ভাষাকে সৎ কাজে ব্যবহার করা যায়, অসৎ কাজেও ৷ সামনে নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে ৷ তার আগে বাংলার রাজনীতিতে যে ভাষা ব্যবহার হচ্ছে তাকে ভাষা দূষণই বলব ৷
অথচ বাংলা ভাষা পৃথিবীর সুমিষ্টতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে ইউনেস্কো থেকে ৷ এই ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে ৷ এক সময় অসমের কাছাড়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ৷ অনেক ছেলেমেয়ে প্রাণ দিয়েছিল ৷ সকলের জানা বাংলাদেশের কথাও ৷ তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হল ৷ নাকচ করা হল বাংলাকে ৷ শাসক বলল, বাংলা চলবে না ৷ উর্দুই হবে একমাত্র ভাষা ৷ এই ঘটনায় গর্জে উঠেছিল বাঙালি ৷ অনেক আন্দোলনে, ত্যাগ স্বীকারে বাংলাদেশের সৃষ্টি হল ৷ বাংলাদেশের জন্মের ফলে বাঙালি একটা মস্ত বড় অস্মিতা ফিরে পেল ৷ কেন? কারণ বাংলাদেশ এমন এক দেশ, যা ভাষা ভিত্তিক ৷ এর ফলে এক লহমায় বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেল গোটা বিশ্বে ৷ একুশে ফেব্রুয়ারি হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ৷ ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়, পৃথিবীর সমস্ত দেশের সমস্ত ভাষাভাষী মানুষ এই দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করে ৷ এমনিতে গোটা দুনিয়ায় বাংলা ভাষার একটা বড়সড় প্রভাব রয়েছে ৷ আমরা অনেকেই জানি না, আফ্রিকায় একটা দেশ রয়েছে ৷ যার নাম সিয়েরা লিওন ৷ এই সিয়েরা লিওন-এর সরকারি ভাষার মধ্যে একটি হল বাংলা ৷ আসলে সেখানে একবার বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার কাজে বাংলাদেশের সৈন্যরা গিয়েছিল ৷ তারা খুব ভাল কাজ করেছিল ৷ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে, তাদের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে সিয়েরা লিওন সরকার বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেয় ৷
কিন্তু দুঃখের হল, এই যে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ ৷ তা হয়ত আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে ৷ রাজনীতিবিদ পালন করছেন ৷ অনেকে ব্যক্তিগত ভাবেও পালন করছেন ৷ যদিও প্রকৃত সত্যটা কঠিন ৷ যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে কাজের ভাষা বাংলা না ৷ যেমন কাজের ভাষা ইংরেজি, স্প্যানিস, জাপানি কিংবা চিনা ৷ চিনা ভাষায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলেন পৃথিবীতে ৷ এরপর ইংরেজি ৷ এখন আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষাটাকেই ভালোভাবে শেখার চেষ্টা করে ৷ যেহেতু কাজের ভাষা ইংরেজি ৷ অনেক সুবিধে পাওয়া যায় ৷ কাজের ক্ষেত্রে সুবিধে, বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধে ৷ গরগর করে ইংরেজি বলতে পারে, এমন ছেলেমেয়ের কদর আমাদের সমাজে বেশি ৷ এগুলো ঠিকই আছে ৷ কিন্তু সমস্যাটা হল, ইংরেজির প্রতি ঝোঁকটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে দুটো বাঙালি ছেলে ইংরেজিতে কথা বলে ! যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও ইংরেজি বলছে ৷ বিদেশে গিয়েও দেখেছি, দুই বাঙালি ইংরেজিতে কথা বলছেন ! এর থেকে মানসিক দৈন্য আর কিছু আর হতে পারে না ৷ কোনও ফরাসি, ইংরেজ বা জার্মান কখনও এ-কাজ করবে না ৷ ইংরেজি জানলেও একজন জার্মান আর একজন জার্মানের সঙ্গে জার্মান ভাষাতেই কথা বলবে ৷ একজন ফরাসি ফরাসিতেই কথা বলবে, কখনও ইংরেজিতে বলবে না ৷ এটা মানসিক দৈন্য এবং 'প্রভু'কে মেনে চলার মতো ভৃত্যচিত মনোভাব ৷ এটা আজকের বাঙালির মধ্যে বাড়ছে ৷ সমকালীন বাঙালি 'আমি ইংরেজি জানি' ভাবতে গর্ব অনুভব করে ৷ কিন্তু ইংরেজি তো অনেকেই জানে ! এককালের বাঙালি ইংরেজি ও বাংলা দুটোই ভালো করে জানত ৷ তা না হলে তারা ব্রিটিশ আমলে চাকরি পেত না ৷ অতএব, ইংরেজি জানাটা কোনও বড় কথা না ৷ আজকে এই যে এত ইংরেজির প্রতি প্রেম, ভালবাসা জেগে উঠল ৷ এটা আমার কাছে অস্বস্তিকর বলে মনে হয় ৷ তবে, তারচেয়েও অস্বস্তিকর পশ্চিমবাংলার রাজনীতির ভাষা ৷
আরও খবর : রাজ্যজুড়ে পালিত ভাষা দিবস
দিনে দিনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাজনীতির ভাষা ৷ আমি জানি, আমেরিকাতেও খারাপ কথা ব্যবহার করেন কিছু রাজনীতিবিদ ৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যা শোনা যাচ্ছে, সেই স্তরের না ৷ আর একটা কথা, ওই দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনাটা নেতাদের মধ্যেই থাকে ৷ তা নিয়ে সাধারণ মানুষের হেলদোল নেই ৷ তারা শান্ত মস্তিষ্কে চিন্তাভাবনা করে ভোট দেয় ৷ ভোট নিয়ে তেমন উন্মাদনাও নেই ৷ এদেশে ক্রমশ দেখছি, নির্বাচনটা যেন উৎসব ! ভোট মানে সেলিব্রেশন ৷ আর ভোটের ময়দানে ভাষা কেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে এতখানি?
