজ্যের সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হবে তা নিয়েও শুরু হয়েছে চর্চা । রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে এ-বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "কোরোনার সংক্রমণের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমরা ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার করে সাংবাদিক বৈঠক করেছি, দলীয় বৈঠক করেছি । প্রযুক্তির পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু তত্ত্ব বা মতাদর্শের কখনও পরিবর্তন হয় না । ডিজিটালেও যেমন করব, মানুষের কাছে গ্রাসরুটে গিয়েও তেমন তুলে ধরব । তৃণমূল কংগ্রেস চেষ্টা করছে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, রাজনীতিটা আমাদের কাছে পরে । যারা রাজনীতির কথা বলছেন, তাঁদের বলি রাজনীতিটা আমাদের কাছে আগে নয় । মানুষের জন্য রাজনীতি । রাজনীতির জন্য মানুষ নয় । সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি ।"
রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস নেতা তাপস রায়ের বক্তব্য, "প্রচুর পয়সা খরচ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল সভা করেছে BJP । এখন সারা বিশ্বব্যাপী একটি বিপর্যয় চলছে । সেখানে বাঁচা-মরার প্রশ্ন আসছে । মানুষ নিজে বাঁচতে এবং প্রিয়জনদের বাঁচাতে আগ্রহী । রাজনৈতিক মুনাফার জন্য যে ভার্চুয়াল মিটিং করা হচ্ছে, এই মুহূর্তে তার যৌক্তিকতা নেই । রাজনীতি তো রয়েছে । আগে মানুষ বাঁচুক । সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ।" এদিকে ভার্চুয়াল সভা করতে খরচের টাকা কীভাবে আসছে সে-বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "BJP-র অর্থ রয়েছে । ওরা খরচ করছে । সবথেকে ধনী দল । পাশাপাশি সরকারেও রয়েছে ।" অন্যদিকে তৃণমূলের তরফে যে দলীয় বৈঠকগুলি অনলাইনে করা হচ্ছে সে-বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, "তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় কর্মীদের আশু দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়ার জন্য বৈঠক করছে । এর বেশি কিছু নয় ।"
এ-বিষয়ে আরও তথ্য জোগাড় করতে যোগাযোগ করা হয়েছিল রাজ্য BJP-র সহ-সভাপতি রীতেশ তিওয়ারির সঙ্গে । তিনি বলেন, "আগামী দিনে ভারতের রাজনীতি এই পথেই চলবে । BJP শুরু করেছে । ভার্চুয়াল প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে । BJP পথ দেখাবে দেশকে । এটা প্রমাণিত হল । নরেন্দ্র মোদির ডিজিটাল ইন্ডিয়াকে রাজনৈতিক কারণে যারা বিরোধিতা করেছিলেন, ব্যঙ্গ করতেন, সেই ডিজিটাল ইন্ডিয়ার পথেই যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস । BJP-কে অনুসরণ করতে হচ্ছে ।" ভারচুয়াল সভার খরচ কীভাবে আসছে সে প্রসঙ্গ প্রশ্ন করা হয়েছিল রীতেশ তিওয়ারিকেও । প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সাফাই, "দিল্লি থেকে ভাষণ হচ্ছে । ফেসবুক লাইভ ও প্রযুক্তির মাধ্যমে বাড়িতে বসে দেখছি । কোথায় পয়সা খরচ হচ্ছে । এই অর্থনীতি তৃণমূল কংগ্রেস বলতে পারে, বোঝাতে পারে ।"
প্রকাশ্যে কোনও নেতা মুখ না খুললেও, বাংলার রাজনীতির অন্দরমহলে ভার্চুয়াল প্রচার নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই যে চলছে, তা মেনে নিয়েছেন বঙ্গ রাজনীতির পর্যবক্ষকদের একটা বড় অংশ । সেক্ষেত্রে, 21 জুলাইয়ের জনসভায় ডিজিটাল মিডিয়ার ব্যবহার হলে বিষয়টি কিন্তু খুব একটা অবাক হওয়ার নয় ।