কলকাতা, 26 অক্টোবর : আশপাশে বাজি পোড়ানো হচ্ছে । অথচ, যিনি বাজি পোড়াচ্ছেন না, তাঁরও ক্ষতি হতে পারে । কানের সঙ্গে মস্তিষ্কের পক্ষেও শব্দবাজি ক্ষতিকর । আর, বাজির ধোঁয়া শ্বাসনালীর পক্ষে ক্ষতিকর । বাচ্চা থেকে বয়স্ক, যে কেউ সমস্যায় পড়তে পারে । কোন ধরনের সমস্যা? বাজি পোড়ানোর সময় বিপদের সম্মুখীন হলে কী করণীয়? এ সব নিয়ে বললেন চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী ।
শব্দবাজি । ডেসিবেলে শব্দের মাপ আসলে কম্পাঙ্কের মাপ । মানুষের কানের একটি সহ্য ক্ষমতা রয়েছে । সহ্য ক্ষমতার অতিরিক্ত কম্পাঙ্কের যে কোনও শব্দ কানের পক্ষে ক্ষতিকর । এ কথা জানিয়ে চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "কানের সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের পক্ষেও শব্দবাজি ক্ষতিকর । সাধারণ মানুষ, বয়স্ক, বাচ্চা, সকলের জন্যই এটা ক্ষতিকর ।" তিনি বলেন, "কুকুর বা গৃহপালিত অন্য পশুদের শ্রবণশক্তি আমাদের থেকে অনেক বেশি । বাজি যখন পোড়ানো হয়, তখন তারাও ভয়ে থাকে । খাটের নিচে ঢুকে যায় বা কোথাও লুকিয়ে পড়ে । অর্থাৎ, এই শব্দ তাদেরও খুব বিরক্ত করতে থাকে ।" তাঁর কথায়, "তার মানে, শ্রবণযন্ত্রের পক্ষে এটা কতটা ক্ষতিকর, সেটা তারা বুঝতে পারে ৷ কিন্তু, আমরা অনেক সময় বুঝতে চাই না ।"
এই চিকিৎসক আরও বলেন, "ছোটোদের নার্ভাস সিস্টেম ডেভেলপ করছে । তাদের কানে শব্দ তরঙ্গ নেওয়ার ক্ষমতা, শ্রবণ যন্ত্রে পাঠানোর ক্ষমতা, সেটা ডেভেলপিং। এই পর্যায়ে, ছোটোদের উপর শব্দবাজির আঘাত খুব ক্ষতিকর । তার চিরকালীন ঠিকঠাকভাবে কানের যে গড়ন, শব্দবাজির প্রভাবে সেগুলির গঠন ঠিক নাও হতে পারে । বয়স যখন বাড়ে তখন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষমতাও কমে । কানেরও কমে । কমতে থাকা কানের এই ক্ষমতার উপর শব্দবাজির প্রভাব মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ।" তবে, শব্দবাজি যে শুধুমাত্র কান এবং নার্ভের পক্ষে ক্ষতিকর, তা নয় । একথা জানিয়ে তিনি বলেন, "এমনও দেখা যায়, হঠাৎ করে শব্দবাজির অভিঘাতে মানুষের হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হয়েছে ।"
আর, বাজির ধোঁয়া? চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "শব্দের থেকে আরও বেশি প্রযোজ্য ধোঁয়া এবং ধুলো । যে কোনও বাজিই পোড়ানো হোক না কেন, শব্দ হোক বা না হোক, সেখানে কিছু একটা পুড়ছে । পুড়ছে মানে কার্বন, অক্সিজেন এবং সালফারের সংস্পর্শ হচ্ছে । কার্বন এবং সালফারের বিভিন্ন ধরনের অক্সাইড, ডাই অক্সাইড, ট্রাই অক্সাইড, মনোক্সাইড এগুলি তৈরি হচ্ছে । এগুলি সব শ্বাসনালীর পক্ষে খারাপ ।" তিনি বলেন, "শুধুমাত্র যাঁদের অ্যাজ়মা, COPD (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পুলমোনোরি ডিজ়িজ়), বুকের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের জন্য প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিকর । যাঁদের শ্বাসনালীর রোগ রয়েছে, কালীপুজোর পরে তাঁদের সমস্যা অনেক বেড়ে যায় ।"