যেহেতু রাজনীতির পৃথিবীটাই ক্রিমিনালাইজড হয়ে গিয়েছে ৷ রাজনীতিটা অপরাধীদের হাতে চলে গিয়েছে ৷ আমাদের দেশে আজকে যারা রাজনীতি করে, যারা লোকসভা, বিধানসভার সদস্য ৷ তারা অনেকেই ঘোষিত অপরাধী ৷ এদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কিছু ভালো লোকও কাজ করেন ৷ কিন্তু অপরাধীদের সংখ্যাই বেশি ৷ ফলে যাকে বলে ভাষা দূষণ তা মাত্রা ছাড়া অবস্থায় পৌঁছেছে ৷ যা আমাদের মতো মানুষের পক্ষে সহ্য করা, হজম করা বড্ড মুশকিল ৷
আরও খবর : ভাষা শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে মধ্যরাতেই পথে নামল বসিরহাট
আমার অনেক বয়স হয়েছে ৷ আমার যখন যুবক বয়স তখন বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, প্রফুল্ল ঘোষ, জ্যোতি বসুদের দেখেছি ৷ তাঁরাও রাজনীতি করতেন, তাঁদের মধ্যেও ছিল প্রতিযোগিতা ৷ কিন্তু আজকের রাজনীতিবিদদের মত কেউ কাউকে এ-ভাবে অপমান করতেন না ৷ এমন দেখিনি, শুনিনি ৷ এত কটু কথা বলতেন না কখনই ৷ আজকে অবশ্য এর ইন্ধন জোগায় টিভি, মিডিয়া ৷ বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়া ৷ ভাষা দূষণের একটা চূড়ান্ত দেখতে পাচ্ছি সোশ্যাল মিডিয়ায় ৷ অন্যদিকে মিডিয়ায় সামনে নেতাদের ভাষার যে 'খেলা' দেখছি, তা অবিশ্বাস্য ! আজকে ক্যামেরার সামনে একটা কথা বলছেন, কালই তা অস্বীকার করছেন ৷ বলছেন, ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে ৷ অর্থাৎ, নিজেকে সামলাতে পারেন না এরা ৷ বেফাঁস কথা বলেন ৷ তারপর এক মিথ্যেকে আর এক মিথ্যে দিয়ে ঢাকতে চান ৷ এই তো অবস্থা ৷ আমি রাজনীতির বিষয়ে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি ৷ রাজনীতিকে বরাবরই ভয় পেতাম ৷ কিন্তু আজ যা দেখছি, আগে দেখিনি ৷ দেখছি বড় নেতারাও কদর্য কথা বলছেন ৷ একেবারে রকের ভাষা, গুণ্ডাদের ভাষা ব্যবহার করছেন ৷ চর্চাটা মূলত পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়িতে এসে ঠেকেছে ৷ তাঁরা এমনভাবে কাদা ছুড়ছেন, যে তাঁদের সততা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে ৷
এতে বাংলা ভাষার অবনমনই দেখতে পাচ্ছি আমি ৷ যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ৷ শুনেছি, জাপানি ভাষায় কোনও ইতর শব্দ নেই ! সেখানে পথচলতি একজনের সঙ্গে আর একজনের ধাক্কা লাগলে একে অপরের কাছে ক্ষমা চেয়ে, অভিবাদন জানানোই নিয়ম ৷ অন্যদিকে, আমাদের দেশে রাজনীতির নামে যে তরজা শুরু হয়েছে, ভোটের দিন ঘোষণা হওয়ার অনেক আগে থেকেই, তা অভাবনীয় ৷ আগেকার দিনে কবির লড়াইয়ে এর চেয়ে ভদ্র শব্দের ব্যবহার হত ৷ একটা সৌজন্য ছিল ৷ আজ সৌজন্যের আর বালাই নেই ৷ রাজনৈতিক সৌজন্য নেই, ব্যক্তি সৌজন্য নেই ৷ ভাষা দূষণের মাত্রা বাড়ছে ৷ বলি দেওয়া হচ্ছে ভাষাকে ৷ যা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশকেও দূষিত করছে ৷
এই পরিস্থিতি বাংলা ভাষার অপমান ৷ একজন বাঙালি হিসেবে তেমনটাই মনে হয় আমার ৷ তবু, বুক বাঁধি আশায় ৷ ভবিষ্যতে এমন মানুষও হয়ত আসবেন, যাঁরা ভাষার মর্যাদা বুঝবেন, তাকে রক্ষা করবেন ৷ তাঁরা হয়ত অন্যদের প্রভাবিতও করবেন ৷ তবে তার আগে প্রয়োজন রাজনীতি থেকে আজকের এই বিরাট অপরাধ চক্রটাকে বাদ দেওয়া ৷ না হলে ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা-সহ সমাজের সব ক্ষেত্রে বাঙালিকে ভুগতে হবে ৷ হবেই ৷