বউবাজার (কলকাতা), 16 মে : বউবাজারের দুর্গাপিতুরি লেন, স্যাঁকরা পাড়া লেন ৷ আদি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী এবং জমজমাট এলাকা ৷ কিন্তু, সেই পাড়াগুলিই আজ জনশূন্য (Empty Houses in Bowbazar Due to Metro Incident) ৷ ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজের জন্য ধস ও ফাটলের জেরে 12টি বাড়ি আজ বিলীন হয়ে গিয়েছে (Bowbazar Metro Incident) ৷ কলকাতা মেট্রোরেল কর্পোরেশন লিমিটেড (KMRCL) এর পক্ষ থেকে প্রথমে যেই রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছিল সেটিকে পরে পরিবর্তন করা কি ঠিক হয়েছে ? দুরদর্শিতার অভাবেই কি এই বিপত্তি (Reasons to blame for Bowbazar Metro Disaster) ?
2019 সালের পর আবারও বুধবার মেট্রোর কাজ চলাকালীন মাটির তলা থেকে সুড়ঙ্গে জল প্রবেশ করতে থাকে । আঙুল উঠছে কলকাতা মেট্রো রেলের ঠিকাদারি সংস্থা কেএমআরসিএল-এর দিকে । স্থানীয় বাসিন্দারা বারবার দায়ী করছেন সংস্থার দূরদর্শিতা ও দ্বায়িত্বের অভাবকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, 2008 সালে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইস্ট-ওয়েস্ট করিডর সল্টলেক থেকে সেক্টর ফাইভ হয়ে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত চালানোর রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছিল ৷ কেএমআরসিএল এবং বাকি ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শে পরে তা পরিবর্তন করা না-হলে হয়তো বউবাজারের বাসিন্দাদের আজ এই অবস্থায় পড়তে হত না ।
রাধারমণ মিত্র, হরিপ্রসাদ দে, শ্রীপান্থ-সহ আরও যারা পুরনো কলকাতার ইতিবৃত্ত নিয়ে বই লিখেছেন, তাঁদের বইগুলি ঘেঁটে দেখলে দেখা যাবে যে ওয়েলিংটন, বউবাজার সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, ধর্মতলা, বৈঠকখানা রোড-সহ ওই অঞ্চল জুড়ে বিদ্যাধরী নদীর অববাহিকা ছিল । এরপর নগরপত্তন ও নগর বৃদ্ধির জন্য এই অঞ্চলের খাল, বিল ও খাঁড়ি বুজিয়ে দিয়ে তার উপর তৈরি হয়েছে রাস্তাঘাট ও বাড়ি ।
কলকাতা ও হাওড়া বিশেষজ্ঞ সৌভিক মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আসলে বউবাজার অঞ্চলের মত এত পুরনো অঞ্চলে এই ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কাজ শুরু করার আগে শুধু সেই অঞ্চলের ভূগোলই নয়, ইতিহাসও ঘেঁটে দেখার প্রয়োজন ছিল । নকশা পরিবর্তন হওয়ার পরেও যে মাটি পরীক্ষা সঠিকভাবে হয়নি, তাও স্পষ্ট । ওই অঞ্চলে যে রাস্তাটি ক্রিক রোড নামে পরিচিত সেটি একটি খাঁড়ি অঞ্চল ছিল । আজও সেই ইতিহাস বহন করছে রাস্তাটির বর্তমান নাম । ওই সময় হেস্টিংস স্ট্রিট বা কিরণশঙ্কর রায় রোড থেকে একটি খাঁড়ি বেরিয়েছিল, সেটি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিল বিভিন্ন দিকে । বউবাজার অঞ্চলের যতগুলি খাল ও খাঁড়ি ছিল, সব গিয়ে মিশেছিল বিদ্যাধরী নদীতে । এমনকি ওই অঞ্চলে একটি রাস্তা রয়েছে, যার নাম হল ডাঙা ভাঙা লেন । 1730 সালে একটি ভয়াবহ ঝড় হয় । সেই ঝড়ের জেরে প্রচুর নৌকা, বজরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় । সেগুলি ভেঙে গিয়ে ওই জায়গায় আটকে পরে । তাই আজও সেই রাস্তার নাম ডাঙা ভাঙা লেন । এমনকী মৌলালির পেছন দিকে একটি রাস্তা রয়েছে, যার বর্তমান নাম ক্যানেল রোড । এই ক্যানেলের আজ আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট না থাকলেও তার কিছুটা দেখা যায় বেলেঘাটায় । এই সবই হচ্ছে বিদ্যাধরী নদীর অববাহিকা । সারা কলকাতায় এমন অজস্র খাল-বিল রয়েছে ।’’
পরিবেশবিদ সৌমেন্দ্রমোহন ঘোষ বলেন, ‘‘কলকাতা, বিশেষ করে ওই অঞ্চলের মাটির নিচে আজও সেই অববাহিকাগুলির অস্তিত্ব রয়ে গিয়েছে । বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে ‘Palaeochannel (পালিওচ্যানেল)’ ৷ স্বাভাবিকভাবেই ভূপৃষ্ঠ কেটে অনেকটা ভেতরে প্রবেশ করে খনন কাজ করার সময় যখন জল প্রবেশ করেছে, তারসঙ্গে পলি মাটি, নুড়িপাথর ও বালিও প্রবেশ করেছিল । তাই এখানে যে আবারও কাজের অগ্রগতির সময় কোনও বিপত্তি ঘটবে না, তেমনটা বলা যায় না । যেহেতু এই জায়গাটি এতটাই প্রাচীন এবং এই অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠের নিচের মাটি এতটাই হালকা যে মাটির উপরের সবচেয়ে বিপদজনক বাড়িগুলি ভেঙে ফেলে তবেই আবার কাজের অগ্রগতি করা উচিত হবে ।’’
আরও পড়ুন : নগরোন্নয়নের ধাক্কা ! মেট্রোর কাজের জেরে অবলুপ্তির পথে আস্ত একটা পাড়া
তবে এই বিষয়ে কেএমআরসিএল-এর ডিরেক্টর (প্রজেক্ট) এন সি কার্মালি বলেন, ‘‘এই ধরনের কাজ করার সময় যা সয়েল টেস্টিং করতে হয় তা হয়েছিল । এবং স্ট্যান্ডার্ড প্রোটোকল মেনেই তা করা হয়েছিল । তবে এই অঞ্চলে যে কোনও একসময় খাঁড়ি বা খাল ছিল বা তার অস্তিত্ব এখনও থাকতে পারে তা আমাদের অজানা ছিল । তবে এটা ঠিক যে সয়েল টেস্টের সময় মাটির নিচে পলি, বালি ও কাদামাটির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে ।’’