কলকাতা, 22 নভেম্বর : অকারণে ওষুধ দেওয়া হয় সরকারি হাসপাতাল থেকে । তাও আবার, অনেক দিনের জন্য । এদিকে, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ এবং চিকিৎসা-যন্ত্র কেনার জন্য অর্থের অভাব রয়েছে । যার জেরে, কোনও রোগীকে দীর্ঘ সময় ধরে যাতে অকারণে ওষুধ দেওয়া না হয়, তার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । কারণ, ওই অকারণে দেওয়া ওষুধগুলিও কিনতে হয় । ফলে, অর্থের অভাব আরও বৃদ্ধি পায় । এর প্রভাবে আপৎকালীন ওষুধগুলি কেনার বিষয়টিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে । সরকারের বিরোধী কেউ নন, খোদ সরকারি এক নির্দেশেই এমন বলা হয়েছে । জেলাস্তরের এক স্বাস্থ্য আধিকারিক ইশু করেছেন ওই নির্দেশ । আর, এই নির্দেশকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনগুলি প্রশ্ন তুলেছেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে কি তাহলে রোগীদের অকারণে ওষুধ দেওয়া হয়?
সরকারি ওই নির্দেশটি জারি করেছেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক । 19 নভেম্বর এই নির্দেশটি ইশু করা হয়েছে । এই নির্দেশিকাতে বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার অধীনে থাকা ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকদের বলা হয়েছে, ওষুধ এবং চিকিৎসা-যন্ত্র কেনার জন্য অর্থের যে অভাব রয়েছে, সেই বিষয়ে এই ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিকরা অবগত রয়েছেন । এই কারণে, প্রেসক্রিপশনে রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী ওষুধ লিখতে বলা হয়েছে । সেই সঙ্গে রোগীদের জন্য অনেক দিন ধরে অকারণে ওষুধ দেওয়ার বিষয়টি যাতে চলতে না থাকে, তারও উল্লেখ রয়েছে এই সরকারি নির্দেশিকাতে । একই সঙ্গে এই নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে, ওষুধ কেনার জন্য যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন , স্বাস্থ্য ভবনকে অনেকবার তা জানানো হয়েছে । জনস্বার্থে তাঁর এই নির্দেশিকা বলেও জানিয়েছেন বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার ওই সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ।
এই নির্দেশকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনগুলির প্রশ্ন, তাহলে কি সত্যিই অর্থের অভাব রয়েছে? সরকারি হাসপাতালে সত্যিই কোনও রোগীকে অনেক দিনের জন্য অকারণে ওষুধ দেওয়া হয়? এই বিষয়ে কী বলছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয়কুমার চক্রবর্তী? এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলেন, "কোনও সমস্যা নেই, সব ঠিক আছে।"
যদিও, এ রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকদের একটি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটা বলেন, "তার মানে উনি (ওই সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক) ধরেই নিয়েছেন চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লেখেন এবং দিনের পর দিন সেগুলি রোগীদের দেন । এটা ভয়ঙ্কর অভিযোগ । চিকিৎসা উনি সবার থেকে ভালো বোঝেন বোঝা গেল ৷ কিন্তু নিজের বাহিনীর উপর অনাস্থা । উনি যদি এতটা বোঝেন তবে সাহস করে আর একটি চিঠি ওনার উপরের আধিকারিকদের লিখুন যে, "এই মেডিসিনগুলি অপ্রয়োজনীয়, এগুলির সাপ্লাই বন্ধ করা হোক । তাহলেই সমস্যা মিটে যাবে।" একই সঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, "আর কত হাস্যকর বিষয় আমরা দেখব কে জানে । উনি কি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাবেন স্বাস্থ্য দপ্তর এই সব অপ্রয়োজনীয় (ওনার মতে) ওষুধ কিনছে কেন? যাঁরা কিনে দিচ্ছেন, তাঁদের প্রতি ওনার কী বার্তা?"
