আসানসোল, 9 অগস্ট : মফস্বলের পাড়ায় পাড়ায় কাঁধে গিটার নিয়ে ঘুরছে একদল যুবক-যুবতী । হালফিলে এই চিত্র বড় পরিচিত আসানসোলবাসীদের কাছে । কিন্তু তারপর কী হচ্ছে ? বাংলা ব্যান্ডের উত্তাল সময়ে আসানসোলেও হুজুগে বেশ কিছু বাংলা ব্যান্ড হয়েছিল বটে । কিন্তু সেসব অল্প ক’দিনেই ভেঙে গিয়েছে ।
তবু নস্টালজিয়ার ঝুলিতে আছে আসানসোলের (Asansol) এক সোনালী সময় । 60-70 দশকের কাউন্ট্রি মিউজিক, রক অ্যান্ড রোল ও পপ ব্যান্ড । চেলিডাঙা, বুধার আসেপাশ-সহ আসানসোলের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়াগুলোতে গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি কাউন্ট্রি, পপ ব্যান্ড ।
সেই ব্যান্ডগুলির অনেকেই আজ আর এই পৃথিবীতে নেই । আবার অনেকেই বিশ্ব সঙ্গীতের দরবার ছুঁয়ে ফেলেছে । তেমনই একজন টেরি মরিস । একদা ভারতীয় টেরি মিশ্র আজ অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে টেরি মরিস (Terry Morris) নামে পরিচিত । প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ড ‘দ্য ইকোস’ (The Echoes)-এর সদস্য টেরি । গিটার ও তাঁর গানে সেদেশে পরিচিত নাম । দেশে-বিদেশে প্রচুর কনসার্ট করেন । অ্যালবামও রয়েছে ।
টেরি আসানসোলের সেই ঘুপচি পাড়া থেকে আজ অনন্য কৃতিত্ব সাধন করেছেন মৌলিক গানবাজনায় । অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে তাঁর বিখ্যাত কমিউমিটি গান ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ানস ফরএভার’ (Anglo Indians Forever) তাঁকে বিশ্বের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের কাছে সমাদৃত করেছে । ইতিমধ্যেই দুবাই থেকেও টেরির মিউজিক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে । হাজার হাজার মানুষ সেই অ্যালবাম কিনেছেন ।
টেরি মরিসের জন্ম বিহারের পাটনার খাগৌলে । পারিবারিক পদবী ছিল ‘মিশ্র’ । বাবা ছিলেন ভারতীয়, মা ছিলেন ব্রিটিশ উচ্চ শিক্ষিতা মহিলা । ছোট থেকে মায়ের সংস্পর্শে সাহেবী কায়দায় বড় হয়ে ওঠা টেরির । চাকরি সূত্রে মাইথনের পাশে ঝাড়খণ্ডের কুমারডুবিতে চলে আসেন টেরির বাবা । সঙ্গে টেরির মা এবং ছোট্ট টেরি । কয়েক বছরের মধ্যেই টেরির মা মাইথনে প্রথম ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল তৈরি করেন । সেই স্কুলের নাম ছিল ভ্যালি স্কুল (Valley School) । সেখানেই জীবনের প্রথম পড়াশুনোর পাঠ টেরির । পরবর্তী কালে আসানসোলের সেন্ট ভিনসেন্ট স্কুলে (St. Vincent High & Technical School) আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন তিনি । এরপরেই সঙ্গীতের দুনিয়ায় তাঁর আত্মপ্রকাশ ও জীবনের অনন্য পথ চলা শুরু ।
একদিকে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের ‘কার ও টেগোর’ কোম্পানির প্রথম কয়লা উত্তোলন । তারই স্বার্থে প্রথমে রানিগঞ্জ ও পরে আসানসোলে রেলপথের সূচনা । আসানসোল রেল ডিভিশন গড়ে ওঠা । পূর্ব রেলে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলের মুখ্য প্রশাসনিক ভবন গড়ে ওঠে আসানসোলে । প্রচুর সাহেবদের আগমন ঘটে শহরে । বদলে যায় শহরের সংস্কৃতি ।
অন্যদিকে পরবর্তীতে স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের শিল্প স্থাপনে বার্নপুর, কুলটিতে আধুনিক জনপদ গড়ে ওঠে । আসানসোলে ইস্ট ইন্ডিয়া রেল তৈরি করে ‘ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউট’ বা ডুরান্ড ইন্সটিটিউট । সেখানে শুরু হয় রক, কাউন্ট্রি মিউজিকের কনসার্ট । আসানসোলে এসেই টেরি মরিস আকর্ষিত হয়ে পড়েন মিউজিকের প্রতি । তিনি বলেন, ‘‘খ্রিস্টান ব্রাদার হ্যারিসনের কাছে প্রথম গিটারের পাঠ নেওয়া আমার । এছাড়া গিটার ও গানের জন্য সেন্ট ভিনসেন্ট হাই ও
