কলকাতা, 20 অগাস্ট : উদ্যোগ অভিনব । দেশের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন ভাবনা আগে ভেবেছে বলে মনে হয় না । কোরোনা পরিস্থিতির মধ্যে স্মার্ট ফোন না থাকায় অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের বহু ছাত্র-ছাত্রী । আবার লকডাউনে রোজগার কমে যাওয়ায় ছেলে মেয়েদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে অনেক অভিভাবককে । কাউকে বিক্রি করতে হচ্ছে গৃহপালিত পশু । কেউ বিক্রি করছেন জমি । আত্মহত্যার ঘটনাও সামনে এসেছে । সেই সূত্রেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের জন্য রাখা হয়েছিল মানবিক আবেদন । বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস রাজ্যের বিভিন্ন বণিকসভা, প্রাক্তন পড়ুয়া, অধ্যাপকদের কাছে আবেদন রেখেছিলেন পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের হাতে স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট কানেকশন তুলে দেওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তার । যে কেউ সেই আর্থিক সহায়তা করতে পারেন । তবে সেই আবেদনে এখনও পর্যন্ত তেমন সাড়া মেলেনি বলেই জানাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা একদিনের বেতন অবশ্য দান করছেন । তবে ওইটুকুই । বাইরের কোনও আর্থিক সাহায্য আসেনি এখনও পর্যন্ত । ফলে প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ জোগাড় হয়েছে সামান্যই ।
ঘটনা 1 : রাজস্থানের বারমের । জওহর নবোদয় বিদ্যালয়ের এক পড়ুয়াকে রোজ পাহাড়ে চড়তে হয় । তার বাড়ি পাঁচ পাদরা গ্রামে । বছর বারোর ওই কিশোরের নাম হরিশ । গ্রামে ইন্টারনেট সংযোগ নেই । ইন্টারনেট পেতে তাকে উঠতে হয় পাহাড়ে । রোজ সকাল আটটায় সে পাহাড়ে ওঠে অনলাইন ক্লাস করার জন্য । নেমে আসে দুপুর দুটোয় । সেই ঘটনার কথা সামনে আনেন প্রাক্তন ক্রিকেটার বীরেন্দ্র সেহওয়াগ । তিনি হরিশের ছবিও শেয়ার করেন টুইটারে । সেই ঘটনায় রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় ।
ঘটনা 2 : হিমাচল প্রদেশের কাংরা জেলার গুমরগ্রাম । সেখানে কুলদীপ কুমারের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা । গরুর দুধ বিক্রি করে পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেন তিনি । সঙ্গে আছে দু'চোখ ভরা স্বপ্ন । দুই ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে অনেক বড়মানুষ করে তোলার বাসনা । লকডাউন পরিস্থিতি তাকে এনে দাঁড় করায় এক চরম বাস্তবতায় । স্মার্টফোনের অভাবে তাঁর দুই ছেলের অনলাইন ক্লাস বন্ধ । এক ছেলে পরে দ্বিতীয় শ্রেণীতে, অন্য ছেলে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র । তাদের ক্লাস যে কোনও মূল্যেই করাতে চেয়েছিলেন কুলদীপ । তাই সিদ্ধান্ত নেন, যে গরুর দুধ তাঁকে দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন জোগায়, সেটি বিক্রি করে দেবেন । যেমন ভাবা তেমন কাজ । মহাজনের কাছে দুধের গরু 6000 টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেন তিনি । সেই টাকায় স্মার্টফোন তো এসেছে । কিন্তু আগামীদিনের সংসার চলবে কি করে? প্রশ্নটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে পাহাড়ি জনপদের বাসিন্ধা কুলদীপকে ।
ঘটনা 3: তামিলনাড়ুর কুড্ডালো জেলার পানরুটি শহর । সেখানে থাকেন বিজয় কুমার । তিনি কাজু চাষ করে সংসার চালান । তার একমাত্র ছেলে এবার দশম শ্রেণীতে পা রেখেছে । অনলাইন চাষের জন্য সেই ছেলে চেয়েছিল স্মার্টফোন । কিনে দিতে পারেননি বিজয় । বলেছিলেন, কাজু বিক্রি করে হাতে টাকা এলে কিনে দেবেন । ঘটনার জেরে হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ওই কিশোর ।
এই ঘটনাগুলি থেকেই শিক্ষা নেয় যাদবপুর । ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষক সংগঠনের তরফে উপাচার্যর কাছে যায় আবেদন । সেখানে রীতিমতো তথ্য দিয়ে বলা হয়, দেশজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের অনেকেই আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়েছে । তাদের হাতে স্মার্টফোন নেই । অনেক এলাকাতে ইন্টারনেট সংযোগ নেই । অনেকে আবার ইন্টারনেট রিচার্জ করতে পারছেন না টাকার অভাবে । পিছিয়ে পড়া ছাত্ররা যাতে কোনওভাবেই অনলাইনে ক্লাস থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করার আবেদন জানানো হয়েছিল উপাচার্যের কাছে । কারণ ছাত্র সংসদ চায়নি, কোনওভাবেই তামিলনাড়ু, রাজস্থান কিংবা হিমাচল প্রদেশের মতো ঘটনা ঘটুক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পড়ুয়ার সঙ্গে ।
আরও পড়ুন : যাদবপুরের পড়ুয়াদের স্মার্টফোন দিতে শিক্ষকদের একদিনের বেতন দেওয়ার আবেদন উপাচার্যের
এ প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি সৌম্যদীপ পাল বলেন, "আমরা দেশের অনেক জায়গাতেই দেখতে পাচ্ছি অনলাইন ক্লাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের ঘটনা । আমার বাড়ি বাঁকুড়ায় । জয়পুর গ্রামে থাকি । আমার ইন্টারনেটের সমস্যা আছে । আমি অনেক ছাত্রছাত্রীকে জানি যাদের স্মার্টফোন নেই । তাহলে তারা অনলাইনে ক্লাস করবে কোথা থেকে? সেই কারণেই ছাত্র সংসদের তরফ থেকে উপাচার্যের কাছে কোনও একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আবেদন জানানো হয়েছিল ।"
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরাম ফর আর্টস স্টুডেন্টের আকাশ যশ বলছিলেন, "হিমাচল প্রদেশের গরু বিক্রি করার ঘটনা আমরা দেখেছি । আমরা দেখেছি কিশোরের আত্মহত্যা । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও পড়ুয়ার সঙ্গে এমনটা হবে না তো? সেই ভয়টাই পেয়েছিলাম আমরা । চেয়েছিলাম আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়ার জন্য কোনও ছাত্র যাতে অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে । আর সেই কারণেই উপাচার্যের কাছে আবেদন জানানো ।"
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরাম ফর আর্টস স্টুডেন্টের আকাশ যশ বলছিলেন, “ হিমাচল প্রদেশের গরু বিক্রি করার ঘটনা আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি কিশোরের আত্মহত্যা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বড়ুয়ার সঙ্গে এমনটা হবে না তো? সেই ভয় টাই পেয়েছিলাম আমরা। চেয়েছিলাম আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়ার জন্য কোনও ছাত্র যাতে অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করতে চেয়েছি। আর সেই কারণেই উপাচার্যের কাছে আবেদন জানানো।"
সেই আবেদনের সূত্র ধরেই ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ নেয় পরিকল্পনা । পড়ুয়াদের দুই স্তরে ভাগ করা হয় । একটি দল যাদের হাতে স্মার্টফোন নেই । অন্য দলে রাখা হয়েছে স্মার্টফোন থাকলেও যাদের হাইস্পিড ইন্টারনেট নেই । ঠিক করা হয় এই দুই স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রয়োজন মেটানো হবে । সবমিলিয়ে এখনও পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কাছে যা হিসেব তাতে 40 লাখ টাকা প্রয়োজন । কিন্তু সেই তহবিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে নেই। সেই কারণেই উপাচার্য সুরঞ্জন দাস আবেদন রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, বণিকসভা, অধ্যাপক এবং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজনের কাছে। কিন্তু সেই আবেদনে এখনও পর্যন্ত বাইরে থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু বলেন, "অধ্যাপকরা বেতনের একদিন করে দান করছেন । তাতে কত টাকা হয়েছে সেই হিসেব এখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি । কিন্তু আমি এখনও পর্যন্ত প্রাক্তনী কিংবা অন্য কারও কাছ থেকে কোনও সাহায্য এসেছে বলে শুনিনি । তেমন কোন ই-মেইল এখনও পর্যন্ত পাইনি ।"
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া তথা ছাত্রসংসদের প্রতিনিধি সৌম্যদীপ বলেন, "আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম সেরা । বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র-ছাত্রীরা । তারা থাকতে শুধুমাত্র স্মার্টফোনের জন্য একদল পড়ুয়া ক্লাস করতে পারবেন না, ভাবতেই কেমন লাগছে । কিন্তু এখনও পর্যন্ত উদ্যোগ চোখে পড়েনি । আমি প্রত্যেকের কাছে আবেদন জানাব, আর্থিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য ।"
ফোরাম ফর আর্টস স্টুডেন্টের আকাশ যশ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য প্রাক্তন । তার আবেদন, "রাজ্য এবং দেশের সব শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের কাছে আবেদন করছি, উপাচার্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসুন।"