কলকাতা, 5 জুলাই : গোটা বিশ্বে এর আগে দুর্লভ এই রোগে আক্রান্ত মাত্র 14 জনের খোঁজ পাওয়া গেছে । তাঁদের মধ্যে মাত্র 3 জন রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে । COVID-19-এর এই পরিস্থিতির মধ্যে দুর্লভ এই রোগের 15 নম্বর রোগীর খোঁজ মিলল কলকাতায় । ভারতে প্রথম খোঁজ পাওয়া এমন রোগীকে কলকাতার বেসরকারি একটি হাসপাতালে সুস্থ করে তোলা হয়েছে । এদিকে, যে তিন জন রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, চিকিৎসার সময় তাঁদের বয়স ছিল 20-র মধ্যে এবং তাঁদের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি অপারেশন করতে হয়েছিল । কলকাতায় যে রোগীকে সুস্থ করে তোলা হল, তাঁর বয়স 49 । একটি অপারেশনের মাধ্যমে এই রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে । এই ঘটনা গোটা বিশ্বে এই প্রথম বলে জানানো হয়েছে ।
দুর্লভ এই রোগের নাম ইডিওপ্যাথিক প্রাইমারি রেট্রোপেরিটোনিয়াল নেক্রোটাইজ়িং ফেসিয়াইটিস । দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায় অবস্থিত বেসরকারি একটি হাসপাতালে এই রোগে আক্রান্ত বিশ্বের 15 নম্বর রোগীর খোঁজ পাওয়া যায় । এই ধরনের রোগীর খোঁজ এদেশে এই প্রথম । 49 বছর বয়সি এই রোগীর নাম অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি কাটোয়ার বাসিন্দা । তিনি যে এমন দুর্লভ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা আচমকাই জানা গেছিল । অরিন্দম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, " আগে থেকে কিছু বুঝতে পারিনি । আচমকা ইউরিন বন্ধ হয়ে গেল, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল । স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে গেছিলাম । তিনি ইউরিনের জন্য ওষুধ দিলেন, ক্যাথিটার পরতে বললেন । ক্যাথিটার পরার পরে ইউরিন হল, কিন্তু শ্বাসকষ্ট কমছিল না । এরপরে সোজা কলকাতায় চলে আসি ।"
লকডাউনের মধ্যে 3 মে এই রোগীকে ভরতি করানো হয় ঢাকুরিয়ায় অবস্থিত বেসরকারি ওই হাসপাতালে । এখানকার চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, " পেটে অসহ্য যন্ত্রণা । পেট ফুলে গেছে । কিডনি প্রায় অকেজো হয়ে গেছে । ইউরিন হচ্ছে না । মৃত্যুপথযাত্রী । এমন অবস্থায় এই রোগী আমাদের কাছে আসেন । সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে সিটি স্ক্যানের রিপোর্টে যেটা দেখা যায়, তাতে বোঝা যায় এটা ইডিওপ্যাথিক প্রাইমারি রেট্রোপেরিটোনিয়াল নেক্রোটাইজ়িং ফেসিয়াইটিস । তবে এখানে এই রোগ হতে পারে, তা আমাদের ধারণাতেও ছিল না । প্রথমে আমরা অনেক কমন রোগের কথা ভাবছিলাম । সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা যখন সিটিস্ক্যান করি তখন অবাক হয়ে যাই । দেখা যায়, রোগীর পেটের চারিদিকের আবরণ, চর্বি, মাংসপেশীর ভিতরে ভরতি হয়ে রয়েছে গ্যাস এবং গ্যাংগ্রিন । এটা দেখে আমরা বোঝার চেষ্টা করি, অনেক পড়াশোনা করি । তখন আমরা বুঝতে পারি এটা দুর্লভ এই রোগ ইডিওপ্যাথিক প্রাইমারি রেট্রোপেরিটোনিয়াল নেক্রোটাইজ়িং ফেসিয়াইটিস ।" চিকিৎসক আরও জানান, আমাদের পুরো পেট, পিঠের হাড় থেকে শুরু করে সামনের দিকে নাভি পর্যন্ত, দুই দিক থেকে অনেক মাংসপেশি, অনেক আবরণ এবং চর্বির লেয়ার আছে । অঙ্গগুলিকে ধরে রেখেছে এই চর্বির লেয়ার । স্নায়ুপথ, রক্তনালী সব কিছুই এই চর্বির লেয়ারের উপর নির্ভর করছে । এই রোগীর ক্ষেত্রে এক সঙ্গে সব পচে গেছিল । এত পচা জিনিস পেটের মধ্যে থাকলে সেই রোগীর পক্ষে বাঁচা প্রায় অসম্ভব । COVID-19-এর এই সময়ের মধ্যে ইমারজেন্সির ভিত্তিতে মেজর একটি অপারেশন করা হয় । ঘণ্টা চারেক ধরে চলা এই অপারেশনের মাধ্যমে এই রোগীর পেটের ভেতর থেকে সব পচা জিনিস কেটে বাদ দেওয়া হয় । তবে, এই রোগীর পিঠের হাড় থেকে সামনে নাভি পর্যন্ত যতগুলি অঙ্গ, স্নায়ু, রক্তনালী রয়েছে, সবগুলিকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে । 5 মে এই অপারেশন করা হয় । রোগী সুস্থ হয়ে ওঠায় 18 মে হাসপাতাল থেকে রোগীকে ছুটি দেওয়া হয় । "