সরকারি এমন নির্দেশের বিষয়ে বেসরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সম্পাদক কৌশিক চাকি বলেন, "অপ্রয়োজনীয় ওষুধের মানেটা কী, সেটা বুঝতে পারলাম না । সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দুই ধরনের রোগী হয়, অ্যাকিউট এবং ক্রনিক। অ্যাকিউট রোগী মানে সর্দি-কাশি-জ্বর, পেটে ব্যথা, ডায়ারিয়া সহ এমন অসুখ, যেগুলি জন্য সাত বা 10 কিংবা 15 দিনের কোর্সে ওষুধ দেওয়া হয়। ক্রনিক রোগী অর্থাৎ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, মানসিক সমস্যা সহ অন্য নানা অসুখ।" তিনি বলেন, "সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, ইনডোর বা আউটডোরে ফুল কোর্স চিকিৎসার জন্য যা যা ওষুধের প্রয়োজন, তার সব দেওয়া হবে বিনামূল্যে । অর্থাৎ, অ্যাকিউট রোগীর ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাওয়ার সময় তাঁকে সাত, 10, 15 দিনের কোর্স অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হবে । ক্রনিক রোগীর ক্ষেত্রে এক মাসের জন্য ওষুধ দেওয়া হয় । এক মাস পরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার করে আবার তাঁকে ওষুধ দেওয়া হয় ।"
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের সম্পাদক বলেন, "সরকারি এই নির্দেশে টাকা না থাকার কথা বলা হয়েছে । মেলা হচ্ছে, আহারে বাংলা হচ্ছে, ক্লাবকে টাকা দেওয়া হচ্ছে, অথচ ওষুধ কেনার টাকা নেই? এটা বিপজ্জনক । এই নির্দেশে আননেসেসারি ওষুধের কথা বলা হয়েছে । এর মানে কী? তার মানে বলতে চাওয়া হচ্ছে, চিকিৎসকরা এতদিন অপ্রয়োজনে ওষুধ দিচ্ছিলেন? আননেসেসারি ওষুধ না দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে এই নির্দেশে । তা হলে এতদিন যে আননেসেসারি ওষুধ দেওয়া হল, তার অডিট করা হয়েছে? অডিট করে ওই চিকিৎসকদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে? কারও ব্লাড সুগার না থাকলে, তাঁকে ব্লাড সুগারের ওষুধ দেবেন কোনও চিকিৎসক? আননেসেসারি মেডিসিনের কথাটি অবৈজ্ঞানিক । আসলে সব ফ্রি-র কথা বলা হয়েছে । অথচ, টাকা নেই ।" এই নির্দেশের বিষয়ে এ রাজ্যের সরকারি চিকিৎসকদের অন্য একটি সংগঠন সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, চিকিৎসক সজল বিশ্বাস বলেন, "এটা একদম হাস্যকর একটি নির্দেশ । চিকিৎসকরা প্রয়োজন বাদে ওষুধ লেখেন না, লেখার কথাও নয় । তবে, প্রয়োজন বাদে ওষুধ লেখা হচ্ছে কি না, তার জন্য স্ক্রুটিনি হওয়া উচিত । মেডিকেল অডিট হলে দেখা যাবে চিকিৎসকরা প্রয়োজন বাদে ওষুধ লিখছেন কি না ।"
সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক বলেন, "যেটা দরকার, তা কিনতে হবে । এবং, অর্থ বরাদ্দ করতে হবে । অর্থের অভাব যদি হয়, তা হলে অথরিটিকে অর্থ চেয়ে নিতে হবে সরকারের কাছ থেকে ।" সত্যিই কি অর্থের অভাব রয়েছে? স্বাস্থ্য দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, "টাকার অভাব, বিষয়টি এমন নয় । বিষয়টি হল, রোগীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে । এর মধ্যেই সব কিছু করা হচ্ছে । ক্যানসারের কোনও রোগীকে প্রতিমাসে এক লাখ টাকার ওষুধও দেওয়া হয় ।" স্বাস্থ্য দপ্তরের এই আধিকারিক বলেন, "অনাবশ্যক ওষুধ যাতে না লেখা হয়, তার জন্য এই নির্দেশিকার মাধ্যমে চিকিৎসকদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে ।" অনাবশ্যক ওষুধ মানে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানিয়েছেন, অনাবশ্যক ওষুধ, যেমন, অ্যান্টাসিড 40 পয়সায় পাওয়া যায় আবার 10 টাকায়ও পাওয়া যায় । 40 পয়সার অ্যান্টাসিড লেখার অভ্যাস করতে হবে । যদি, 40 পয়সার অ্যান্টাসিডে কাজ না হয় তাহলে 10 টাকার অ্যান্টাসিড লিখতে হবে । অনেক সময় রোগীকে ভিটামিন দেওয়া হয় । ওষুধের মাধ্যমে ভিটামিনের প্রয়োজন নেই । এটা অনাবশ্যক বলে জানান তিনি ।