কলকাতা,23 জানুয়ারি :নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে নতুন দাবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৷ একই দেশে চারটি রাজধানী তৈরি করার দাবি জানালেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ তাঁর দাবি,"দিল্লির এমন কী বিশেষত্ব আছে যে সব ক্ষমতা সেখানেই । শুধু দিল্লিই কেন দেশের রাজধানী হবে । দেশের চারটে রাজধানী হোক ।" এই দাবি সংবিধান মান্যতা দেবে কিনা তা পরের কথা ৷ কিন্তু নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে মমতার এই দাবি কেন ? সে কারণ নিয়ে অবশ্য তৃণমূলের কোনও নেতা-নেত্রী এখনও বক্তব্য শোনা যায়নি ৷ নিজের দাবির যুক্তিও দেননি মমতা নিজেও ৷ নেতাজি নিজেও কি কখনও এই পরিকল্পনা করেছিলেন? নেতাজির ভ্রাতুষ্পুত্র চন্দ্র বোস বলেন," নেতাজির এমন কোনও পরিকল্পনার কথা আমার জানা নেই ৷" তবে ?
স্বাধীনতা পূর্ব ভারত বহু রাজ্যে বিভক্ত ছিল ৷ দেশ স্বাধীন হবার ঠিক আগেও প্রায় পাঁচশোর বেশি ছোট ছোট অঙ্গরাজ্য ছিল দেশে ৷ প্রত্যেক স্বাধীন রাজ্যে আলাদা রাজধানী ছিল ৷ কখনই কোনও রাজ্যেই একাধিক রাজধানী ছিল না ৷ ব্রিটিশ ভারতেও একাধিক রাজধানীর উদাহরণ নেই ৷ দিল্লি সম্রাটের সনদ পেয়ে 1690 সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম কিনে নিয়ে কলকাতার সূচনার করে ৷ এমনকি 1857 সালে সিপাহী বিদ্রোহের পরেও কলকাতা নিয়ে কোনও মোহভঙ্গ হয়নি ব্রিটিশদের ৷ লন্ডনের মতো কলকাতাও তখন প্রিয় ছিল ভিক্টরিয়ার পূর্ব শাসকদের কাছে ৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জায়গায় ব্রিটেন সরাসরি ভারতের শাসনভার হাতে নিলেও কলকাতাকেই রাজধানী রাখে ৷ 1905 সালে বঙ্গভঙ্গ ৷ 1911 সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পরে কলকাতা নিয়ে ব্রিটিশদের মোহভঙ্গ হয় ৷ আর তার পরেই ব্রিটেনের "জুয়েল ইন দা ক্রাউন" কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন ব্রিটিশদের কাছে কলকাতা 'সাংঘাতিক শহর' ৷ সে আলাদা ইতিহাস ৷
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের ইতিহাসেও একই রাজার শাসিত দেশের কোনও সামাজ্যে একাধিক রাজধানী হয়নি ৷ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তারপর অশোকের মৌর্য সাম্রাজ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সিংহভাগ অঞ্চল একত্রিত হয়। এত বৃহৎ অঞ্চলেও বহু রাজধানীর ধারণা হয়নি ৷ খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকে গুপ্ত সম্রাটদের শাসনকাল সময়ের আগে পরে ভারতে একাধিক শক্তিশালী সামাজ্য ছিল ৷ পূর্ব ভারতে পাল সামাজ্য,দাক্ষিণাত্যে চালুক্য, চোল ও বিজয়নগর সামাজ্যেও কোনও শাসকই একাধিক রাজধানী গঠনের কথা বলেননি ৷ দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে এই দেশে ইসলামের অনুপ্রবেশ ৷ সুলতানি বা মুঘল যুগেও একের অধিক রাজধানী গঠনের স্বপ্নও কারও ছিল কিনা জানা নেই ৷একমাত্র ইতিহাসে 'পাগলা রাজা' হিসাবে পরিচিত মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে রাজধানী দেবগিরি বা দৌলতাবাদে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেন ৷ রাজধানীর স্থানান্তর ইংরেজ শাসনেও হয়েছে ৷ কিন্তু একই দেশের মধ্যে শাসন পরিচালনার জন্য একাধিক রাজধানী স্থাপনের পরিকল্পনা বোধহয় কোনও শাসন কালে দেখা যায়নি ৷ একমাত্র বিপরীত প্রকৃতির কারণে জম্মু-কাশ্মীরের দুই ঋতুতে দুটি রাজধানী ৷ শ্রীনগর এই অঞ্চলের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী এবং জম্মু শীতকালীন রাজধানী ৷
চিন, ব্রিটেন বা আমেরিকার মতো বৃহৎদেশেও একাধিক রাজধানী নেই ৷ তবে বিশ্বে রাজধানী-ই নেই এমন দেশ কিন্তু আছে ৷ ওসেনিয়া মহাদেশের দেশ নাউরু প্রজাতন্ত্রে কোনও রাজধানী নেই। ভ্যাটিক্যান সিটির পর নাউরুই হচ্ছে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র । তবে বিশ্বে একাধিক রাজধানীর দেশ আছে ৷ কোনও কোনও দেশে একাধিক রাজধানীও আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আছে তিনটি রাজধানী, প্রিটোরিয়া, কেপটাউন ও ব্লোয়িমফনটিন । তবুও প্রিটোরিয়া-ই কিন্তু প্রশাসনিক রাজধানী ৷ কেপটাউন আইনসভার রাজধানী ৷ আর ব্লোয়িমফনটিন বিচারিক রাজধানী ৷ দেশের সুপ্রিম কোর্ট ব্লোয়িমফনটিনে আছে ৷ বলিভিয়ার মতো ছোট দেশেও আছে দুটি রাজধানী লা-পাজ ও সুক্রে। কিন্তু এসব উদাহরণ হাতে গোনা ৷ দেশের রাজধানীর নাম বদলের উদাহরণ কম নেই ৷ দেশ-বিদেশে ইতিহাস ছড়াছড়ি ৷ দক্ষিণ আফ্রিকার তিনটি রাজধানী হলেও দেশের মানুষ প্রশাসনিক রাজধানী প্রিটোরিয়াকেই রাজধানী বলেন ৷ তাহলে মমতা হঠাৎই নেতাজির জন্মদিনের অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কহীন হলেও একাধিক রাজধানীর প্রসঙ্গ তুললেন কেন ? কোথাও কি কেন্দ্র বিরোধিতার মুখ হতে গিয়ে ভোটের আগে মমতার এই নতুন চমক ? দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে চারটে রাজধানী করলেই সমস্যা সহজ হবে কি-না তা নিয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা ভাবনা-চিন্তা করবেন ৷ কিন্তু নিজের দলে ভাঙন রোধে মমতা কি কোথাও স্নায়ুচাপেই ভুগছেন? আর সেই চাপ সরাতে গিয়েই একাধিক রাজধানী প্রসঙ্গ তুলে দিয়ে কিছুটা মুড বদল করতে চান? এই প্রশ্নেরও এখনও উত্তর নেই ৷