ETV Bharat / city

Dr Narayan Roy কালের অতলে উপেক্ষিত স্বাধীনতা আন্দোলনে বড়দার অবদান, স্মৃতির আড়ালে ডাক্তার নারায়ণ রায় - Dr Narayan Roys Contribution to Freedom Movement is neglected even after 75 years of Inpendence

aকয়েকটি ফলক, রাস্তার নামকরণ এবং নির্দিষ্ট দিনে ফুলমালা চড়িয়ে দায়িত্ব শেষেই তর্পণ সমাপ্তি হয়। না হলে কলকাতা পুরনিগমের আদি সিমলা স্ট্রিটে ডাক্তার নারায়ণ রায় নামে যে একজন অসাধারণ বিপ্লবীর আত্মত্যাগের গল্প লুকিয়ে, তা হেঁটে কলকাতা দেখার সময় ক'জন মনে রাখি (Dr Narayan Roys contribution to freedom movement is neglected even after 75 years of Inpendence)। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে তেমনই এক বিস্মৃত হিরোর গল্প রইল এই প্রতিবেদনে।

Etv Bharat
Etv Bharat
author img

By

Published : Aug 15, 2022, 10:11 PM IST

কলকাতা, 15 অগস্ট: 'কলকাতা, তুমিও হেঁটে দেখ কলকাতা। জনপ্রিয় গানের লাইন। শহর কলকাতাকে চেনার ওয়ান লাইনারও বলা যেতে পারে। তিনশো বছরের পুরানো শহরের অলিতে-গলিতে ঘাপটি মেরে রয়েছে ইতিহাস। যার কোথাও নবাবী আমলের গন্ধ, তো কোথাও আবার স্বাধীনতা আন্দোলনের। দেশের মোস্ট হ্যাপেনিং সিটি যেন ফল্গুধারার মত হিস্টোরিক্যাল ভাইব্র্যান্ট। দেশজুড়ে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব চলছে। তবে অত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি কি তার পূর্বপুরুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার লড়াই সম্বন্ধে সচেতন? দেখে তো অন্তত মনে হয় না সে কথা। কয়েকটি ফলক, রাস্তার নামকরণ এবং নির্দিষ্ট দিনে ফুলমালা চড়িয়ে দায়িত্ব শেষেই তর্পণ সমাপ্তি হয়। না হলে কলকাতা পুরনিগমের আদি সিমলা স্ট্রিটে ডাক্তার নারায়ণ রায় নামে যে একজন অসাধারণ বিপ্লবীর আত্মত্যাগের গল্প লুকিয়ে, তা হেঁটে কলকাতা দেখার সময় ক'জন মনে রাখি (Dr Narayan Roys contribution to freedom movement is neglected even after 75 years of Inpendence)। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে তেমনই এক বিস্মৃত হিরোর গল্প রইল এই প্রতিবেদনে।

1967 সাধারণ নির্বাচনের পরে সরকার গঠনে সিপিআইএম স্বাস্থ্য দফতর পাওয়ার দাবি জানায় ৷ তারা জনগণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির পরিকল্পনায় নানাবিধ পরিকল্পনা করে রেখেছে ৷ তা রূপায়ণে পছন্দের ব্যক্তিও বাছা হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করে তারা। কিন্তু তাদের পছন্দের জয়ী প্রার্থী বেঁকে বসেন। বিধায়ক হয়েছেন তবে কিছুতেই মন্ত্রীত্ব নেবেন না। সাধারণ গরীব মানুষের চিকিৎসা করে আসা মানুষ তিনি। মন্ত্রী হয়ে তাদের পরিষেবা দেওয়ার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। তাই দল নির্দেশ দিলেও তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন ডাক্তারবাবু অর্থাৎ, পছন্দের জয়ী প্রার্থী। কিন্তু যোগ্য পাওয়াই দুষ্কর ছিল, যিনি দায়িত্ব সামলাতে পারেন। ফলে শুরু হল অনুরোধের পালা ৷

তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব পড়ল দুই নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত ও হরেকৃষ্ণ কোঙারের ওপর। তাঁরাও ব্যর্থ হলেন। আসরে এলেন খোদ জ্যোতি বসু ৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে হবে, এই প্রস্তাব নিয়ে কৈলাশ বসু স্ট্রিটের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু অনড়। কিছুতেই রাজি করানো গেল না তাঁকে। মন্ত্রিসভা গঠন হল। স্বাস্থ্য দফতর পেল আর এস পি। মন্ত্রী হলেন ননী ভট্টাচার্য।

আজকাল সমাজসেবকরা সামান্য কারণে দলবদল করেন। পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট না-পেয়ে দলই ছেড়ে যান, মন্ত্রিত্ব না-পেয়ে কাজ করতে না-পারার অছিলায় বিদ্রোহী হন, দলবদল করেন, জেলাসভাপতি বা মন্ত্রী হলে বাড়ি থেকে টাকার বস্তা বইতে লাগে আস্ত ট্রাক। অবৈধ সম্পত্তির পাহাড় সামনে আসে ৷ সেখানে ডাক্তার নারায়ণ রায় মন্ত্রিত্বই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে দাঁড়িয়ে সেদিনের আত্মত্যাগকে অলীক কল্পনা বলেই মনে হয় ৷ বসতবাড়িটি কৈলাশ বোস স্ট্রিটের একটি উৎসব বাড়ির লাগোয়া তস্য অন্ধ গলির ভিতরে। কিছুটা দূরেই রয়েছে তাঁর স্মৃতিতে তৈরি ক্লিনিক, আর আছে নামাঙ্কিত একফালি রাস্তা।

শুধু ডাক্তারি নয় ৷ নারায়ণ রায় একজন প্রণম্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা যা টেগার্ট হত্যা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত ৷ সেই মামলায় আলিপুর, যারবেদা, সেলুলার জেল ফেরত একজন সশস্ত্র বিপ্লবী ডাক্তার নারায়ণ রায়। সেলুলার জেলে যাঁর নামের পাশে ছবি লাগানো হয়েছে কয়েক বছর আগে। কে এই বিপ্লবী নারায়ণ রায়?

সময়টা উত্তাল স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। 1930-এর উত্তাল কোলকাতা। জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ। সঙ্গে চলছে ব্রিটিশ পুলিশের দমনপীড়ন। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মেতেছেন স্বরাজের চিন্তায়। প্রস্তাব আর প্রস্তাবের বয়ান নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। নেতাদের আগুনে বক্তৃতা ৷ তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আট থেকে আশি, সকলেই স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে। বিপ্লবীরা যে যেখানে পারছেন ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ইংরেজের উপরে। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত আগেই ইউরোপ থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। সাম্যবাদের কথা বলেছেন তিনি। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনর নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতে চলে এসেছেন। তবে গা ঢাকা দিয়ে ঘুরছেন। চেষ্টা করছেন কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তুলতে। এই সময়ে কিছু ঘটনা সমগ্র ভারতকে আন্দোলিত করল। 1913-14 রাসবিহারী বসুর সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের পরিকল্পনা, 1914-15 বাঘাযতীনের বিদেশী অস্ত্রের সাহায্যে সারা ভারতে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা এবং 1930 চট্টগ্রামে সময়িকভাবে স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের আওয়াজ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

আরও পড়ুন: নেতাজির চিতাভস্ম দেশে ফিরিয়ে আনার সময় হয়েছে, স্বাধীনতা দিবসে দাবি কন্যার

