কলকাতা, 20 অগস্ট: নিজের হাতে ধরা কাগজটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন স্যার স্টুয়ার্ট হগ (Sir Stuart Hogg) ৷ সেই সময় তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী শহর কলকাতার পুলিশ কমিশনার (Kolkata Police Commissioner) ৷ কীভাবে কোনও ব্যক্তি নিজেই নিজেকে গ্রেফতার করতে পারেন ! এই মোদ্দা বিষয়টাই বোধগম্য হচ্ছিল না তাঁর ৷ ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন ? তা জানার আগে স্যার স্টুয়ার্ট হগের সঙ্গে একটু পরিচয় সেরে ফেলা দরকার ৷
লন্ডনের অভিজাত ইটন কলেজে (Eton College) পড়াশোনা করেছিলেন স্টুয়ার্ট ৷ ভারতে তাঁর পদার্পণ হয় 1853 সালে ৷ এরপরই তিনি 'বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস' (Bengal Civil Service)-এ নাম লেখান ৷ নিজের কর্মজীবনে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে হগ সাহেবকে ৷ অবিভক্ত বর্ধমানের জেলাশাসক হওয়াটা তার মধ্যে অন্যতম ৷ তাঁর সততা এবং কর্মদক্ষতা দ্রুত তাঁকে যোগ্য প্রশাসক হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে তোলে ৷ পাশাপাশি, একজন ভালো মানুষ হিসাবেও তাঁকে গণ্য করা হত ৷ 1865-66 সালের দুর্ভিক্ষের সময় নিজের উদ্যোগে বহু মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছিলেন স্টুয়ার্ট ৷ তাঁর এই কীর্তি তাঁকে হতদরিদ্র জনতার মনে ঈশ্বরের সমতুল্য সম্মান ও শ্রদ্ধা দিয়েছিল ৷
আরও পড়ুন: Heritage Building ধ্বংসের মুখে রাজা সুবোধ মল্লিকের প্রাসাদ, অসহায় পৌরনিগম
1866 সালের মাঝামাঝি বর্ধমান থেকে কলকাতা পাঠানো হয় স্টুয়ার্টকে ৷ সেই সময় তাঁর কাঁধে দু'টো বড় দায়িত্ব ছিল ৷ একইসঙ্গে তিনি ছিলেন, কলকাতার পুলিশ কমিশনার এবং কলকাতা পৌরনিগমের চেয়ারম্যান ৷ বেশিরভাগ সময়টাই লালবাজারে কলকাতা পুলিশের সদর দফতরে কাটাতেন স্টুয়ার্ট ৷ বাকি সময়টুকু কাটত 8 নম্বর জানবাজার স্ট্রিটে (বর্তমানে এস এন ব্যানার্জি রোড), পৌরনিগমের প্রধান কার্যালয়ে ৷
কলকাতা পৌরনিগমের চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর অমর কীর্তি নিঃসন্দেহে হগ মার্কেটের (Hogg Market) প্রতিষ্ঠা ৷ যার পত্তন হয়েছিল 1874 সালের 1 জানুয়ারি ৷ পরবর্তীকালে লোকমুখে যা পরিচিত হয় 'হগ সাহেবের মার্কট' (Hogg Saheb’s Market) নামে ৷ বস্তুত, হগ মার্কেট নামটাও তারই পরবর্তিত রূপ ৷ পরে অবশ্য 1903 সালে এই বাজারের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে হগ মার্কেট বলে ঘোষণা এবং নথিবদ্ধ করা হয় ৷
