কলকাতা, 16 মার্চ : জল, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, এলাকার পরিচ্ছন্নতা । মূলত এসব ইশু নিয়ে স্থানীয় স্তরের ভোট হয় । অর্থাৎ, পঞ্চায়েত বা পৌরভোট । 5 বছরে বিভিন্ন পৌরবোর্ড কেমন কাজ করেছে তার মূল্যায়ন হবে এবার । কারণ, সামনেই পৌরভোট । ভাগ্য নির্ধারণ হবে শতাধিক পৌরবোর্ডের । এমন একটা সময়ে বিভিন্ন বোরো-ওয়ার্ড কেমন কাজ করেছে তা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের মতামত নিচ্ছে ETV ভারত । প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিবেদন । আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কলকাতা পৌরনিগমের 10 নম্বর বোরো ।
বিরোধীদের বক্তব্য, কলকাতা পৌরনিগমের 10 নম্বর বোরো এলাকায় গত পাঁচ বছরে কার্যত উন্নয়ন হয়নি । কারণ, এই এলাকায় পরিশ্রুত পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে । যে কারণে মাটির নিচের আর্সেনিক মেশানো জল পান করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে ৷ অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসনের মিলিত চক্রে বেআইনি বাড়ি নির্মাণও হচ্ছে এলাকায় । যার জেরে পানীয় জলের অভাব দেখা দিচ্ছে । তবে শুধুমাত্র পানের জন্য নয়, যে জল সরবরাহ করা হয়, তা অন্যান্য কাজেও ব্যবহারের উপযুক্ত নয় । এই জল ব্যবহারের ফলে ত্বকের সমস্যা দেখা দিচ্ছে ৷ চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যাও দেখা দিচ্ছে । জলে আয়রনের পরিমাণও বেশি ৷ সব মিলিয়ে পৌরনির্বাচনে বিরোধীদের প্রধান অ্যাজেন্ডা হচ্ছে জল । পরিশ্রুত পানীয় জলের অভাবের বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছেন বোরো চেয়ারপারসন তপন দাশগুপ্ত । আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদী ।
10 নম্বর বোরোতে শাসক এবং বিরোধী উভয় শিবিরের কাউন্সিলররা রয়েছেন ৷ CPI(M)-এর কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য সুব্রত দত্তর অভিযোগ, "বোরো নম্বর 10-এ পরিশ্রুত পানীয় জলের জন্য বাম আমলে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে । যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি এই এলাকায় জনসংখ্যা বেড়ে গিয়েছে । দ্রুত এখানে নগরায়ন হয়েছে । এর ফলে পানীয় জলের চাহিদা বেড়েছে । অথচ প্রয়োজন মতো পানীয় জল মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না । নতুন করে পরিশ্রুত পানীয় জলের সরবরাহের পরিমাণ বাড়েনি ।" তিনি আরও বলেন, "এই এলাকায় এখন তিন ধরনের জল সরবরাহ করা হয় । এক, গার্ডেনরিচ থেকে আসা পরিশ্রুত পানীয় জল । দুই, গভীর নলকূপের জল । তিন, এই দু'রকম জলের মিশ্রণ । গভীর নলকূপের জলের কারণে মানুষের ক্ষতি হচ্ছে । পরিশ্রুত পানীয় জল এবং গভীর নলকূপের জলের মিশ্রণ মানুষের আরও ক্ষতি করছে । কারণ মাটির তলায় আর্সেনিকযুক্ত জল রয়েছে । মাটির তলার জল পানীয় জল নয় । এই জল যদি মানুষকে খেতে বাধ্য করা হয় তাহলে ধীরে ধীরে নানাবিধ রোগ হতে পারে মানুষের ।"
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, এই বোরোর জলে আয়রন ভরতি ৷ বিরোধীরা জানায়, কিছু কিছু এলাকায় গার্ডেনরিচের জল পৌঁছায়নি ৷ সেখানে মাটির নিচের জল যাচ্ছে । কিছু কিছু এলাকায় গার্ডেনরিচের জল অল্প পরিমাণে পৌঁছেছে ৷ সেখানে মাটির নিচের জল মেশানো হচ্ছে । সুব্রতবাবু জানান, মাটির তলায় জল এভাবে তুললে শহর বিপদের মুখে পড়তে পারে । মাটি বসে যেতে পারে । এ কারণে তাঁদের আমলে মাটির নিচের জল ব্যবহার না করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল । অথচ, এখন তা মানা হচ্ছে না । তিনি আরও বলেন, "বোরো কমিটির স্বাধীন সত্ত্বা নেই । এই বোরো উন্নয়নহীন, দিশাহীন ।"