তিনি বলেন, "বাজির ধোঁয়ায় অ্যাজ়মা রোগীদের অ্যাজ়মা অ্যাটাক বেড়ে যায় ৷ COPD রোগীদের ইনফেকশন বেড়ে যায় । যাঁরা সাধারণ মানুষ, যাঁদের ফুসফুসের কোনও অসুখ নেই, যাঁদের হাঁপানি নেই, এই বাজির পরিবেশে তাঁদের ফুসফুসেও কার্বনের আস্তরণ পড়ে যায় ।" চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "আপনি মনে করতে পারেন ঘরের মধ্যে রয়েছেন বাজি পোড়ালেন না ৷ বাজির কাছে গেলেন না । কিন্তু আপনি শ্বাস নিচ্ছেন । দরজা কতক্ষণ বন্ধ রাখবেন । বাইরের বাতাস আপনার ঘরে আসছে । সেই বাতাসের কণায় ভরতি কার্বন আর সালফারের অক্সাইডগুলি । এগুলি সব ফুসফুসের পক্ষে খারাপ । নাকের পক্ষেও খারাপ । অর্থাৎ, শ্বাসনালীর উপরিভাগ বা আপার এয়ারওয়ের পক্ষে খারাপ । বাজির ধোঁয়া-ধুলোয় অনেকের অ্যালার্জি বেড়ে যায় ।"
এই চিকিৎসক বলেন, "কার্বন এবং সালফারের যে অক্সাইডগুলি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, সেগুলির অনেকটা ফুসফুসে লেয়ার তৈরি করল ৷ কিছুটা মিশে গেল রক্তে । প্যাসিভ স্মোকিংয়ের ক্ষেত্রে যেমন ফুসফুস ছাড়া শরীরের ভেতরেও ক্ষতি হয়, এক্ষেত্র তেমনই ক্ষতি হল । এ ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি । আপনার পাশে একজন ধূমপান করছেন এবং আপনার পাশে 100 টি তুবড়ি জ্বালানো হচ্ছে, দ্বিতীয়টি আপনার পক্ষে অনেক বেশি ক্ষতিকর ।"
এরপরও বাজি পোড়াতে গিয়ে কাউকে যদি বিপদের সম্মুখীন হতে হয়? চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "বাজি পোড়ানোর সময় আচমকা বিপদের সম্মুখীন হলে,
যিনি বাজি পোড়াচ্ছেন বা বাজির আশপাশে রয়েছেন, তাঁর যেমন বিপদ হতে পারে, তেমনই যাঁরা দূরে রয়েছেন, তাঁদেরও বিপদ হতে পারে । যেমন, রকেট বাজির একটি ফুলকি এসে পড়ল । বাজি ফাটানোর অভিঘাত । হঠাৎ, একটা বিস্ফোরণ । তাতে হাত-পায়ে জ্বলে যেতে পারে । পুড়ে যেতে পারে । ফোসকা পড়তে পারে । চোখ এবং কানেও আঘাত করতে পারে ।" শরীরের যে কোনও জায়গাতেই আঘাত করতে পারে । এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "যদি পুড়ে যায়, তাহলে পোড়া অংশে জল দেওয়া প্রথম কাজ । একজনের গা-হাত-পা বাজি বা যে কোনও আগুনে পুড়ে গেল, আগে পোড়া অংশে জল দিতে হবে । ঠান্ডা জল । পুড়ে গেলে শরীর থেকে তাপ বের হতে থাকে এমন একটি বিক্রিয়া হয়, এটাকে যদি তাড়াতাড়ি স্থিমিত করতে চাই তাহলে পোড়া অংশে ঠান্ডা জল দিতে হবে । যে জল পোড়া অংশে অনেকখানি উষ্ণতা টেনে নেবে ।"
