কলকাতা, 24 সেপ্টেম্বর : কোরোনা আবহে চলতি বছর CBSE, ISC, WBCHSE, সব বোর্ডের পরীক্ষাতেই নম্বরের ছড়াছড়ি দেখা গিয়েছে । মুড়ি-মুড়কির মতো নম্বরের ছড়াছড়ি দেখে প্রথমেই আশঙ্কা করা হয়েছিল, এই বছর কলেজে ভরতির কাট-অফ অনেক বেশি থাকবে । আশঙ্কা সত্যি করে কলেজে ভরতি প্রক্রিয়া শুরুর দিন থেকে এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখনও ভরতি হতে পারেনি বহু পড়ুয়া । তাদের কেউ 87% কেউ আবার 80% নম্বর পেয়েছে দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় । ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের ও অভিভাবকদের । পছন্দের কলেজ তো দূরস্থান, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যে কোনও একটা কলেজে ভরতি হয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে চাইছে তারা ।
10 অগাস্ট থেকে রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে স্নাতক স্তরে ছাত্র-ছাত্রী ভরতি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে । রাজ্য সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী, সম্পূর্ণ অনলাইনে হচ্ছে চলতি বছরের ভরতি প্রক্রিয়া । অনলাইনে আবেদন গ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর মেধাতালিকা প্রকাশ হতেই সামনে আসে ভরতিতে সমস্যার বিষয়টি । দেখা যায়, বহু ক্ষেত্রেই 90 শতাংশের উপর নম্বর পাওয়া পড়ুয়াদের স্থান হয়নি প্রথম বা দ্বিতীয় মেধাতালিকায় । আর 85-80 % নম্বর পাওয়া পড়ুয়াদের স্থান শহরের নামী কলেজগুলির মেধাতালিকার অনেকটাই নিচে । ফলে সেই কলেজগুলিতে ভরতির সুযোগ তাদের নেই বললেই চলে । সেখান থেকেই দেখা দিয়েছে সমস্যা । কারণ, অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী পছন্দের 7-8টি কলেজেই আবেদন করেছে । কিন্তু, বর্তমানে যখন তারা পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে তখন অন্যান্য কলেজে আবেদন জমা নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে । ফলে, দুশ্চিন্তায় দিশেহারা অবস্থা এখন তাদের ।
যেমন, CBSE বোর্ড থেকে এই বছর দ্বাদশ উত্তীর্ণ নিউ আলিপুরের আত্রেয়ী পাল । তিনি 6-7টি নামী কলেজে আবেদন করেছিলেন ইংরেজি অনার্স কোর্সের জন্য । আত্রেয়ী মোট 80% নম্বর পেয়েছেন এবং ইংরেজিতে 91 নম্বর পেয়েছেন । কিন্তু, আশুতোষ, বেথুন, স্কটিশের মতো কলেজে এই নম্বরে ভরতির সুযোগ নেই বললেই চলে । আত্রেয়ী পালের কথায়, "সব জায়গাতেই ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের পড়ুয়াদের ভরতি হয়ে যাচ্ছে । আমি মানছি আমার নম্বর অন্যান্য স্টুডেন্টদের মতো ভালো নয় । কিন্তু, ওভার অল 80% এবং ইংরেজিতে 91 পেয়েছি । আমার মনে হয় না এটা খুব খারাপ রেজ়াল্ট । আমি আশুতোষ, যোগমায়া, স্কটিশ চার্চে আবেদন করেছি । ইংরেজি নিয়ে পড়তে চাই । লেডি ব্রেবোর্নে ইংরেজির জন্য 92% চেয়েছিল ইংরেজিতে । আমার 91% আছে বলে আমি আবেদনই করতে পারিনি । ভীষণ টেনশনে আছি যে কবে অ্যাডমিশন হবে । যেদিন থেকে অ্যাডমিশন শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই অ্যাপ্লাই করে যাচ্ছি । কিন্তু, পাঁচটা, ছয়টা যে তালিকা বেরিয়েছে তাতে আমার নাম আসেনি । এখন যা পরিস্থিতি দেখছি তাতে পছন্দের কলেজে হবে বলে মনে হয় না । যে কলেজে হবে সেখানেই ভরতি হয়ে যাব ।"
পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ পরিচালিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় মোট 87% নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হওয়া অর্ঘ্যদীপ দাস গণিতে অনার্স নিয়ে পড়তে চান । গণিতে 82 পেয়েছেন । কিন্তু, একমাস পেরিয়ে গেলেও এখনও কোনও কলেজে ভরতি হতে পারেননি । অর্ঘ্যদীপের কথায়, "আমি এই বছর 87% নম্বর পেয়েছি উচ্চমাধ্যমিকে । 9-10টা কলেজে অন্তত আবেদন করেছিলাম । কিন্তু, এখনও পর্যন্ত কোনও কলেজেই নাম ওঠেনি । গতকাল একটা কলেজে নাম উঠেছে । বঙ্গবাসী মর্নিং। আমার ইচ্ছে নেই ওই কলেজে ভরতি হওয়ার । ইচ্ছা ছিল মৌলানা বা প্রেসিডেন্সিতে ভরতি হওয়ার । কিন্তু, ওখানে অনেক পিছনে নাম রয়েছে । যখন দেখেছিলাম, 87% নম্বর পেয়েছি তখন ভেবেছিলাম প্রেসিডেন্সি বা মৌলানাতে সুযোগ পেয়ে যাব । কিন্তু, এবারের পরিস্থিতিতে সুরেন্দ্রনাথেও সুযোগ পেলাম না । এখন মনে হচ্ছে আরও নম্বর হলে ভালো হত ।" এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বঙ্গবাসী বা সিটি কলেজে ভরতি হয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে অর্ঘ্যদীপ । তবে, তা অনিচ্ছা নিয়েই ।
শুধু আত্রেয়ী বা অর্ঘ্যদীপ নয় । একই সমস্যার সম্মুখীন চলতি বছরের বহু ছাত্র-ছাত্রীর । এই পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, "এই আশঙ্কা ছিল । যদি প্রাপ্ত নম্বর ক্রমশ বাড়তে থাকে তাহলে বেশি নম্বরও একসময় কম নম্বর হয়ে যায় । 100 জন যদি 90-র উপরে পায় তখন 81 বেশ খারাপ নম্বর । ফলে এই সম্ভাবনাটা ছিল । পরীক্ষার্থীরা 99, 98 কী করে পেল আমি জানি না । আমাদের সময়ে 60 পাওয়াই সাংঘাতিক একটা ব্যাপার ছিল । যে 99 পেয়েছে তার সুযোগ আগে আসবে, এটা সহজ হিসাব । আমার খারাপ লাগছে যে, অভিভাবক-অভিভাবিকারা এবং শিক্ষা প্রশাসকরা কেন এটা বুঝতে পারেননি? তাঁরা আগে থেকে কেন ছেলে-মেয়েদের বলেননি যে নম্বর বেশি হলেও তার মধ্যে একটা সিঁড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে । কাজেই সবথেকে বেশি যারা পেয়েছে তারাই সব থেকে আগে ভালো কলেজগুলিতে সুযোগ পাবে । এটা সহজ হিসাব । এই সমস্যার জন্য আগেই প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল অভিভাবক-অভিভাবিকাদের ও শিক্ষা প্রশাসকদের । কলকাতার ছাত্র কলকাতার বাইরে কেন পড়তে যাবে? শুধুমাত্র পরিকল্পনার অভাবে ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারিনি বলে আমরা ভয়ংকর একটা পরিস্থিতির জায়গায় পৌঁছে গেলাম । আমরা আগেই ধরে নিয়েছিলাম যারা ভালো নম্বর পেয়েছে তারা আগে ভালো কলেজে সুযোগ পাবে । এটা সমস্যার জায়গা । সমাধান শিক্ষা দপ্তরকেই করতে হবে । সবাইকে নিয়ে বসে ভালো কী সমাধান পাওয়া যায় সেই উপায় বার করতে হবে ।"
তবে, ছাত্র-ছাত্রীরা ভরতি হতে পারছেন না সেকথা মানতে নারাজ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় । কয়েকদিন আগেই তিনি এই বিষয়ে বলেছিলেন, "কোনও সমস্যাই হচ্ছে না । কিছু কিছু কলেজে গিয়ে সবাই ভিড় করছে । আসনের জন্য ভরতি হতে পারছে না তা নয় । এখন আবার ঝোঁক হচ্ছে কানেক্টিভিটিটা কোথায় ভালো সেই কলেজে ভরতি হওয়ার । আসন আছে । ভরতি হতে পারছে না এই কথাটা আপত্তিজনক । কিন্তু, পছন্দসই কলেজগুলিতে নম্বরের ভিত্তিতে সবাই প্রতিযোগিতায় থাকতে পারছে না । এখানে কিছু করণীয় নেই। সরকার বদ্ধপরিকর পাশ করা পরীক্ষার্থীদের প্রত্যেককেই আসন দেওয়ার ব্যাপারে । একটা কলেজে আসন ফুরিয়ে গেলে অন্য কলেজে যেতে হবে ।"
পাশাপাশি, ছাত্র-ছাত্রীদের পছন্দের কলেজেই ভরতি হওয়ার প্রবণতা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, "আগে বিভিন্ন কলেজে সামগ্রিক উন্নয়নের অভাব ছিল । পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষক ছিল না । এখন শিক্ষকের চাহিদা ছাত্রের অনুপাতে মেটানো গিয়েছে । কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে । পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে । কিন্তু এখনও মানুষ একটা ধারণার উপর চলছে । যেমন সংস্কৃত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে হবে । সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও সেখানে যাচ্ছে না । এই মাইন্ডসেটের সঙ্গে ভরতির কোনও সম্পর্ক নেই । যদি কেউ নম্বর থাকা সত্ত্বেও ভরতি হতে না পারে তবে গ্রিভ্যান্স সেলে জানাক ।"
