কলকাতা, 3 নভেম্বর : অন্নপূর্ণা, বাসন্তী, গণেশ-লক্ষ্মী পুজো থেকেই একের পর এক পুজোতে ক্ষতির সম্মুখীন হন কলকাতার কুমোরটুলি পাড়ার মৃৎশিল্পীরা । লকডাউনের মেয়াদ যত বেড়েছে ক্ষতির পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পেয়েছে । এই বছর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিলেন শিল্পীরা । শেষ পর্যন্ত দুর্গাপুজোয় কিছুটা ব্যবসা শুরু হলেও, লক্ষ্মীপুজোয় আবারও ভালোরকম ক্ষতির মুখোমুখি হলেন মৃৎশিল্পীরা । কুমোরটুলির প্রতিটি ঘরেই তৈরি প্রতিমা বেশিরভাগ ঘরেই থেকে যাওয়ায় লক্ষ্মীপুজোয় লক্ষ্মীর দেখা পাননি তাঁরা । তবে এখন চরম ব্যস্ততা কুমোরটুলি পাড়ায় । কারণ, সামনেই কালীপুজো । লক্ষ্মীপুজোয় না হোক, কালীপুজোয় যদি একটু লাভের মুখ দেখা যায় ! সেই আশাতেই দিনরাত প্রতিমা গড়ে চলেছেন শিল্পী ও কর্মচারীরা ।
কোরোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চলা দীর্ঘ সময়ের লকডাউনে পরপর একাধিক পুজোর ব্যবসায় মন্দা গেছে কুমোরটুলিতে । অন্নপূর্ণা, বাসন্তী পুজোয় প্রথমদিকে প্রতিমা তৈরির অর্ডার এলেও লকডাউনের কারণে সেগুলি নিয়ে যাননি অনেকেই । সেই প্রতিমাগুলি তৈরি করতে প্রচুর টাকা ইনভেস্ট করেছিলেন শিল্পীরা । যা শেষ পর্যন্ত আয় হয়নি । জায়গার অভাবে ভেঙে ফেলতে হয় সেই মূর্তিগুলি । একই অবস্থা হয় গণেশ-লক্ষ্মী পুজোতেও । অবশেষে বহু প্রতীক্ষার পর দুর্গাপুজোয় একটু ব্যবসার মুখ দেখতে পান শিল্পীরা । অপেক্ষাকৃত ভালো বিক্রি হয়েছিল বিশ্বকর্মা ও গণেশ পুজোতেও । কিন্তু, লক্ষ্মীপুজো আসতেই আবার ক্ষতির মুখ দেখতে বাধ্য হয় কুমোরটুলি পাড়া ।
কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সংস্কৃতি সমিতির সম্পাদক বাবু পাল বলেন, "দুর্গাপুজোয় কিছুটা রিকভার করা গেলেও লক্ষ্মীপুজো আবার শিল্পীদের শুইয়ে দিয়েছে । প্রত্যেকটা শিল্পীর ঘরে যেভাবে মূর্তি তৈরি হয়েছিল সেভাবে কিন্তু সব মূর্তি বিক্রি করতে পারেননি তাঁরা । বাজার হয়নি বা প্রতি বছর যাঁরা নিয়ে থাকেন প্রতিমা তাঁরা সবাই আসতে পারেননি । তাই অনেক লক্ষ্মী মূর্তি শিল্পীদের ঘরে পড়ে আছে ।"
কুমোরটুলির শিল্পী শ্যামল পাল বলেন, "লক্ষ্মী ঠাকুর আমার অল্প কিছু রয়ে গেছে । কিন্তু, অনেকেরই ক্ষতি হয়েছে। 100টা প্রতিমা করে থাকে 40 থেকে 60টা পড়ে আছে, 30টা করে থাকলে 10-20টা পড়ে আছে। অনেকেই পুজো করেননি এবছর, অনেকেই ট্রেন চলছে না বলে আসতে পারেননি।" আর এক শিল্পী বঙ্কিম পাল বলেন, "লক্ষ্মীপুজোতে এবছর সবথেকে বাজে বাজার গেছে। যত দূরের পার্টি আছে তাঁরা কেউ আসেননি। আমরা যা ঠাকুর করেছিলাম তার 80 শতাংশ পড়ে আছে। কেউ 150টা করেছিল, 30টা বিক্রি হয়েছে, 50টা করলে 20টা বিক্রি হয়েছে।"
সবমিলিয়ে আবারও ক্ষতির সম্মুখীন কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা। তবে, আশা ছাড়েননি এখনও। সামনে কালীপুজো। তাই আশায় রয়েছেন তাঁরা। যদি লড়াইটা আর একটু চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এপ্রসঙ্গে বাবু পাল বলেন, "এখন কালীপুজোর সিজন। প্রতিবছর এই সময় যে হারে বড় মূর্তির জন্য অর্ডার আসে তা কিন্তু আসছে না। সবাই ছোটো মূর্তি চাইছেন। রবিবারে অনেক কাস্টমার এসেছিলেন। 11-12 ফুটের বদলে সবাই 6-8 ফুটের মূর্তি চাইছেন। এক্ষেত্রে যেসব শিল্পী ঘরে 10, 11, 12 ফুটের মূর্তি তৈরি করে ফেলেছিলেন, জানি না সেগুলি যাবে কি না। এখনও সময় আছে, দেখা যাক কী হয়। খুব বেশি লাভ হবে আশা করছি না। কারণ, যেভাবে কোরোনা সংক্রমণ বেড়ে চলেছে তাতে আগামী দিনে কী হবে বলা খুব মুশকিল। এই পরিস্থিতিতে বড় মূর্তির অর্ডার যদি বেশি না আসে বা যে শিল্পীরা বড় মূর্তি তৈরি করে রেখেছেন সেগুলো বিক্রি করতে না পারেন তাহলে কিন্তু তাঁরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। আশাতেই দিন গুনি আমরা। সবটাই তো আমাদের জুয়া খেলা। পুজোর দিন পেরিয়ে গেলে মূর্তিগুলির আর কোনও দাম থাকে না। চেষ্টা করছি। লড়াই করছি। লড়াই করে ব্যবসা করতে পারলে আগামী দিনে ব্যবসা করতে পারব।"
তবে, কালীপুজোর দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও এ বছর বড় প্রতিমা অর্ডার খুবই কম বলে স্বীকার করে নিচ্ছেন কুমোরটুলি পাড়ার মৃৎশিল্পীরা। শিল্পী বঙ্কিম পাল বলেন, "কালীপুজোতে কাস্টমার ঢুকছে। তবে, 6-7 ফুটের বেশি কালী কেউ অর্ডার করছেন না। সবাই পুজো করছে কিন্তু ছোটো করে। রবিবার অনেক ক্রেতা এসেছিলেন। আবার মনে হচ্ছিল কুমোরটুলি ছন্দে ফিরছে। দেখে আনন্দ লাগল। আশা করি, ভালো বাজার যাবে।" শ্যামল পাল বলেন, "মা কালীর আশায় তো আছি এখন। তবে, মা কালী আশা দেবে না নিরাশা তা এখনই বলতে পারছি না।"