হগ সাহেবের কীর্তি এখানেই শেষ নয় ৷ বর্তমানে কলকাতা পুলিশের অধীনে যে গোয়েন্দা বিভাগ রয়েছে, তারও সূচনা হয়েছিল এই ব্রিটিশের হাতেই ৷ তাঁর মনে হয়েছিল তৎকালীন 'ক্যালকাটা পুলিশ' (Calcutta Police)-এ একটা 'ক্রাইম ব্রাঞ্চ' (Crime Branch) থাকা দরকার ৷ এর পিছনেও রয়েছে এক ইতিহাস ৷ তবে সেই 'কাহিনি' মর্মান্তিক ও নারকীয় ৷ আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা এলাকায় একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বালিকাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয় ৷ তার নাম ছিল রোজ ব্রাউন ৷ দিনটা ছিল 1868 সালে 1 এপ্রিল ৷ এক রাতেই খুনিকে পাকড়াও করে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন রিচার্ড রিইড (Richard Reid) নামে এক পুলিশ আধিকারিক ৷ বস্তুত, এই রিচার্ড রিইডকেই কলকাতা পুলিশের প্রথম গোয়েন্দা বলে ধরা হয় ৷ রোজ ব্রাউন হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন হগ সাহেব নিজেও ৷ পরবর্তীকালে একটি বই লেখেন রিচার্ড ৷ যার নাম, 'এভরি ম্যান হিজ ওন ডিটেক্টিভ' (Every Man His Own Detective) ৷ এই বইটিতে স্টুয়ার্ট হগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন রিচার্ড রিইড ৷
আরও পড়ুন: World Mosquito Day জেনে নিন বিশ্ব মশা দিবস সম্পর্কে কিছু তথ্য
এবার ফিরে আসি সেই ঘটনায়, যেখান থেকে আমরা এই 'গল্প' শুরু করেছিলাম ৷ আসলে হগ সাহেব তখন লন্ডনে ছুটি কাটিয়ে সবেমাত্র কলকাতায় ফিরেছেন ৷ কিন্তু, কলকাতার ঠিকানায় ঢুকে সঙ্গে থাকা বাক্স-প্যাঁটরা খুলতেই বুঝে যান 'দুর্ঘটনা' ঘটে গিয়েছে ৷ তাঁর ব্যাগপত্তর বদলে গিয়েছে অন্য কারও সঙ্গে ৷ বহু খোঁজাখুঁজির পর সেই ব্যাগের হদিশ মেলে এলাহাবাদে ৷ এই ঘটনার জেরে স্টুয়ার্টের নামে একটি সমন জারি করেন সেখানকার এক ম্যাজিস্ট্রেট ৷ তার ভিত্তিতে কলকাতা পৌরনিগমের চেয়ারম্যানকে এলাহাবাদে তলব করা হয় ৷ এবং নির্দিষ্ট দিনে সেখানকার আদালতে হাজির হতে বলা হয় ৷ এদিকে, হগ সাহেবের কাঁধে তখন পাহাড় প্রমাণ দায়িত্ব ৷ ফলে তিনি আর এলাহাবাদের আদালতে গিয়ে হাজিরা দেওয়ার সময় পাননি ৷ আর তারই ফলে কলকাতার পুলিশ কমিশনারের কাছে একটি নির্দেশ আসে ৷ তাতে বলা হয়, পুলিশ কমিশনারকে পৌরনিগমের চেয়ারম্যানকে গ্রেফতার করতে হবে এবং তাঁকে আদালতে পেশ করতে হবে ! ঘটনাচক্রে, দুটো মানুষই আসলে ছিলেন একই ব্যক্তি !
তবে, এমন আজব পরিস্থিতিতে পড়েও নিজের কর্তব্য ভোলেননি স্টুয়ার্ট হগ ৷ পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট পৌরনিগমের চেয়ারম্য়ান স্টুয়ার্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন ৷ অভিযোগ ছিল, আদালত অবমাননার ৷ পরবর্তীতে 1871 সালে 'হিন্দু প্যাট্রিয়ট' (Hindu Patriot) সংবাদপত্রে এই ঘটনা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল ৷ সেই অনুসারে, শেষমেশ আদালতের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন স্যার স্টুয়ার্ট হগ ৷