কলকাতা, 14 মে : বউবাজারে এখন গেল গেল রব । এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না । নাকি এমনটাই হওয়ার কথা ছিল !
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর যে কাজ অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে । শুধু তাই নয় 2019 এই কাজের জন্য পর পর পাঁচটি বাড়ি ধসে যায় । ঠিক 2 বছর 9 মাসের মধ্যেই ওই একই জায়গায় আবারও পাঁচটি বাড়িতে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে । শুধু বাড়িগুলোতেই নয় ফাটল দেখা দিয়েছে রাস্তায়ও । আজ এই কাজের জন্য বিপর্যস্ত এলাকার বহু মানুষ । রাতারাতি ভিটে বাড়ি ছাড়া অনেক মানুষ । এর ফলে উঠছে একাধিক প্রশ্ন । আঙুল উঠছে কলকাতা মেট্রো রেলের ঠিকাদারি সংস্থা (KMRCL)-এর দিকে (East-West metro route realignment problem)।
স্থানীয় বাসিন্দারা বারে বারে অভিযোগ করছে সংস্থার দূরদর্শিতা ও দ্বায়িত্বে অভাবকে । তাহলে সমস্যাটা কি? দায় কার? এমনটা হয়তো হওয়ারই কথা ছিল । অন্তত এমনটাই আঁচ করতে পেরেছিল তৎকালীন কেএমআরসিএল ইঞ্জিনিয়াররা । এই পথে যে কাঁটা আসবে সেই কথা বারে বারে জানিয়ে চিঠি চালাচালি হয় রাজ্য ও কেএমআরসিএল-এর মধ্যে । কারণ কলকাতা ও হাওড়া এই দুই শহরকে যোগ করার যে রুট বা রোডম্যাপ দেওয়া হয়েছিল কেএমআরসিএল-এর পক্ষ থেকে, সেই রুট পরিবর্তন করা হয় পরবর্তীতে (Bowbazar Metro Incident) ৷
আরও পড়ুন : Bowbazar Metro Incident : নগরোন্নয়নের ধাক্কা ! মেট্রোর কাজের জেরে অবলুপ্তির পথে আস্ত একটা পাড়া
2008 সালে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত মেট্রো চলাচলের অনুমোদন মেলে । পুরনো রোড ম্যাপ মেনেই কাজের অগ্রগতি পরিকল্পনা শুরু হয় । এরপর 2011 সালে বাংলায় রাজ্যে সরকার বদল হওয়ার পর । নতুন রুটের প্রস্তাব করে মমতা বন্দোপাধ্যায় সরকার । জানা গিয়েছে, পুরনো রুটের জমি চাষের সমস্যা-সহ ব্যবসায়ীদের ক্ষতি দেখিয়ে নতুন প্রস্তাব তৎকালীন পরিবহন সচিব বিপি গোপালিকা কেন্দ্রকে চিঠি পাঠান । বলা হয়, পুরনো রুটে এসপ্ল্যানেডের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নেই । নতুন রুট মাফিক নির্মাণ হলে যাত্রী সংখ্যাও যেমন বাড়বে তেমনই ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে না। তবে নতুন রুট অনুযায়ী নির্মাণ কাজ করতে হলে যেমন সময় লাগবে, তেমনই অনেক বেশি খরচা হবে এবং এর ফলে 'ল্যান্ড ক্রেভিং'-এর সমস্যা দেখা দিতে পারে ৷ এমনটা তৎকালীন এমআরসিএল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল ।
সম্প্রতি আবার ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো কাজের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের পুনরায় উদ্বাস্তুর মতো অবস্থা হল ৷ তা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ জানান প্রদেশ কংগ্রেস সাংসদ অধীররঞ্জন চৌধুরী । তিনি বলেন, "রুট পরিবর্তন করার বিষয়টি অবশ্যই এই বিপত্তির জন্য দায়ী । আমি ইতিমধ্যেই রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে চিঠি দিয়েছি । তাঁকে অনুরোধ করেছি, তিনি যেন একবার এসে জায়গাটি পরিদর্শন করেন । পুরনো রোডম্যাপ যেটা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ক্ষমতায় আসেন তখন রেল মন্ত্রকের সঙ্গে একরকম ঝগড়া করেই নতুন রুটের অনুমোদন করিয়ে নেন । এখন যেই পথ ধরে কাজ এগোচ্ছে সেটা একটা অত্যন্ত জনবহুল ও পুরনো অঞ্চল । আবার যাতে এই ধরনের ঘটনা না ঘটে এবং এবার যাতে নির্ঝঞ্ঝাটে পুরো কাজটা শেষ করা যায় সেটা রাজ্যকেই ভাবতে হবে । পুরনো রোডম্যাপেই যদি কাজ হত, তাহলে এই সমস্যা হত না। প্রথমে যে রোডম্যাপটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা তো তখনকার ইঞ্জিনিয়াররা অনেক বুঝে শুনেই তৈরি করেছিলেন এবং হঠাৎ করে এই রুট পরিবর্তনের জন্য এখন মানুষকে ভুগতে হচ্ছে ।"
আরও পড়ুন : Bowbazar House Crack : মেট্রোর কাজে বাড়িতে ফাটল, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তায় ভিটে ছাড়ছেন স্থানীয়রা
বিজেপির সর্বভারতীয় সহ–সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, "আড়াই বছর আগেও ধস নেবে বাড়ি ভেঙে পড়েছিল ৷ সম্প্রতি আবার সেই ঘটনা ঘটল । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের দলের রাজনৈতিক লাভের জন্য মূল নকশাকে পরিবর্তন করিয়েছিলেন । হয়ত একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলেন । তারপর হয়ত ঠিক করে মাটি পরিক্ষা হয়নি । দুর্ঘটনা তো ঘটেই থাকে তবে এই যে এইখানকার মানুষগুলো এখন রাতে আতঙ্কে ঘুমোতে পারছে না, বাড়ি ছেড়ে হোটেলে গিয়ে উঠতে হয়েছে, এর জন্য দায়ী কে ? রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এবং কিছু চিন্তা ভাবনা না করে এই ধরনের কাজ করা উচিত হয়নি ।"
এই বিষয় ডিরেক্টর এন সি কার্মালি যিনি কেএমআরসিএল-এর সঙ্গে অনেক আগে থেকেই যুক্ত থাকলেও তিনি ছিলেন অন্য কাজের দায়িত্বে । সম্প্রতি তাঁকে এই টানেলিং-এর কাজের দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছে । তাই তিনি জানিয়েছেন যে রুট পরিবর্তন (Route Realignment) সম্বন্ধে তিনি অবগত নন । তিনি বলেন, "আমরা ঠিকাদারি সংস্থা । আমাদের যে কাজটি দেওয়া হয়েছে, সেটাই আমরা করছি । তবে এইখানে কাজ করার আগে সব ধরনের জিওটেকনিক্যাল টেস্টিং হয়েছে এবং সেই মত মেশিনও আনা হয়েছিল । ট্যানেল বোরিং মেশিনগুলো (TBM) সেই ধরনেরই ছিল । 2019 সালের আগে পর্যন্ত কাজ ঠিকঠাকই এগোচ্ছিল । আবার সম্প্রতি এই ঘটনা ঘটল । যাতে আর কোনও বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেই দিকগুলি দেখা হচ্ছে ।"
আরও পড়ুন : Bowbazar Metro Work : বউবাজারে বাড়ির ফাটলের জন্য দায়ী সুড়ঙ্গে জলের প্রবেশ, জানাল কেএমআরসিএল
শুধু কেএমআরসিএল নয় এই প্রকল্পের জন্য জাপানের যে সংস্থা আর্থিক সাহায্য করে (ফান্ডিং পার্টনার), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপরাশেন এজেন্সি (JICA)-র কতৃর্পক্ষেরও একই মতামত ছিল । তবে অবশেষে বিস্তর টানাপোড়েন ও চিঠি চালাচালির পর, 2013 সালে অগত্যা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাজ্যকে নতুন রুটের অনুমোদন দেন । নতুন রুট : শিয়ালদহ থেকে হাওড়া ময়দান পৌঁছনো যাবে বিবি গাঙ্গুলী স্ট্রিট, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, এসএন ব্যানার্জি রোড, এসপ্ল্যানেড, ডালহাউসি ও ব্র্যাবর্ন রোড হয়ে ।