কলকাতা, 17 অগস্ট: প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের শেষ সময়ে বামফ্রন্টের বদলে উন্নততর বামফ্রন্ট-তত্ত্ব নিয়ে চর্চা হয়েছিল জোরদার । শহরের মধ্যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Abhishek Banerjee) ছবি দিয়ে যে 'নতুন তৃণমূল'-এর (New TMC Poster) তত্ত্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নিয়েও কিন্তু কম চর্চা হচ্ছে না । বিগত কয়েকদিন পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee) এবং অনুব্রত মণ্ডলকে (Anubrata Mondal) কেন্দ্র করে যেভাবে দলের ভাবমূর্তি তলানিতে এসে ঠেকেছে, একদিকে তা যেমন ভাবমূর্তি উদ্ধারের প্রয়াস, অন্যদিকে এর মধ্যেই সুপ্ত হলেও রাজনৈতিক মহল দেখতে পাচ্ছে কালীঘাট বনাম ক্যামাক স্ট্রিটের বিভাজনের আড়াআড়ি ছবি ।
2016 সালে বিধানসভা নির্বাচনের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) শপথের ঘটনা যাদের মনে আছে, সে সময়ও একটি পোস্টার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দিন বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছিল । কী ছিল সেই পোস্টারে ? অভিষেকের ছবি দিয়ে সেখানে লেখা হয়েছিল 'ম্যাচ উইনার'। তারপরেই বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় । শোনা যায়, শেষ পর্যন্ত এই বিতর্কের কারণে নাকি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এড়িয়ে গিয়েছিলেন অভিষেক । এমনও শোনা যায় দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে সময় সেই পোস্টার বিতর্ককে ভালোভাবে নেননি ।
একইভাবে কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি এক পদ নিয়ে যুব নেতাদের একাংশের সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার ভাইরাল হয়েছিল । সে সময়ও কালীঘাট এবং ক্যামাক স্ট্রিটের মধ্যে বিভাজন প্রকাশ্যে এসেছিল । যদিও এ সবের কোনও কিছুর মধ্যেই কখনওই প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায়নি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে । কিন্তু তিনি বরাবরই না থেকেও থেকেছেন বিতর্কে ।
গতকাল থেকে নতুন তৃণমূলকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তাতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ অতীতের সঙ্গে এর যোগ খুঁজে পাচ্ছেন । রাজনৈতিক দলগুলি আবার কেউ কেউ একে দখলদারির প্রয়াস হিসাবে দেখছে । কিন্তু ঘটনা যাই ঘটুক, দলের অন্দরে আরও একবার ক্যামাক স্ট্রিট বনাম কালীঘাটের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে । তৃণমূল নেতাদের একাংশ এমনটাও বলছেন, এই মুহূর্তে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় চাইছেন দুর্নীতিমুক্ত দল । এ ক্ষেত্রে যাঁরা দুর্নীতি করবেন দল তাঁদের পাশে থাকবে না । কিন্তু তৃণমূল সুপ্রিমো প্রাক-স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বেহালায় গিয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন, অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও তাঁর পাশে তিনি রয়েছেন । শুধু তিনি রয়েছেন তাই নয়, তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দলকে আন্দোলনমুখী হওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি । আর এখানেই যত দ্বন্দ্ব ।
আরও পড়ুন: খেলা হবে দিবস নিয়ে রাজনৈতিক তরজা, বিজেপি ও তৃণমূল জমি ছাড়ছে না কেউ
এখন প্রশ্ন উঠছে ঠিক যেভাবে এক ব্যক্তি এক পদ নিয়ে পেছনে থেকেও যুবদের একাংশের মাধ্যমে নিজের মতকে তুলে ধরা হয়েছিল । এখানেও কী তাই হয়েছে ! অভিষেকের সংস্কারপন্থী ভাবনাচিন্তা নিয়ে জনমত গড়ে তুলতেই কী এই পোস্টার ! নাকি অতি উৎসাহী তৃণমূল কর্মীদের কথা বলে এটা দলনেত্রীর উপর চাপ তৈরি করার একটা কৌশল !
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায় স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, "এর মধ্যে দলনেত্রীর উপর চাপ তৈরির একটা কৌশল রয়েছে । তবে আমাদের যে বক্তব্য সবটাই অনুমানের সাপেক্ষে । অতীতের ঘটনাবলী এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি - তার উপর ভিত্তি করেই এই অনুমান ।" তিনি এও বলেছেন, এই যে পোস্টার বিতর্ক, এর মধ্যে আগামী দিনে তৃণমূল আড়াআড়ি বিভাজিত হওয়ার একটা ইঙ্গিত দেখছেন তিনি ।
শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নন, রাজনৈতিক দলগুলিও এর মধ্যে দখলদারির ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছে । এই প্রচেষ্টার মধ্যে কোথাও যেন তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে অভিষেকের ছায়া দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রয়াস দেখছেন তাঁরা । আর সে কারণেই সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী এই ঘটনায় কটাক্ষের সুরে বলেছেন, গ্রামে পোস্টার পড়ে, নতুন যাত্রা-পার্টি আসছে, একইভাবে এখানেও জানান দেওয়া হচ্ছে অভিষেক আসছে । নতুন বোতলে পুরনো মদ । তৃণমূলের নীতির কোনও পরিবর্তন হতে পারে ? লুঠেরার পার্টি । আসলে এখানে প্রতিযোগিতা চলছে পিসির কন্ট্রোল বেশি হবে, না ভাইপোর ?
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী আবার এই উদ্যোগকে দখলের প্রয়াস হিসাবে দেখছেন । তিনি বলেন, "দিদির দলের মধ্যে সংস্কারক সেজে নতুন তৃণমূলের স্বপ্ন দেখিয়ে দিদির জায়গা দখলের চেষ্টা হচ্ছে । কিন্তু আজো আমি মনে করি চোর হোক, জোচ্চোর হোক, ভালো হোক, মন্দ হোক - আইকন যদি কেউ থাকেন তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । সেখানে কেউ সংস্কারক সেজে কোনও সুবিধা করতে পারবেন না । দল যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে সংস্কার করে দলের হাল ফেরানো যাবে না ।"
একইভাবে বিজেপি নেতা তথা দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, "এতদিন যে তৃণমূলকে আমরা দেখে এসেছি, তা দুর্নীতির পাকে একদম ডুবে গিয়েছে । সেই দুর্নীতির আঁচ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে । তাই সেই ভাবমূর্তিকে মুছে পোস্টার দিয়ে হোর্ডিং দিয়ে তৃণমূলকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে । মানুষ বুঝে গিয়েছে তৃণমূলের আসল চেহারা কী । সব নেতার কাছেই এখন চিঠি যাচ্ছে, সবাইকে সিবিআই ডাকছে । সে কারণেই মানুষকে বোকা বানানোর একটা ফন্দি তৈরি করা হচ্ছে । তবে আমার মনে হয় না বাংলার মানুষ আবার তৃণমূলের দিকে ঘুরে তাকাবে ।"