সশস্ত্র এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাঁড়াশি চাপে ব্রিটিশ শাসন চরম অস্বস্তিতে। ঠিক এই অগ্নিগর্ভ সময়ে ডালহৌসি স্কোয়্যারে পুলিশের বড়কর্তা টেগার্টের গাড়িতে বোমা ছুঁড়লেন দুই বিপ্লবী অনুজা সেনগু্প্ত ও দীনেশ মজুমদার। টেগার্ট প্রাণে বাঁচলেন কিন্তু ভয়ে বিলেতে পালিয়ে গেলেন। সারা কলকাতায় ব্যাপক পুলিশি তল্লাশি শুরু হল। ডাক্তার নারায়ণ রায় ও ডাক্তার ভূপাল বসু-দুই চিকিৎসক এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দুই প্রাক্তন ছাত্রের কাছে পাওয়া গেল টি-এন-টি তৈরীর ফর্মুলা। 1930 ডালহৌসি স্কোয়্যার বোমানিক্ষেপ মামলায় প্রত্যেকেরই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর সাজা হয় ৷ সকলে জেল খাটেন আন্দামানে। ডাক্তার নারায়ণ রায় ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তিনি ছাত্রাবস্থাতেই বিপ্লববাদী 'যুগান্তর সমিতি'-তে যোগ দেন। 1930 তিনি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দ্রুতই তিনি হন কলকাতা কর্পোরেশনের সর্বকনিষ্ঠ কাউন্সিলর ৷ সরকারি মতে ডাক্তার নারায়ণ রায় ছিলেন যুগান্তর সমিতির বোমার কারখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মী। তাঁর গ্রেফতারির সময় পুলিশ ওই কারখানাটিও আবিষ্কার করে। মামলার শুনানির সময় তিনি তাঁর সঙ্গীদের বাঁচানোর উদ্দেশে এই ষড়যন্ত্রের সকল দায়ভার নিজের এবং তাঁর পলাতক ভাই গোবিন্দ রায়ের উপর চাপিয়ে আদালতে বিবৃতি দেন। আদালতের রায়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকার সময়ে কমরেড কালী সেনের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তারপরই তিনি কমিউনিস্ট হওয়ার পথের সন্ধান পান। পরে তাঁকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বোম্বের (তৎকালীন) ইয়াড়ারা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই কারাগারের নির্জন কক্ষে বসে তিনি পড়ে ফেলেন ইডেন অ্যাণ্ড সিডার পল অনুদিত 'মার্কসের ক্যাপিটেল। সেই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছিলেন,
"Don’t worry,
Don’t hurry,
The wheel of time
Has not stopped"

বিস্মৃত অতলে ডঃ নারায়ণ রায়

তিনি লিখেছেন। কিন্তু সময় কি তাঁকে মনে রেখেছে। তাঁর নামাঙ্কিত দাতব্য চিকিৎসালয় চালু রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা নামকে ওয়াস্তে ৷ একফালি রাস্তার নামাকরণে স্মৃতি বাঁচানোর চেষ্টা। তার ব্যবহৃত জিনিস, হাতে লেখা চিঠি কোথায় যে আছে, তা নিয়ে পরিবারের লোকও আঁধারে ৷ ডাক্তার নারায়ণ রায়ের ভাইপো এবং ডাক্তার নীলমাধব রায়ের পুত্র আইনজীবি নির্মাল্য রায়ের আক্ষেপ সঠিক স্বীকৃতি না পাওয়ায়। আক্ষেপের সুরে নির্মাল্য রায় বলেন, "দেখুন ওনাদের মতো মানুষের মূল্যায়ণ বর্তমান সময় করতে পারেনি। এলাকায় তাঁর পরিচিতি ছিল 'বড়দা' নামে। প্রকৃত অর্থেই বড়দা ছিলেন তিনি। তাঁর চিকিৎসা পরিষেবা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত না হয়, সেটাই ছিল বেশি গুরুত্বের। রোগীদের চিকিৎসা করেই ক্ষান্ত হতেন না। তাদের চিকিৎসা সঠিকভাবে চলছে কি না, সেটাও মাথায় রাখতেন। পথ্যের জোগাড়ও করে দিতেন নিজের খরচে। এমন মানুষের স্মৃতিতে আমরা দাতব্য চিকিৎসা চালাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু তার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। করার উদ্যোগও নেই ৷"

মামলার যাবতীয় কাগজ পার্টির কাছে রয়েছে বলে মনে করে পরিবার ৷ কিন্তু তার হদিশ আছে বলে মনে করেন না। কারণ বহুবার চেয়েও তার অস্তিত্ব মেলেনি। তাই উত্তর কলকাতার কৈলাশ বোস স্ট্রিটের বড়দা দল-সমাজ-ইতিহাসের কাছেই উপেক্ষিত নায়ক হিসেবে রয়ে গিয়েছেন ৷

কলকাতা, 15 অগস্ট: 'কলকাতা, তুমিও হেঁটে দেখ কলকাতা। জনপ্রিয় গানের লাইন। শহর কলকাতাকে চেনার ওয়ান লাইনারও বলা যেতে পারে। তিনশো বছরের পুরানো শহরের অলিতে-গলিতে ঘাপটি মেরে রয়েছে ইতিহাস। যার কোথাও নবাবী আমলের গন্ধ, তো কোথাও আবার স্বাধীনতা আন্দোলনের। দেশের মোস্ট হ্যাপেনিং সিটি যেন ফল্গুধারার মত হিস্টোরিক্যাল ভাইব্র্যান্ট। দেশজুড়ে স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব চলছে। তবে অত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি কি তার পূর্বপুরুষের ত্যাগ-তিতিক্ষার লড়াই সম্বন্ধে সচেতন? দেখে তো অন্তত মনে হয় না সে কথা। কয়েকটি ফলক, রাস্তার নামকরণ এবং নির্দিষ্ট দিনে ফুলমালা চড়িয়ে দায়িত্ব শেষেই তর্পণ সমাপ্তি হয়। না হলে কলকাতা পুরনিগমের আদি সিমলা স্ট্রিটে ডাক্তার নারায়ণ রায় নামে যে একজন অসাধারণ বিপ্লবীর আত্মত্যাগের গল্প লুকিয়ে, তা হেঁটে কলকাতা দেখার সময় ক'জন মনে রাখি (Dr Narayan Roys contribution to freedom movement is neglected even after 75 years of Inpendence)। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে তেমনই এক বিস্মৃত হিরোর গল্প রইল এই প্রতিবেদনে।

1967 সাধারণ নির্বাচনের পরে সরকার গঠনে সিপিআইএম স্বাস্থ্য দফতর পাওয়ার দাবি জানায় ৷ তারা জনগণের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির পরিকল্পনায় নানাবিধ পরিকল্পনা করে রেখেছে ৷ তা রূপায়ণে পছন্দের ব্যক্তিও বাছা হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করে তারা। কিন্তু তাদের পছন্দের জয়ী প্রার্থী বেঁকে বসেন। বিধায়ক হয়েছেন তবে কিছুতেই মন্ত্রীত্ব নেবেন না। সাধারণ গরীব মানুষের চিকিৎসা করে আসা মানুষ তিনি। মন্ত্রী হয়ে তাদের পরিষেবা দেওয়ার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। তাই দল নির্দেশ দিলেও তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন ডাক্তারবাবু অর্থাৎ, পছন্দের জয়ী প্রার্থী। কিন্তু যোগ্য পাওয়াই দুষ্কর ছিল, যিনি দায়িত্ব সামলাতে পারেন। ফলে শুরু হল অনুরোধের পালা ৷

তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব পড়ল দুই নেতা প্রমোদ দাশগুপ্ত ও হরেকৃষ্ণ কোঙারের ওপর। তাঁরাও ব্যর্থ হলেন। আসরে এলেন খোদ জ্যোতি বসু ৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হতে হবে, এই প্রস্তাব নিয়ে কৈলাশ বসু স্ট্রিটের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু অনড়। কিছুতেই রাজি করানো গেল না তাঁকে। মন্ত্রিসভা গঠন হল। স্বাস্থ্য দফতর পেল আর এস পি। মন্ত্রী হলেন ননী ভট্টাচার্য।

আজকাল সমাজসেবকরা সামান্য কারণে দলবদল করেন। পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোটে টিকিট না-পেয়ে দলই ছেড়ে যান, মন্ত্রিত্ব না-পেয়ে কাজ করতে না-পারার অছিলায় বিদ্রোহী হন, দলবদল করেন, জেলাসভাপতি বা মন্ত্রী হলে বাড়ি থেকে টাকার বস্তা বইতে লাগে আস্ত ট্রাক। অবৈধ সম্পত্তির পাহাড় সামনে আসে ৷ সেখানে ডাক্তার নারায়ণ রায় মন্ত্রিত্বই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে দাঁড়িয়ে সেদিনের আত্মত্যাগকে অলীক কল্পনা বলেই মনে হয় ৷ বসতবাড়িটি কৈলাশ বোস স্ট্রিটের একটি উৎসব বাড়ির লাগোয়া তস্য অন্ধ গলির ভিতরে। কিছুটা দূরেই রয়েছে তাঁর স্মৃতিতে তৈরি ক্লিনিক, আর আছে নামাঙ্কিত একফালি রাস্তা।

শুধু ডাক্তারি নয় ৷ নারায়ণ রায় একজন প্রণম্য স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম। ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা যা টেগার্ট হত্যা ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত ৷ সেই মামলায় আলিপুর, যারবেদা, সেলুলার জেল ফেরত একজন সশস্ত্র বিপ্লবী ডাক্তার নারায়ণ রায়। সেলুলার জেলে যাঁর নামের পাশে ছবি লাগানো হয়েছে কয়েক বছর আগে। কে এই বিপ্লবী নারায়ণ রায়?

সময়টা উত্তাল স্বদেশী আন্দোলনের যুগ। 1930-এর উত্তাল কোলকাতা। জাতীয়তাবাদের সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ। সঙ্গে চলছে ব্রিটিশ পুলিশের দমনপীড়ন। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা মেতেছেন স্বরাজের চিন্তায়। প্রস্তাব আর প্রস্তাবের বয়ান নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। নেতাদের আগুনে বক্তৃতা ৷ তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আট থেকে আশি, সকলেই স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে। বিপ্লবীরা যে যেখানে পারছেন ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ইংরেজের উপরে। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত আগেই ইউরোপ থেকে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। সাম্যবাদের কথা বলেছেন তিনি। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনর নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায় ভারতে চলে এসেছেন। তবে গা ঢাকা দিয়ে ঘুরছেন। চেষ্টা করছেন কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তুলতে। এই সময়ে কিছু ঘটনা সমগ্র ভারতকে আন্দোলিত করল। 1913-14 রাসবিহারী বসুর সারা ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের পরিকল্পনা, 1914-15 বাঘাযতীনের বিদেশী অস্ত্রের সাহায্যে সারা ভারতে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা এবং 1930 চট্টগ্রামে সময়িকভাবে স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের আওয়াজ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

আরও পড়ুন: নেতাজির চিতাভস্ম দেশে ফিরিয়ে আনার সময় হয়েছে, স্বাধীনতা দিবসে দাবি কন্যার