তবে, পছন্দের কলেজের বিষয়টা সত্যি হলেও, অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক দিক বিবেচনা করেও নির্দিষ্ট একটি কলেজে ভরতি হতে চায় পড়ুয়ারা । যেমন, অর্ঘ্যদীপ দাস । তাঁর বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয় । তাই মৌলানা আবুল কালাম কলেজেই ভরতি হতে চেয়েছিলেন । অর্ঘ্যদীপের মা আরতি দাস বলেন, "পছন্দের কলেজ বলে কথা নয় । মৌলানা, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সিতে 2400-2500 টাকা প্রতি বছর লাগে । কিন্তু, বিদ্যাসাগর, বঙ্গবাসীর মতো কলেজগুলির ক্ষেত্রে আমাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতি বছরের খরচটা । সেই জন্য ভাবছিলাম যদি মৌলানা, প্রেসিডেন্সি বা যাদবপুরে হত তাহলে সেই খরচ বহন করাটা আমাদের জন্য অনেক সহজ হত । ওর বাবার গ্লুকোমা ড্যামেজ, বাইরে কাজে যেতে পারেন না । আমি একটা ছোটো ফ্যাক্টরিতে সামান্য বেতনের কাজ করি । তাই মৌলানায় ভরতি হতে পারলে আমাদের জন্য ভালো হত । ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছি । আমরা খুব কষ্ট করে ওকে পড়াশোনা করাচ্ছি ।"
এই বছর কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের ভরতিতে সমস্যা নিয়ে যোগেশচন্দ্র চৌধুরি কলেজের অধ্যক্ষ পঙ্কজ কুমার রায় বলেন, "অনলাইন অ্যাডমিশন দুর্নীতিকে আংশিকভাবে রিমুভ করেছে । তবে পুরোপুরি নয় । কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইন কাউন্সেলিং হওয়া উচিত ছিল । যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং বা অন্য ক্ষেত্রে হয় । দ্বিতীয়ত, এবারে প্যানডেমিক পরিস্থিতির কারণে একটা গড় নম্বর এসেছে। গড় কখনও অরিজিনাল হতে পারে না । নিচু এবং উচুঁর একটা মধ্যস্থতা করা হয় । ফলে ছাত্রছাত্রীরা বুঝতেই পারেনি তাদের রিলেটিভ পজ়িশনটা কোথায় । তার ফলে তারা নম্বরের ভিত্তিতে যে গ্রেডের কলেজে সুযোগ পাবে বলে ভেবেছিল সেটা হয়নি । আমরা সাধারণত উঁচু, মাঝারি এবং নিচু সব জায়গায় আবেদন করতে পরামর্শ দিই । কিন্তু, ছাত্র-ছাত্রীদের এই কাউন্সেলিংটা করানোর ব্যবস্থা আমাদের নেই । আমি ভবিষ্যতের ব্যাচকে বিষয়টির থেকে শিক্ষা নিতে বলব । পরীক্ষার্থীরা যাই নম্বর পাক না কেন তাদের তিন ধরনের কলেজেই আবেদন করতে হবে । একজন ভালো ছাত্র ভরতি হতে পারছে না শুনে একজন অধ্যক্ষ হিসেবে আমারও খুব খারাপ লাগছে ।"
তবে, শিক্ষামন্ত্রীর কথা শুনে অন্য কলেজে ভরতি হতে চাইলেও এই মুহূর্তে সেই রাস্তা বন্ধ ছাত্র-ছাত্রীর জন্য । কারণ, তারা নিজেদের পছন্দের 7-8টি কলেজেই শুধুমাত্র আবেদন করেছিল । বর্তমানে দুই-তিনটি কলেজ ছাড়া অন্য কলেজে দ্বিতীয় দফায় নতুন করে আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে না । ফলে, তারা আবেদন করতে পারছে না । আবার অনেক কলেজ প্রথম দফায় করা আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রকাশিত প্রভিশনাল মেধাতালিকা থেকেই ফাঁকা আসনগুলি পূরণ করার চেষ্টা করছে । সেক্ষেত্রে নতুন কেউ যদি ওই কলেজগুলিতে আবেদন করতে চায় তা করতে পারবে না । যদিও, ইতিমধ্যে 21 সেপ্টেম্বর উচ্চশিক্ষা দপ্তরের তরফে নির্দেশিকা জারি করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বলা হয়েছে, আসন ফাঁকা থাকলে সেগুলি পূরণের জন্য পুনরায় আবেদন জমা নেওয়ার পোর্টাল ওপেন করতে পারে তারা । এর আগে উচ্চশিক্ষা দপ্তরের দেওয়া ভরতির গাইডলাইন অনুযায়ী 24 সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলার কথা ছিল ভরতির প্রক্রিয়া । সেই সময়সীমা বাড়িয়ে 30 অক্টোবর করা হয়েছে । অধ্যক্ষ মহলের মতে, আগের সময়সীমা 24 সেপ্টেম্বর শেষ হবে । তারপরে আলোচনা করে অনেক কলেজই আবার ভরতির আবেদন গ্রহণের পোর্টাল খুলতে পারে । তাহলে অনেক পড়ুয়া যারা এখনও ভরতি হতে পারেনি তারা উপকৃত হবে বলে মনে করা হচ্ছে ।