এই বোরো এলাকায় রয়েছে 12টি ওয়ার্ড । এর মধ্যে 4 টি ওয়ার্ড অর্থাৎ 91, 92, 94, 99 নম্বর ওয়ার্ড বামফ্রন্টের দখলে রয়েছে । বাকি 8টি ওয়ার্ড 81, 89, 93 থেকে 97 এবং 100 নম্বর ওয়ার্ড রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের অধীনে । বামেদের ওয়ার্ডগুলিতে কাজ করতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে । বিরোধীদের অভিযোগ, পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় এই বোরো এলাকায় অবৈধ বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে ৷ এ বিষয়ে সম্প্রতি অভিযোগও জানানো হয়েছিল । বেআইনি বাড়ি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল । কিন্তু তারপর ? সুব্রতবাবুর অভিযোগ, "প্রোমোটারদের কাছ থেকে তোলা নেওয়া হয় পুলিশের মাধ্যমে । এই টাকা বোরো চেয়ারপারসন হয়ে পৌঁছে যায় মন্ত্রীর কাছে । পুলিশ এবং কলকাতা পৌরনিগমের চক্রের এই কাজে অবৈধ নির্মাণ যত হবে, পানীয় জলের সংকট তত বাড়তে থাকবে ।" এই নির্বাচনে এই জলের বিষয়টি তাঁদের প্রধান অ্যাজেন্ডা । পাশাপাশি সুব্রতবাবু জানিয়েছেন, 12 টি ওয়ার্ডের মধ্যে ন'টি ওয়ার্ডে বামপন্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি । সবাইকে বিনা পয়সায় পরিশ্রুত পানীয় জল দেওয়ার দাবি নিয়ে এই নির্বাচনে তাঁরা লড়াই করবেন ৷
যদিও উন্নয়ন না হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বোরো চেয়ারপারসন তপন দাশগুপ্ত । তিনি বলেন, "রাস্তা, পার্ক, আলো প্রতিটি বিষয়ে 2010 সাল থেকে উন্নয়নের কাজ চলছে । 94 নম্বর ওয়ার্ডে 37 কোটি টাকা ব্যয়ে জল জমার সমস্যা দূর করার কাজ চলছে । বস্তিবাসীদের জন্য বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে । প্রতিটি পার্ক যেগুলি আবর্জনায় ভরা ছিল সেগুলি এখন সবুজে ভরে গেছে ৷ এলাকায় সুলভ শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে ৷ সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে বাসস্ট্যান্ডে, পার্কে ৷ যাত্রীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে জায়গা ৷" তবে এই বোরো এলাকায় যে জলের অভাব রয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি । বলেন, "জলের অভাব রয়েছে । যাদবপুর-টালিগঞ্জ এলাকার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে । আমার নিজের ওয়ার্ডে 10 কোটি টাকা ব্যয়ে 31 লাখ লিটার আন্ডারগ্রাউন্ড বুস্টার পাম্পিং স্টেশনের উদ্বোধন হয়েছে । 100 নম্বর ওয়ার্ডে আন্ডারগ্রাউন্ড রিজ়ার্ভারের উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে । 96 নম্বর ওয়ার্ডে বুস্টার পাম্পিং স্টেশন হয়েছে ।" একদিকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্প অন্যদিকে উন্নয়ন, এই দুই কারণে পৌর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন চেয়ারপারসন ।
পৌর প্রতিনিধি বিরোধী হওয়ার কারণে উন্নয়নের কাজ করতে দেওয়া হয় না, বিরোধীদের এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চেয়ারপারসন । তিনি বলেন, "যেখানে উন্নয়ন প্রয়োজন, সেখানে পৌর প্রতিনিধি সরকারি দলের না বিরোধী দলের, তা দেখা হয় না । মানুষকে প্রাধান্য দেওয়া হয় ।" বেআইনি বাড়ি নির্মাণ সংক্রান্ত যে অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়ে তিনি বলেন, "বেআইনি বাড়ি, এই কথাটি ঠিক নয় । কলোনি এলাকায় কিছু সমস্যা রয়েছে । পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানে আগামী পৌর বোর্ড নিশ্চয় ব্যবস্থা নেবে ।" মানুষের প্রয়োজনে যা লাগবে, আগামী দিনে উন্নয়নের প্রাধান্য হিসাবে সেটা করতে হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি ৷