কলকাতা, 21 ফেব্রুয়ারি : ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলতে পারি ৷’’
বাঙালির মননে একুশে ফেব্রুয়ারির গুরুত্বই আলাদা । বছরভর ইংরেজির পেছনে ছুটলেও এই একটা দিনে বাঙালি তার নিজের মাতৃভাষাকে কত ভালবাসে, তা দেখানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে । পাড়ায় পাড়ায় উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস (International Mother Language Day 2022) ৷
বক্তৃতায় এবং গানে কে কত বড় বাঙালি, তা দেখানোর যেন চলে বিরাট প্রতিযোগিতা । কিন্তু আজ যারা দল বেঁধে একুশের উদযাপন করেন, তার একটা বড় অংশই ছেলেমেয়েকে পড়ানোর বেলায় ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বেছে নেন । ব্যাংকে, অফিসে, কলেজে, ইংরেজির দাপটে পিছনের সারিতে চলে যাওয়া মাতৃভাষার জন্য নিজেদের মনের মধ্যে প্রতিবাদ বোধটুকু হয় না । আর এই সব নিয়েই ফিরে দেখা বছরভর মাতৃভাষাকে অবহেলা আর একটি দিনে মাতৃভাষার জন্য চোখের জল সত্যিই মাতৃভাষাকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে সফল (is bengali language falling behind other languages in the battle for survival ?) !
প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যমের জন্য ঠিক যতটা, ততটাই ব্যক্তি মানুষের জন্যও । এই নিয়ে কী বলছেন বিশেষজ্ঞেরা !
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার অনুরাগী । তারা এই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন । এমনকি সরকারি কাজকর্ম থেকে সর্বত্রই মিশ্র বাংলা ভাষা নয় বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় ব্যবহার করেন । তাই ভাষা চর্চার জন্য কাউকে যদি মর্যাদা বা সাফল্য দিতে হয়, তা বাংলাদেশকেই দেওয়া উচিত ।’’
আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘‘আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বছরভর বাংলা ছেড়ে ইংরেজি বা অন্য মিশ্র ভাষাতেই কথা বলতে পছন্দ করি । একটা দিন ঘটা করে ভাষা দিবস পালন করে বাংলা ভাষা কত মহান তা দেখানোর চেষ্টা করি । এটাকে ভন্ডামি বলেই মনে করি আমি । আমি বিশ্বাস করি একটা সময় আসবে যখন মাতৃভাষার গুরুত্ব আমাদের দেশ তথা রাজ্যের মানুষ বুঝতে পারবেন । তখনই প্রকৃত ভাষা দিবস উদযাপন সার্থক হবে ।’’
সময় বদলেছে, সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা থেকে সিনেমার ভাষা - সব কিছুতেই বদল এসেছে । বিনোদনী দুনিয়ার ইঁদুর দৌড়ে হিন্দি বা দক্ষিণ ভারতের ভাষার কাছে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে বাংলা । অভিনেত্রী সোহিনী সরকারের কথায়, ‘‘আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে নিজের শিকড় থেকে দূরে সরে এসেছি । শিকড় থেকে সরে আসা মানে প্রত্যেকদিন শাড়ি পরা বা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা নয় । অন্য সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে গিয়ে নিজের সংস্কৃতি ক্রমেই উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে ।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমি সারা পৃথিবী ঘুরতেই পারি, একাধিক ভাষার চর্চা, সংস্কৃতির স্বাদ নিতে পারি । কিন্তু নিজের মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা আর যাই হোক আমাদের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না ।’’
একই মত তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী মানস রঞ্জন ভুঁইয়ার । তিনি বলেন, ‘‘আমরা যতই একুশে ফেব্রুয়ারি ঘটা করে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বাড়ানোর কথা বলি না কেন, সেই আমরাই আমাদের ছেলেমেয়েকে ইংরেজি স্কুলে না পাঠালে নিজেদের মনের মধ্যে হীনমন্যতায় ভুগি । যখন ওই স্কুলে গিয়ে ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে কথা না বলতে পারার জন্য শাস্তির মুখে পড়ে, তার প্রতিবাদ করি না । ঠিক এই কারণেই আজকের ছেলেমেয়েরা অনেকেই বাংলা বলতে পারে না । এভাবে আর যাই হোক বাংলা ভাষার সঠিক মর্যাদা দেওয়া সম্ভব নয় । বাংলা ভাষাকে বাস্তবিক সম্মান দিতে গেলে তাকে অন্তর থেকে গ্রহণ করতে হবে ।’’
তাঁর আরও দাবি, ‘‘আর এই কাজ সরকারের পক্ষে একা করা সম্ভব নয় । বর্তমান তৃণমূল সরকার চেষ্টা করেছিল বাংলার যে কোনও স্কুলে অন্য ভাষার চর্চা হলেও তার সঙ্গে মাতৃভাষা চর্চা বাধ্যতামূলক করতে । কিন্তু রাজ্যের সুশীল সমাজের একটা অংশ এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল । তাই প্রশাসনিক পদক্ষেপ থেকেও বেশি দরকার মানসিকভাবে আমাদের প্রস্তুতি । রাজনৈতিক নেতা হিসাবে নয়, একজন সাধারণ বাঙালি হিসেবে আমাদের কী করণীয়, সেই সিদ্ধান্ত আমাদেরই নেওয়া উচিত ।’’
আরও পড়ুন : International Mother Language Day 2022 : আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...