পূর্ব বর্ধমান, 5 অক্টোবর : পূর্ব বর্ধমানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মা সর্বমঙ্গলা ৷ কথিত আছে, দেবী অধিষ্ঠীত হন দুপুর বেলা ৷ সর্বমঙ্গলার প্রাচীনত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়, রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে ৷ ষষ্ঠ শতকের অনুলিখিত কুব্জিকাতন্ত্র গ্রন্থে শ্রী বর্ধমান মঙ্গলাদেবী পীঠের উল্লেখ আছে ৷ এমনকি মঙ্গলকাব্যেও সর্বমঙ্গলা দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় ৷
কথিত আছে, বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা এলাকায় তখন বেশিরভাগ ছিল জলাজমি ও ধানক্ষেত ৷ এলাকায় অনেক পুকুর ঘাট ছিল ৷ ওই সব পুকুরে মাছ, গুগলি ও কাঁকড়া ধরা হত ৷ এইভাবেই একদিন মাছ ধরতে গিয়ে একজনের জালে একটা শিলার মতো পাথর উঠে আসে ৷ সেই পাথরের উপরে চলত গুগলি ও শামুক থেঁতো করার কাজ ৷ এদিকে গুগলি ও শামুকের সঙ্গে ওই শিলাকেও আগুনে পোড়ানো হতে থাকে ৷ কিন্তু, আগুনে ওই শিলার কোনও ক্ষতি হয়নি ৷
একদিন রাতে বর্ধমানের মহারাজা চিত্র সেনকে স্বপ্নে দেখা দেন মা সর্বমঙ্গলা ৷ রাজা জানতে পারেন রাজবাড়ির পাশে যে চুনের ভাটা আছে, সেখানে শিলা রূপে তিনি পড়ে আছেন ৷ রাজা ওই মূর্তি উদ্ধার করতে গেলে জানতে পারেন তিনজন ব্রাহ্মণ পুজো করার জন্য ওই শিলামূর্তি নিয়ে গিয়েছেন। এর পর রাজা ওই তিন ব্রাহ্মণের কাছে স্বপ্নের কথা জানিয়ে মূর্তি আনতে যান ৷ কিন্তু, তাঁরা সেই মূর্তি দিতে অস্বীকার করেন ৷ পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে রাজা ব্রাহ্মণদের রাজি করান ৷ প্রায় তিনশো বছর আগে রাজার তৈরি ওই মন্দিরে পুজো শুরু হয় ৷
আরও পড়ুন : Mankundu Durga Puja: মানকুণ্ডুর খাঁ বাড়িতে অষ্টধাতুর দেবী ‘জয়দুর্গা’ রূপে পূজিত হন
দেবী সর্বমঙ্গলা অষ্টাদশভূজা ৷ কালো কষ্টি পাথরে তৈরি ৷ তাঁর চরণতলে আছে মহিষ এবং অসুর ৷ ত্রিশূল দিয়ে মা অসুরকে বধ করছেন ৷ পুরাতত্ত্ব অনুযায়ী, এই মূর্তিকে মন্বন্তরা মূর্তি বলা হয় ৷ মূর্তির পাদদেশে একটা লেখা আছে ৷ বর্ধমানের রাজা ওই লেখা থেকে ছাঁচ তৈরি করে তা পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করেছিলেন ৷ কিন্তু, সেই লিপিটি কোন ভাষায় লেখা রয়েছে তা আজও জানা সম্ভব হয়নি ৷
আরও পড়ুন : Durga Puja Dhak Story: পুজোয় বায়না নেই, বিড়ি বাঁধছেন অশোকনগরের মহিলা ঢাকিরা
রাজ আমল থেকেই প্রতিপদে ঘট স্থাপনের মধ্যে দিয়ে এখানে পুজোর সূচনা হয় ৷ নবমী পর্যন্ত চলে বিশেষ পুজোপাঠ ৷ সর্বমঙ্গলা মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটা প্রায় পাঁচ ফুট লম্বা কামান ছিল ৷ অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে কামান থেকে তোপ চালানো হত একসময় ৷ যে তোপের আওয়াজ শুনে অষ্টমীর সন্ধিপুজো শুরু হতো ৷ শুধু বর্ধমান জেলা নয়, জেলার আশেপাশে অনেক দূর-দূরান্তে এই আওয়াজ শোনা যেত বলে কথিত আছে ৷ সেই আওয়াজ শুনেই বিভিন্ন জায়গার পুজো শুরু হত ৷ 1997 সালে সন্ধিপুজোর আগে তোপ দাগার সময় কামান ফেটে দুর্ঘটনা ঘটে ৷ তারপর থেকেই কামান চালানো বন্ধ হয়ে যায় ৷
আরও পড়ুন : Durga Puja : ঘরের মেয়ে উমাকে বরণ করতে সাজো সাজো রব সাঁকরাইলের পালবাড়িতে
বর্ধমান সর্বমঙ্গলা মন্দিরের প্রধান পুরোহিত অরুণ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রায় 300 বছর আগে বর্ধমানের মহারাজ এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ৷ দেবী এখানে অষ্টাদশভূজা ৷ কালো কষ্টিপাথরের মূর্তি ৷ সারাবছর এখানে রোজ পুজো হয় ৷ শারদীয়ায় প্রতিপদে ঘট আনা থেকে শুরু করে এখানে পুজোর সূচনা হয় ৷ নবমীতে নয় কুমারীর পুজো করা হয় ৷ 1958 সালে মহারাজাধিরাজ উদয় চাঁদ মহাতপ সর্বমঙ্গলা ট্রাস্ট গঠন করেন ৷ এই ট্রাস্টই এখন পুজো এবং মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করে ৷ তবে, সারাবছরই দেবীর জন্য রাজকীয় আয়োজন করা হয় ৷ নিত্যদিন ভোরবেলা দেবীকে গঙ্গা জলে স্নান করিয়ে দামি গহনা দিয়ে সাজিয়ে সিংহাসনে বসানো হয় ৷’’
আরও পড়ুন : Durga Puja : সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনলাইনে টালা প্রত্যয়ের দুর্গাপুজো
মন্দিরের সহকারী পুরোহিত সুখেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘করোনা আবহের জন্য প্রশাসনের নিয়ম মেনে এবার পুজো করা হচ্ছে ৷ মন্দিরে যাতে ভক্তরা নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে পুজো দিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ রাখা হয়েছে মাস্ক ও স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও ৷’’
কীভাবে যাবেন সর্বমঙ্গলা মন্দিরে ?
বর্ধমান স্টেশন থেকে জি টি রোড ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই মিলবে কার্জনগেট ৷ কার্জন গেটের ভিতর দিয়ে বিসি রোড থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার গেলেই একটি চৌমাথা মোড় রয়েছে ৷ যা সর্বমঙ্গলা বাড়ির মোড় নামে পরিচিত ৷ ওই চৌমাথার বাঁ দিকের রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই সর্বমঙ্গলা মন্দির ৷ এছাড়া স্টেশন থেকে টোটো কিংবা রিক্সা করেও সহজেই পৌঁছানো যায় সর্বমঙ্গলা মন্দিরে ৷