বেসরকারি এই হাসপাতাল গোষ্ঠীর গ্রুপ CEO রূপক বড়ুয়া বলেন, " আমি খুব আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের ঢাকুরিয়ার হাসপাতালে বিরলতম এই সার্জারি করা হয়েছে ৷ বিশেষ করে এই COVID-19-এর পরিস্থিতির মধ্যে । আমরা জানতে পেরেছি, এই ধরনের অপারেশন এই দেশে প্রথম । সফল অপারেশনের পরে রোগীকে সুস্থ ভাবে আমরা বাড়িতে পাঠাতে পেরেছি ।"
এই রোগ কেন দুর্লভ? চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, " গোটা পৃথিবীতে এই ধরনের মাত্র 14টি কেসের রিপোর্ট রয়েছে । ভারতে হয়তো নেই । এই 14 জনের মধ্যে 11 জনের মৃত্যু হয়েছে । মাত্র যে 3 জন বেঁচেছেন, তাঁদের বয়স 20-র মধ্যে ছিল । আমাদের এখানে এই রোগীর বয়স 49 বছর । রোগীর ব্লাড সুগার, হার্টের সমস্যা ছিল । এই রোগে পশ্চিমী দেশের যে 3 জন বেঁচেছেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের কিন্তু 6-8টি অঙ্গ কেটে বাদ দিতে হয়েছিল দুই-একদিন অন্তর অপারেশন করে । এবং সব রোগীর ক্ষেত্রে প্রায় দেড় মাস থেকে প্রায় তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল । অনেকের ক্ষেত্রে এক-দেড় মাস ভেন্টিলেটর, ডায়ালিসিস, মাল্টিপল অর্গানের সাপোর্ট লেগেছিল । COVID-19-এর এমন এক কঠিন সময়ের মধ্যেও আমাদের এখানে এই রোগীর ক্ষেত্রে একটি অপারেশন করা হয়েছে । রোগীকে ভেন্টিলেটর, ডায়ালিসিস, অরগ্যান সাপোর্ট দিতে হয়নি । সাত থেকে 14 দিনের মধ্যে রোগী একদম স্বাভাবিক হয়ে বাড়ি চলে গেছেন । এবং সুস্থ রয়েছেন ।" চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, "এটা অত্যন্ত রেয়ার কেস । কারণ, এত কম যে এর একচুয়াল মাত্রা জানা সম্ভব নয় । এ বিষয়ে এত কম লিটারেচার রয়েছে যে এই রোগের বিষয়ে মানুষ খুব একটা জানেন না । সম্ভবত এটা পৃথিবীতে প্রথম কেস যিনি এই রকমভাবে একটি অপারেশনের পর সুস্থ হয়ে উঠলেন, বাড়িতে ফিরে গেলেন । এই রোগীর পেটের ভিতর সব অর্গ্যানকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি ।" তবে, রোগীর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ফোনে যোগাযোগ করতে করতে কলকাতার এই হাসপাতালে চলে এসেছিলেন তিনি । কোনও সময় যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য রোগীকে দ্রুত ভরতি করিয়ে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দ্রুত অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
এ কথা জানিয়ে চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, " পশ্চিমী দেশে যেখানে এই ধরনের 3 জন রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে, 11 জন রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি, সেখানে এ রকম একজন রোগীকে বাঁচানো অত্যন্ত কঠিন বিষয় ছিল ।" এই চিকিৎসক বলেন, " আচমকা পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ৷ পেট ফুলে যায় ৷ 6 থেকে 8 ঘণ্টা মধ্যে ইউরিন বন্ধ হয়ে যায় ৷ বমি করতে শুরু করেন ৷ খাওয়া বন্ধ করে দেন ৷ প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেছিলেন অরিন্দম । "
