কলকাতা, 6 এপ্রিল : শিল্প-বন্ধ্যা পশ্চিমবঙ্গ, এই অভিযোগে বারবার সরব হয় বিরোধীরা ৷ কাঠগড়ায় তোলা হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের (Bengal CM Mamata Banerjee) শিল্পনীতিকে ৷ যদিও তা কখনোই স্বীকার করতে চায় না শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) ৷ বরং তাদের দাবি, রাজ্যে শিল্প আনতে গত কয়েক বছরে বহুবার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার ৷ আগামিদিনেই নেওয়া হবে ৷
শাসক দলের নেতাদের দাবি, বাম আমলে জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন, ধর্মঘট বঙ্গের শিল্পকে শেষ করে দেয় ৷ তার পর সিঙ্গুরের মতো ঘটনা রাজ্যে শিল্পের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয় ৷ 2011-র পর থেকে সেই পরিস্থিতির বদল হয়েছে ৷ বর্তমান সরকারের নীতিও শিল্প-বান্ধব পরিস্থিতি তৈরি করতে অনেকটাই সাহায্য করেছে ৷
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, তৃতীয়বার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে শিল্পায়নের উপর জোর দিয়েছেন ৷ সেই কারণেই এবারের বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন ৷ গত নভেম্বরে তিনি এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও (Prime Minister Narendra Modi) জানিয়ে এসেছেন ৷
কিন্তু সেই সম্মেলন কি সফল হবে ? গত কয়েকদিন ধরেই এই প্রশ্ন ঘুরছে রাজ্যের বিভিন্ন মহলে ৷ কারণ হিসেবে উঠে আসছে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ৷ একের পর এক ঘটনায় কাঠগড়ায় পুলিশ-প্রশাসন ৷ এই পরিস্থিতিতে কি শিল্পপতিরা আদৌ বঙ্গে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন ?
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, শিল্প বিনিয়োগের জন্য পরিকাঠামো যতটা জরুরি, ঠিক ততটাই জরুরি রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টিও । প্রত্যেক শিল্পপতি চান তিনি যেখানে বিনিয়োগ করবেন, সেখানে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় থাকুক । কিন্তু বাংলায় একের পর এক এমন ঘটনা ঘটছে, যেখানে রাজ্যের বিচারালয়কে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ পর্যন্ত দিতে হচ্ছে । আইন-শৃঙ্খলার রক্ষক যে পুলিশ, তার উপর ভরসা রাখতে পারছেন না সাধারণ মানুষ । সেটাই ফের শিল্পপতিদের বঙ্গে বিনিয়োগের আগে চিন্তার কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে ৷
রাজ্য সরকারের এক প্রবীণ মন্ত্রী ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় খোলাখুলিভাবেই বলছিলেন, ‘‘একের পর এক ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সরকারের দিকে প্রশ্ন ওঠা শিল্প এবং বিনিয়োগের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করে । তবে এটাও ঠিক বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, তার বৃহদাংশই পরিকল্পিত রাজনীতির অংশ । মূলত সরকারকে বদনাম করার জন্যই এসব করা । আমাদের এসব থেকে দ্রুত কাটিয়ে উঠতেই হবে । তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লক্ষ্য শিল্প এবং কর্মসংস্থান । সেই জায়গা থেকে দেখতে গেলে রাজ্যে বিনিয়োগ জরুরি ।’’
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক তথা প্রবীণ সাংবাদিক শান্তনু সান্যাল মনে করছেন, এই মুহূর্তে রাজ্য সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা থাকলেও বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনিয়োগ আসার পথে বড় বাধা হতে পারে । তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন অতীতেও আমাদের রাজ্যে হয়েছে । সেখানে মুকেশ আম্বানির মতো দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা উপস্থিত থেকেছেন । কিন্তু এই উপস্থিতির কতটা লাভ রাজ্য তুলতে পেরেছে সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে । কারণ, গত 10 বছর সরকার চালানোর পর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর তৃতীয় টার্মে এসে বলছেন আগামীতে তাঁর লক্ষ্য শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থান । এর অর্থ বিগত সময়ে নিশ্চয়ই কিছু খামতি থেকে গিয়েছিল । মুখ্যমন্ত্রী যখন সেই খামতি সংশোধন করার চেষ্টা করছেন ঠিক তখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তার স্বপ্নে জল ঢেলে দিতে পারে ।’’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শিল্পপতিরা কোনও রাজ্যে বিনিয়োগের আগে দেখেন সে রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা আছে কি না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক আছে কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি... । মনে রাখতে হবে, বিনিয়োগের বাজারটা এখন খুব কম্পিটিটিভ । প্রত্যেক রাজ্যই তাদের মতো করে শিল্পপতিদের নিজের রাজ্যে আহ্বান করছে । সেখানে যদি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ থাকে, কেন কোনও শিল্পপতি আমাদের রাজ্যে বিনিয়োগ করবেন ।’’
অর্থনীতির শিক্ষক শান্তনু বসু মনে করেন, ‘‘বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন রাজ্যের জন্য শিল্পমহলের কাছে রাজ্যের কী কী ভালো আছে, সেটা তুলে ধরার একটা শোকেস । যার মাধ্যমে শিল্পপতিরা আগ্রহী হবেন এরাজ্যে বিনিয়োগ করতে । সেখানে যদি আইন-শৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত সরকারের এই উদ্যোগ কতটা সফল হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে । শিল্প আনার ক্ষেত্রে সরকার কোনও কাজ করেনি এমনটা নয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকারের এই উদ্যোগ ব্যর্থ হতে পারে শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা অবনতির কারণেই । অতএব সরকারকেও এই বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে ।’’
আরও পড়ুন : Mamata Banerjee : সংখ্যালঘুদের ক্ষোভ কি মমতার ভোটব্যাঙ্কে বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে ?