কলকাতা, 20 জুলাই : কোরোনা ভাইরাসের জেরে দেশে সম্পূর্ণ লকডাউনের সময় ছোটো-বড় সব অনুষ্ঠান বাতিল করা হয় ৷ যার থেকে বাদ যায়নি বিয়ের অনুষ্ঠানও । এরপর মে মাস থেকে ধীরে ধীরে লকডাউনের নিয়ম শিথিল হতে শুরু করে ৷ আনলক পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রথমে 50 জন ও তারপর 25 জন নিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করার সরকারি নির্দেশিকা দেওয়া হয় । এই পরিস্থিতিতে চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়েছেন এই ব্যবসার সাথে যুক্ত মানুষজন ।
বাতিল হচ্ছে একের পর এক অনুষ্ঠান । বিয়ের অনুষ্ঠানও পিছিয়ে যাচ্ছে বা বাতিল হয়ে যাচ্ছে । পার্লার থেকে পুরোহিত, ডেকরেটর থেকে ক্যাটারিং, ফটোগ্রাফার থেকে মেহেন্দিওয়ালা, ইলেকট্রিশিয়ান থেকে ফুলওয়ালা ও বাজনদার থেকে পানওয়ালাসহ আরও অনেক মানুষ যাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাঁদের ব্যবসা লাটে উঠেছে । কবে আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা এখন বলা যাচ্ছে না । হিন্দুমতে যে মাসগুলিতে বিয়ে হয় সেগুলি হল - 15 নভেম্বর থেকে 15 ডিসেম্বর, 15 জানুয়ারি থেকে 14 মার্চ ও 15 এপ্রিল থেকে 15 অগাস্ট । বাংলা পঞ্জিকা মতে বিয়ের মাসগুলি হল - বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, অগ্রহায়ণ, মাঘ ও ফাল্গুন মাস । অন্য বছরে এই সময় ব্যবসায়ীদের দম ফেলার ফুরসতটুকু মেলে না । কিন্তু এবছর বিয়ের মরসুমের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাস থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে বা পিছিয়ে গেছে । যদিও এর মধ্যে অনেকে খুব অল্প সংখ্যক আত্মীয় পরিজনকে নিয়ে বিয়ে সেরেছেন । তবে সেই সংখ্যা হাতেগোনা । বিয়ের জন্য ভাড়া দেন এমন এক অনুষ্ঠান বাড়ির জেনেরাল ম্যানেজার ওয়াসিম আক্রম বলেন, ‘‘সরকারি নির্দেশিকা অনুসারে এখন 50 জনের বেশি লোক নিয়ে অনুষ্ঠান করা যাবে না । আমাদের এখানে যা জায়গা রয়েছে সেখানে 50 জন নিয়ে কাজ করলে কোনও লাভই থাকবে না । তাই অর্ডার আসলেও তা নিতে পারছি না । যে কাজগুলির অর্ডার নিয়েছি তা সবই নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসের ৷ তবে সেগুলি হবে কি না তাও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না । আমাদের যতজন কর্মী ছিলেন তাঁদের অনেকে বাড়ি চলে গেছেন । প্রথম তিন মাস তাঁদের বেতনও দেওয়া হয়েছে ।" তিনি আরও বলেন, "লকডাউনের জেরে সাধারণ মানুষের হাতে টাকা থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক । তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আগে একজন যত টাকা খরচ করে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান করতেন এখন তার চেয়ে কিছুটা কমে করতে চাইবেন ।"
বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য অনেক আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয় ৷ প্রায় এক বছর আগে থেকে সমস্তরকম প্রস্তুতি নিতে হয় ৷ অনেকে আগে থেকে অনুষ্ঠান বাড়ির বুকিং সেরে রাখেন । আবার অনেকে মূল অনুষ্ঠানের প্রায় 3 থেকে 4 মাস আগে ক্যাটারার, ডেকরেটর, ক্যামেরাম্যান, পার্লার, মিষ্টি বিক্রেতাসহ বিভিন্নজনকে কাজের জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে রাখেন । অনুষ্ঠানগুলি একের পর এক বাতিল হয়ে যাচ্ছে বলে সেই বায়নার টাকাও ফেরত চাইছেন অনেকে । এই বিষয়ে এক ক্যাটারিং সংস্থার মালিক ফিরোজ় বলেন, "যাঁরা অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন তাঁদের টাকা ফিরিয়ে দিতে হয়েছে । এর ফলে চরম সমস্যা তৈরি হচ্ছে । কারণ লকডাউনের সময় কোনও উপার্জন নেই বলে অগ্রিম টাকা থেকে কর্মীদের বেতন দেওয়া হয়েছে বা আমাদের সংসার চলছে ৷ তাই এখন হঠাৎ করে এই টাকা কোথা থেকে ফেরত দেব ?" শুধু বড় ব্যবসায়ীরা নন, এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছোটো কর্মীরাও চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন গুজরান করছে কোনওমতে । এঁদের মধ্যে আবার অনেকেই আপাতত চাষবাস করে সংসার চালিয়ে নিলেও বেশিরভাগ কর্মীই পেশা বদলের কথা ভাবছে।’’
আর এক ক্যাটারিং সংস্থার মালিক প্রবীর রক্ষিত বলেন, "ডেকরেশনের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু কর্মী । তাই আমরা মালিকপক্ষ থেকে যতটা সম্ভব তাঁদের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করে চলেছি । তবে আমাদের পুঁজিও ফুরিয়ে আসছে । তাই যদি সরকারের তরফে এঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে অনেকেই উপকৃত হবে । পাশাপাশি মাঝারি ও ছোটো ডেকরেটরদের জন্য যদি একটা ব্যাহ্ক ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় তাহলে তাঁরা হয়ত আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ।" এখন কোনওমতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখার তাগিদে অনুষ্ঠান বাড়িগুলি ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাগুলি বিয়ের বাজারে 50 জনের প্যাকেজ এনেছে ।
লকডাউনের কারণে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ফুল ব্যবসায়ীরাও । ফুল ব্যবসায়ী সঞ্জয় রায় বলেন, "বছরের শুরুতে যে কাজগুলি হয় তাতে ভালোই লাভ থাকে । এই চার মাস কাজ করে কর্মচারীরা বাকি ছয় মাসের খোরাকির টাকা তোলে । এই মরশুমে একটাও কাজ হল না । এছাড়া এবছরের যে কাজগুলি হবে সেগুলির জন্য আগাম টাকা নিয়েছিলাম । প্রতিবছর ফুলের কাজের কাঠামো বদল হতে থাকে । তাই পুরানো কাঠামোগুলি বাতিল করে নতুন করে তৈরি করতে হয় । এর জন্য বায়নার টাকার অনেকটা খরচ হয়ে যায় । সেই টাকা এখন ফেরত দেওয়া আরেক দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । অন্যদিকে গোডাউনের ভাড়াও দিতে হচ্ছে । জিনিসের কোনও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না ৷’’ক্যাটারিং সংস্থার মালিক তপন বারিক বলেন, "কোরোনার আতঙ্ক কাটিয়ে কবে আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিকভবে তা এখন বলা যাচ্ছে না । আর্থিক ক্ষতির একটা দীর্ঘস্থায়ী ছাপ পড়বে । ছোট কাজ করে কোনও লাভ থাকবে না । সমাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এখন আর কোনও বড় অনুষ্ঠান হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না ।"