সশস্ত্র এবং অসহযোগ আন্দোলনের সাঁড়াশি চাপে ব্রিটিশ শাসন চরম অস্বস্তিতে। ঠিক এই অগ্নিগর্ভ সময়ে ডালহৌসি স্কোয়্যারে পুলিশের বড়কর্তা টেগার্টের গাড়িতে বোমা ছুঁড়লেন দুই বিপ্লবী অনুজা সেনগু্প্ত ও দীনেশ মজুমদার। টেগার্ট প্রাণে বাঁচলেন কিন্তু ভয়ে বিলেতে পালিয়ে গেলেন। সারা কলকাতায় ব্যাপক পুলিশি তল্লাশি শুরু হল। ডাক্তার নারায়ণ রায় ও ডাক্তার ভূপাল বসু-দুই চিকিৎসক এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দুই প্রাক্তন ছাত্রের কাছে পাওয়া গেল টি-এন-টি তৈরীর ফর্মুলা। 1930 ডালহৌসি স্কোয়্যার বোমানিক্ষেপ মামলায় প্রত্যেকেরই যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর সাজা হয় ৷ সকলে জেল খাটেন আন্দামানে। ডাক্তার নারায়ণ রায় ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তিনি ছাত্রাবস্থাতেই বিপ্লববাদী 'যুগান্তর সমিতি'-তে যোগ দেন। 1930 তিনি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দ্রুতই তিনি হন কলকাতা কর্পোরেশনের সর্বকনিষ্ঠ কাউন্সিলর ৷ সরকারি মতে ডাক্তার নারায়ণ রায় ছিলেন যুগান্তর সমিতির বোমার কারখানার ভারপ্রাপ্ত কর্মী। তাঁর গ্রেফতারির সময় পুলিশ ওই কারখানাটিও আবিষ্কার করে। মামলার শুনানির সময় তিনি তাঁর সঙ্গীদের বাঁচানোর উদ্দেশে এই ষড়যন্ত্রের সকল দায়ভার নিজের এবং তাঁর পলাতক ভাই গোবিন্দ রায়ের উপর চাপিয়ে আদালতে বিবৃতি দেন। আদালতের রায়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকার সময়ে কমরেড কালী সেনের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তারপরই তিনি কমিউনিস্ট হওয়ার পথের সন্ধান পান। পরে তাঁকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বোম্বের (তৎকালীন) ইয়াড়ারা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই কারাগারের নির্জন কক্ষে বসে তিনি পড়ে ফেলেন ইডেন অ্যাণ্ড সিডার পল অনুদিত 'মার্কসের ক্যাপিটেল। সেই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছিলেন,
"Don’t worry,
Don’t hurry,
The wheel of time
Has not stopped"

বিস্মৃত অতলে ডঃ নারায়ণ রায়

তিনি লিখেছেন। কিন্তু সময় কি তাঁকে মনে রেখেছে। তাঁর নামাঙ্কিত দাতব্য চিকিৎসালয় চালু রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা নামকে ওয়াস্তে ৷ একফালি রাস্তার নামাকরণে স্মৃতি বাঁচানোর চেষ্টা। তার ব্যবহৃত জিনিস, হাতে লেখা চিঠি কোথায় যে আছে, তা নিয়ে পরিবারের লোকও আঁধারে ৷ ডাক্তার নারায়ণ রায়ের ভাইপো এবং ডাক্তার নীলমাধব রায়ের পুত্র আইনজীবি নির্মাল্য রায়ের আক্ষেপ সঠিক স্বীকৃতি না পাওয়ায়। আক্ষেপের সুরে নির্মাল্য রায় বলেন, "দেখুন ওনাদের মতো মানুষের মূল্যায়ণ বর্তমান সময় করতে পারেনি। এলাকায় তাঁর পরিচিতি ছিল 'বড়দা' নামে। প্রকৃত অর্থেই বড়দা ছিলেন তিনি। তাঁর চিকিৎসা পরিষেবা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত না হয়, সেটাই ছিল বেশি গুরুত্বের। রোগীদের চিকিৎসা করেই ক্ষান্ত হতেন না। তাদের চিকিৎসা সঠিকভাবে চলছে কি না, সেটাও মাথায় রাখতেন। পথ্যের জোগাড়ও করে দিতেন নিজের খরচে। এমন মানুষের স্মৃতিতে আমরা দাতব্য চিকিৎসা চালাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু তার সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। করার উদ্যোগও নেই ৷"

মামলার যাবতীয় কাগজ পার্টির কাছে রয়েছে বলে মনে করে পরিবার ৷ কিন্তু তার হদিশ আছে বলে মনে করেন না। কারণ বহুবার চেয়েও তার অস্তিত্ব মেলেনি। তাই উত্তর কলকাতার কৈলাশ বোস স্ট্রিটের বড়দা দল-সমাজ-ইতিহাসের কাছেই উপেক্ষিত নায়ক হিসেবে রয়ে গিয়েছেন ৷

For All Latest Updates

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.