কলকাতা,25 ফেব্রুয়ারি : বঙ্গজয়ের স্বপ্ন দেখার সময় থেকেই বাঙালি মনীষীদের নিয়ে দিল্লি-উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতাদের উৎসাহ ক্রমবর্ধমান ৷ তার পিছনে যতটা না বাঙলার ঐতিহ্য ও ইতিহাস চর্চার উপর গেরুয়া নেতদের আগ্রহ, তার থেকে অনেক বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন কাজ করছে ৷ লোকসভা ভোটের সময়ও দেখা গেছে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দদের স্মরণ করেছেন গো-বলয়ের নেতারা ৷ বিধানসভা ভোটেও তার ব্যতিক্রম নেই ৷ রাজ্য সফরে এসে মোদি-শাহ-নাড্ডাদের দেখা গেছে কোনও না কোনও বাঙালি মনীষীর স্মৃতিবিজরিত স্থান দর্শন করতে ৷ কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চুঁচুড়ায় সভা করতে এসে সেখানকার বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত বন্দেমাতরম ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরে শাসক দলকে সমালোচনা করেছেন ৷ আর আজ বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়িতে যাবেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা ৷ বুধবারই কলকাতায় এসেছেন নাড্ডা ৷ আজ সকালেই তাঁর যাবার কথা রাজ্য বিজেপির নতুন কার্যালয় হেস্টিং-এ ৷ সেখানে রাজ্যের প্রত্যেক বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির রথযাত্রার সূচনাও করবেন নাড্ডা ৷ তারপরেই সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ি দর্শনের জন্য নৈহাটির উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন তিনি ৷ তবে এবার জেপি নাড্ডা বঙ্কিম স্মরণের পাশাপাশি ব্যারাকপুরে সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেও যাবেন ৷ তার আগে সাংসদ অর্জুন সিংয়ের লোকসভা এলাকা ব্যারাকপুরে জনসভা করবেন তিনি ৷
কিন্তু বিজেপির এই বঙ্কিম প্রীতির কারণ কি ? ঠিক কোন যুক্তিতেই বা বঙ্কিম সহ অন্যান্য বাঙালি মনীষীদের স্মরণে আসতে হচ্ছে মোদি-শাহ-নাড্ডাদের ? এর পিছনেও বিজেপির বহুদিনের লালিত জাতীয়তাবাদের চিন্তাই মুখ্য কারণ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত ৷ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না ৷ কিন্তু বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ কখনই হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখা নয় ৷ বঙ্কিমচন্দ্রের সীতারাম উপন্যাসে মুসলমান ফকির চাঁদশাহের মুখ দিয়ে সাহিত্য সম্রাট কী বলেছিলেন সে কথা আমরা অনেকেই জানি ৷ "ফকির বলিল, বাবা! শুনিতে পাই, তুমি হিন্দুরাজ্য স্থাপন করিতে আসিয়াছ, কিন্তু অত দেশাচারের বশীভূত হইলে, তোমার হিন্দুরাজ্য সংস্থাপন করা হইবে না। তুমি যদি হিন্দু মুসলমান সমান না দেখ, তবে এই হিন্দু মুসলমানের দেশে তুমি রাজ্য রক্ষা করিতে পারিবে না।"এজন্য রাজ্যে বিজেপি নরম হিন্দুত্ব-র পাশাপাশি মুসলমানদেরও কাছে টানতে চেয়েছে ৷ লোকসভা ভোটের আগে রাজ্যে বিজেপির সলতে পাকানোর কাজ সঙ্ঘ নেতারা যে অনেক আগেই শুরু করেছিলেন সে নিয়ে কোনও তর্ক নেই ৷ বাঙলার উদার জাতীয়তাবাদের চরিত্র বুধতে পেরেই রাজ্য ও কেন্দ্র বিজেপি নেতারা কখনই উগ্র হিন্দুত্বকে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেননি৷ লোকসভা ভোটের আগে বেশ কয়েকবার রাজ্য সফরে এসে সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতও 'হিন্দু মুসলমানকে সমান' দেখার নীতিকেই তুলে ধরেন ৷ হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির বার্তা তুলে ধরে এক সভায় মোহন ভাগবত বলেন, দেশে মুসলমানরা অবাঞ্ছিত হয়ে পড়লে হিন্দুত্বের ধারণারও বিলুপ্তি ঘটবে ৷ রাজ্যে ভোটের দামামা যত বাজছে ততই রাজনৈতিক নেতাদের মনীষীদের স্মরণ নিতে হচ্ছে ৷ কোন দল কতটা রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দদের শ্রদ্ধা করে তা দেখানোর প্রতিযোগিতা চলছে ৷ মোদি-শাহরা কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন ৷ বাঙালি আইকনদের মাধ্যমে বাঙালির আবেগকে স্পর্শ করতে চায় বিজেপি ৷ আর তাই কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতাদের বঙ্গ সফরে বিভিন্ন মনীষীদের স্মৃতি বিজরিত স্থান দর্শনে এতো আগ্রহ ৷
আরও পড়ুন :প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত স্টেডিয়ামের উদ্বোধনে রাষ্ট্রপতি, বিতর্কের কেন্দ্রে মোতেরা
চুঁচুড়ায় সভা করতে এসে বন্দেমাতরম ভবনের 'দুরবস্থা'র জন্য দুঃখ করেছেন মোদি ৷ আর আজ তো বঙ্কিমের বাড়ি দর্শনেই চললেন নাড্ডা ৷ নাড্ডা নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি ও সংগ্রহশালা দেখবেন ৷ এই সংগ্রহশালা দেখার পরেই কাছে গৌরিপুরে এক চটকল শ্রমিকের বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজন করবেন তিনি ৷ বিজেপির এই লাঞ্চ ডিপ্লোমেসি আজকের নয়৷ উত্তরপ্রদেশ ভোটের আগে থাকতেই এই ভোজন পলিটিক্সের শুরু ৷ নৈহাটির পরেই ব্যারাকপুরের আনন্দপুরী এলাকায় একটি কালীমন্দিরে পুজো দেবেন নাড্ডা ৷ সেখান থেকে চলে যাবেন ব্যারাকপুরে ৷ তবে তার আগে নবদ্বীপ জো়নের রথযাত্রার সমাপ্তি ঘোষণা করবেন তিনি ৷ ব্যারাকপুরে জনসভা শেষ করে নাড্ডা যাবেন সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ৷ পরে মঙ্গল পান্ডের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে কলকাতা ফেরার কথা নড্ডার ৷ কলকাতায় সায়েন্স সিটিতেও সন্ধ্যায় একটি সভায় থাকবেন তিনি ৷ বিজেপির বুদ্ধিজীবী সেলের উদ্যোগে এই সভায় উপস্থিত থাকবেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরণীয় ব্যক্তিরা ৷