কলকাতা, 15 ফেব্রুয়ারি : গত 6 ফেব্রুয়ারি আসমুদ্র হিমাচলকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছেন সুর-সরস্বতী লতা মঙ্গেশকর ৷ দেশের অন্যান্য প্রান্তের মতো বাংলার সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ এখনও সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেননি ৷ কিন্তু বিধাতা মনে হয় তৈরিই ছিলেন বঙ্গবাসীকে আরও নির্মম আঘাত দেওয়ার জন্য ৷ লতার প্রয়াণের ঠিক 9 দিনের মাথায় 'সন্ধ্যাহীন' হল বাঙালি ৷ যেন সন্ধ্যা-প্রদীপটিই নিভে গেল বাঙালির ঘরের অন্দরের ৷ মঙ্গলবার 90 বছর বয়সে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ (Sandhya Mukhopadhyay passes away) যেন এক আঘাত পর পর্বত সমান আরেক আঘাত বাঙালির কাছে ৷
যে বাঙালি আজও আলোচনা করে কে শ্রেষ্ঠ লতা না সন্ধ্যা, কার গায়কিতে, কণ্ঠে সুরের ফল্গুধারা বয়, সেই বাঙালির কাছে 'গীতশ্রী'র এই চলে যাওয়ার অভিঘাত যে বিপুল তা বলার অপেক্ষা রাখে না ৷ নক্ষত্রপতন বা মহীরূহ পতন, আপনি যাই বলুন এই শূন্যতা ভাষায় প্রকাশ করার নয় ৷ লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজেরাই ছিলেন একাধিক যুগের সমাহার ৷ দশকের পর দশক শ্রোতাদের নিজেদের কণ্ঠের জাদুতে মাতিয়ে রেখেছেন এই দুই সঙ্গীত শিল্পী ৷ লতা না সন্ধ্যা কার চলে যাওয়া বেশি শূন্যতা তৈরি করবে বাঙালির মননে সেই বিতর্ক এখানে বেমানান ৷ এই দুই স্বর্গীয় কণ্ঠীর না থাকা বাঙালি শ্রোতাদের মনে, সংস্কৃতি জগতে আগামী দিনে কী প্রভাব ফেলতে পারে বরং সেটাই বিতর্কের বিষয় হতে পারে ৷
লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম প্রায় একই সময়ে ৷ লতা জন্মেছিলেন 1929 সালে, সন্ধার জন্ম 1931-এ ৷ মাত্র দু'বছরের ফারাক ৷ দু'জনের সঙ্গীত গুরুও এক ৷ নিজেদের সঙ্গীত সফরের শুরুর দিকে লতা ও সন্ধ্যা দুজনেই গান শিখেছিলেন উস্তাদ বড়ে গুলম আলি খানের কাছে ৷ আবার এই দুই কিংবদন্তির সঙ্গীত জীবন শুরুর সময়টাও প্রায় এক বলা চলে ৷ লতা মঙ্গেশকর মাত্র 13 বছর বয়সে প্রথম গান গান মারাঠি ছবি 'কীতি হাসাল'য়ে ৷ আর মাত্র 12 বছর বয়সে আকাশবাণীর 'গল্পদাদুর আসর'-এ প্রথম গান গেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ৷ 13 বছর 10 মাস বয়সে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম বেসিক রেকর্ড ৷ লতার প্রথম উপার্জন ছিল 25 টাকা, সন্ধ্যা রেডিওয় রেকর্ড করে প্রথম পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিলেন 5 টাকা ৷
আরও পড়ুন : কালজয়ী সব গানে আকাশের অস্তরাগে চির অমর গীতশ্রী
লতা সুর সম্রাজ্ঞী হলে সন্ধ্যা হলেন গীতশ্রী ৷ অনেকেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে আধুনিক গানের সুর সম্রাজ্ঞী বলে থাকেন ৷ 1950 সালে মূলত শচীনদেব বর্মনের হাত ধরেই সন্ধ্যার মুম্বই সফর শুরু ৷ যদিও তিনি হিন্দিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন অনিল বিশ্বাসের সুরে 'তারানা' ছবিতে ৷ সেই ছবির সূত্রেই প্রথম আলাপ হয় লতা ও সন্ধ্যার ৷ লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ডুয়েটে গেয়েছিলেন 'তু বোল পাপিহে বোল' এই গানটি ৷ মোট 17টি হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন 'গীতশ্রী' ৷ অনেকেই বলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় যদি মুম্বইতে থেকে যেতেন তাহলে ভারতীয় সঙ্গীত জগত ও তাতে রাজত্বের ইতিহাস অন্য রকম হত ৷
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল সন্ধ্যায় ৷ কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলে দু'জনে একসঙ্গে অনুষ্ঠান করেছেন ৷ লতা ও সন্ধ্যা দুজনেই ভাল বান্ধবী ছিলেন ৷ কলকাতায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আসতেন লতা ৷ সন্ধ্যা মুম্বইতে গেলে লতার বাড়িতে যেতেন, লতাও যেতেন হোটেলে সন্ধ্যার সঙ্গে দেখা করতে ৷ এক বিছনায় বসে তাঁরা দুজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্পও করতেন ৷ একবার তাঁদের মধ্যে রেষারেষির গুঞ্জন শুনে নাকি দুই শিল্পীই হেসে ফেলেছিলেন ৷ লতা নিজেও পরে বলেছেন, তিনি কাউকে হিংসে করতেন না, কারও সঙে তাঁর রেষারেষি ছিল না ৷
গুঞ্জন যাই থাক, ঘটনা হল স্বর্ণযুগের শিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় দুজনেই ৷ দুজনের কণ্ঠ আলাদা, গান গাইলেও দু'জনের কর্মক্ষেত্র ছিল আলাদা ৷ যত দিন গান থাকবে, সুর থাকবে, ভারতীয় সংগীতে সা থেকে সা থাকবে ততদিন থেকে যাবেন সন্ধ্যা ও লতা ৷ শ্রোতার মন আলোড়িত, আন্দলিত হবে গীতশ্রী ও সুর সম্রাজ্ঞীর কণ্ঠে, সুরে ৷