টেকনিক্যাল স্কুলের ব্যান্ড মাস্টার বার্নার্ড লিনকনের কাছেও চলতে থাকে প্রশিক্ষণ । 12 বছর বয়সেই আমি প্রথম গান কম্পোজ করি ।"
সেন্ট ভিনসেন্ট স্কুলেই গড়ে ওঠে ব্যান্ড ‘দ্য হেলস্টোনস’ (The Hailstones) । টেরি মরিস নিজগুণেই সেই ব্যান্ডের লিডার হয়ে ওঠেন । সেই সময় ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউট বা ডুরান্ড ইন্সটিটিউটে প্রচুর কনসার্টে অংশ নিয়েছে টেরি পরিচালিত সেই ব্যান্ড । পাশাপাশি অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নৃত্যের অনুষ্ঠানেও টেরি মরিস একজন মিউজিসিয়ান ও গায়ক হিসেবে যোগ দিয়েছেন । কিশোর থেকে যুবক হওয়ার পথে ‘দ্য ট্রিপ’ নামে আরও একটি ব্যান্ডের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন টেরি মরিস ।
বিটলস (Beatles)-সহ বিভিন্ন ব্যান্ডের গান তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে । কাউন্ট্রি গায়ক মারলে হ্যাগার্ড (Merle Haggard), জনি ক্যাস (Johnny Cash) তাঁর আইডল হয়ে যায় । রক অ্যান্ড রোল, পপ, কাউন্ট্রি মিউজিকে বুঁদ হয়ে যান টেরি মরিস । 60 ও 70-এর দশকে প্রচুর নিজেদের কম্পোজিশন তৈরি করেন টেরি । তখন থেকেই দেশের বিভিন্ন কোনায় টেরির নাম ছড়াতে শুরু করে ।
1971 সালে গ্র্যাজুয়েশনের পর বিয়ে করেন টেরি মরিস । দুই সন্তান হয় তাঁদের । সেই সময় লোকো কোয়ার্টারে থাকতেন তাঁরা । স্বামী স্ত্রী দু’জনেই ইস্কো কারখানায় চাকরিতে যোগ দেন । বেশ কয়েকবছর চাকরি করেছিলেন তাঁরা । এরপর টেরি আসানসোল এজি চার্চ স্কুলের (A.G. Church School) তত্বাবধায়ক বা কেয়ারটেকার হিসেবেও কাজে যোগ দেন ।
কিন্তু গান বাজনা থেমে থাকেনি । ঠিক এই সময়ে আসানসোলে বেশ কয়েকটি ওয়েস্টার্ন ব্যান্ডের আত্মপ্রকাশ ঘটে । ‘দ্য রক রিভাইভাল’ (The Rock Revival) নামে একটি ব্যান্ডে লিড সিঙ্গার ও গিটারিস্ট হিসেবে যোগ দেন টেরি । বেশ কয়েকবছর সেই ব্যান্ডের সঙ্গে সঙ্গীত চর্চায় বুঁদ হয়ে থাকেন তিনি । এই সময় প্রচুর পপ গান তৈরি করেন টেরি । 1982 সালে পাকাপাকি ভাবে ভারত ছেড়ে চলে যান তিনি । প্রথমে ইংল্যান্ড । পরবর্তী কালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ।
সেখানে টেরি'র স্ত্রী একজন সফল ব্যবসায়ী নারী । টেরি রয়ে গিয়েছেন সঙ্গীতের দুনিয়ায় । গোটা বিশ্বে আজ তাঁর লক্ষ লক্ষ ফ্যান । অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ড ‘দ্য ইকোস’-এর সদস্য টেরি । দেশে বিদেশে প্রচুর কনসার্ট করেন। দুবাই থেকে 2011 সালে টেরির অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছিল । সেই অ্যালবাম হাজার হাজার মানুষ কিনেছিলেন ।
বিশ্ব সঙ্গীতে আজ পরিচিত মুখ টেরি মরিস । কিন্তু আজও ভুলতে চান না তাঁর প্রিয় শহর আসানসোলকে । আর তাই সেই নস্টালজিয়া থেকেই তিনি লিখেছিলেন ‘দ্য স্ট্রিট অফ আসানসোল’ গানটি । যা ভাইরাল হয়ে যায় । আজও আসানসোলের নাম শুনলে আবেগে ভাসেন টেরি ।
ইটিভি ভারতকে তিনি বললেন "আসানসোলের অনেক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ আছে আজও । সেই যোগ আমি আমৃত্যু রাখতে চাই । জীবনের অন্যতম প্রিয় শহর আসানসোল । যে শহর আমার অনেক কিছু জানে । যে শহরে আমার শেকড় আছে । ভালোবাসি আসানসোলকে ।''
আরও পড়ুন : এক মঞ্চে শহরের 'কিশোরকুমার'রা সংবর্ধিত, নস্টালজিয়ায় ভাসল আসানসোল