এই চিকিৎসক বলেন, "চোখে লাগলেও চোখ ভালো করে ধুতে হবে । চোখের ডাক্তারবাবুর কাছে দ্রুত যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে । কানের ক্ষেত্রেও ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিতে হবে ।" তিনি বলেন, "অনেক সময় হাতে করে অনেকে শব্দবাজি ফাটাতে যান ৷ দেখা গেল হাতে বিস্ফোরণ ঘটে গেল । এরকম ক্ষেত্রে হাতের চামড়া, অস্থির সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে । এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঠান্ডা জল দিয়ে লাভ হবে না । অনেকের প্লাস্টিক সার্জারিও প্রয়োজন হয় ।" তিনি বলেন, "আগুনের অভিঘাতে শরীরের যে অংশটি পুড়ল, সেই স্থানের স্কিনের তলার অংশ ডিহাইড্রেটেড হয়ে গেল । এক্ষেত্রে শরীরের জল অনেকখানি বেরিয়ে গেল । বেরিয়ে যাওয়া এই জলকে ফেরানোর উপায় নেই । কিন্তু জলে অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রাখা যেতে পারে । এমন কিছু লাগানো যেতে পারে যাতে জল বেরিয়ে না যায় ।"
তিনি বলেন, "এক্ষেত্রে খুব কমন ঘরোয়া টোটকা বোরোলিন এবং টুথপেস্ট । যে স্থানে ফোসকা পড়েছে সেখানে যদি একটু টুথপেস্ট লাগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে সেটা অনেকটা ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধের কাজ করে । অনেকে খুব সাধারণভাবে চুন ব্যবহার করেন । মনে করেন, যে কোনও ইনজুরিতে চুন দিলে খুব ভালো কাজ । কিন্তু, মনে রাখতে হবে, বাজির আগুন বা এরকম ইনজুরিতে চুন দিলে লাভ হবে না । চুন আরও বেশি হিট জেনারেশন করে । ভুলেও চুন দেওয়া চলবে না । জায়গাটি ভালো করে ধুয়ে নিয়ে, বোরোলিন, ঠান্ডা সেঁক, প্রয়োজনে টুথপেস্ট লাগিয়ে দেওয়া যাবে । এগুলি ময়েশ্চারাইজ়ারের কাজ করে ।"
বাজি ফাটানোর ক্ষেত্রে ছোটোদের আলাদা করে আটকানো যায় না । তাদের অনেকে বাজির শব্দ ভয় পায় ৷ অনেকে বাজি ফাটাতে আগ্রহ বোধ করে । বাচ্চারা হয়ত শব্দবাজি খুব একটা পছন্দ করে না । সাপবাজি, ফুলঝুরি, তাতেও প্রচন্ড পরিমাণে ধোঁয়া হয় । এ কথা জানিয়ে চিকিৎসক কৌশিক চক্রবর্তী বলেন, "মাথায় রাখতে হবে, সাপবাজি, ফুলঝুরি বা রং মশালে জ্বলছে গন্ধক, সালফার, কার্বনের অক্সাইডগুলি । এগুলি আশপাশের বাতাসে ভাসমান কণা হিসাবে অনেক ঘনত্ব অবস্থায় থাকে । এটা ছোটোদের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাচ্ছে । কারণ, বাচ্চাদের উচ্চতা কম । " তিনি বলেন, "আমি হাতে ধরে ফুলঝুরি জ্বালাচ্ছি । আমার বাচ্চাটির হাইট আমার কোমরের কাছে ৷ আমার হাতের সামনে বিস্ফোরণ হলে আমার বুকের কাছে আসবে । কিন্তু, বাচ্চাটির মাথার সামনে যাবে । যদি আপনি একান্তই বাজি পোড়াতে চান, তবে বাজি থেকে বাচ্চাদের একটু দূরে রাখাটাই বাঞ্ছনীয় ৷"