এই রোগ কেন হয়? চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, "এই রোগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বলা হয় প্যানক্রিয়াস অথবা কিডনি কিংবা অ্যানোরেক্টাল রিজিয়নে যদি কোনও ইনফেকশন থেকে সমস্যা থাকে, তাহলে হতে পারে । যদিও খুব রেয়ার । ওই 14 জনের মধ্যে হয়ত 8-10 জনের মধ্যে ছিল । কিন্তু ইডিওপ্যাথিক প্রাইমারি বলা হয় যখন তার কোনও কারণ ধার্য করা যায় না । হাজার রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও কোনও কারণ পাওয়া যায় না । আমরাও এই রোগীর ক্ষেত্রে কোনও কারণ খুঁজে পাইনি । যার ফলে এটাকে বলব রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার কেস । আমরা অনেক রেয়ার কেস করেছি, বিশ্ব রেকর্ড করেছি । কিন্তু এত রেয়ার কেস করিনি ।" এই ধরনের রেয়ার কেস কি এ দেশে প্রথম? চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, " আমার যতটা ধারণা, যতটা সার্চ করেছি, ইন্টারনেটে দেখেছি, তাতে এ দেশ থেকে রিপোর্টেড কোনও কেস নেই । এটা এতটাই রেয়ার কেস যে আমার জীবনে আবার এই ধরনের কেস দেখতে পাব কি না, তা জানি না ।"
চিকিৎসক জানিয়েছেন, এই রোগীর ক্ষেত্রে অঙ্গগুলি পচে যেতে দেওয়া হয়নি । তার আগেই অপারেশনের মাধ্যমে আটকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে । এই রোগের ক্ষেত্রে যেভাবে পচে ওঠে, তা সামুদ্রিক একটি ঝড়ের মতো পুরো জল ভিতরে চলে আসার মতো পচন ধরতে থাকে অর্গানগুলিতে । এটা হওয়ার আগেই অপারেশনের মাধ্যমে এই রোগীর পচে যাওয়া টিশুগুলিকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে । এর ফলে অর্গানগুলিকে বাঁচানো গেছে । চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, "অনেকগুলি অপারেশনের পরেও যে সব রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি, যে কয়েকজন বেঁচে রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে অনেক সময় বাম দিকের কোলন পচে গিয়েছে, বাদ দেওয়া হয়েছে । অনেক সময় ডান দিকের কোলন পচে গেছে সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে । কখনও লিভারের একটি অংশ পৌঁছে গেছে, কখনও প্যানক্রিয়াসের একটি অংশ পচে গেছে, বাদ দেওয়া হয়েছে । এই রোগীর ক্ষেত্রে আমরা তাঁর প্রত্যেকটি অঙ্গকে বাঁচাতে পেরেছি । যেহেতু সব অর্গ্যান রয়েছে, সুতরাং আমরা প্রত্যাশা করছি বাকি জীবন এই রোগী ভালো থাকবেন, তিনি দীর্ঘায়ু হবেন ।" তিনি বলেন, "এই রোগে পচন এত তাড়াতাড়ি হয় যে পা যেখানে পেটের সঙ্গে মিশেছে সেখান থেকে শুরু করে বুকের নিচ পর্যন্ত, সামনে থেকে পুরো পিছনের দিক পর্যন্ত যত মাংসপেশি, চর্বি রয়েছে, এই রোগীর ক্ষেত্রে এই সব স্থানে পচন ধরে গেছিল । তবে, এই রোগীর অর্গানগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই অপারেশন করা হয়েছে । এই জন্য অর্গ্যানগুলিকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে ।"
এই রোগের ক্ষেত্রে কি আগে থেকে বোঝা সম্ভব, কোনও উপসর্গ দেখা দেয়? চিকিৎসক শুদ্ধসত্ত্ব সেন বলেন, " পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা, রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, মাল্টি অর্গান ফেলিওর হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা, ইউরিন বন্ধ হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না । প্রথম কথা, রোগীর পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয় । চিকিৎসকদের পক্ষেও এটা বোঝা খুব অসম্ভব। কারণ এটা এত রেয়ার রোগ যে অনেক চিকিৎসক এই রোগের নাম শোনেননি ।" তিনি বলেন, "এই রোগী হয়ত ঠিক সময়ে এসে গিয়েছিলেন, কয়েক ঘণ্টা দেরি হলে হয়ত এই রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হত না । অপারেশনের ক্ষেত্রেও যদি আমরা দেরি করতাম, তাহলে এই রোগী বাঁচতেন না। এই রোগে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খুব দ্রুত অবস্থার অবনতি হতে থাকে।"