দেশের প্রথম পূর্ণ সময়ের মহিলা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের সামনে অপেক্ষা করছে এক কঠিন সময়৷ মোদি সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর পর নিম্নমুখী অর্থনীতিকে ফের ঊর্ধ্বগামী করার গুরুভার এসে পড়েছে তাঁর উপরই ৷ এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে ফের সচল করা ৷
শনিবার অর্থমন্ত্রী হিসেবে নির্মলা সীতারমন দ্বিতীয়বার বাজেট পেশ করতে চলেছেন ৷ গতবছরের জুলাইয়ে তাঁর প্রথম বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিলেন, তা পূরণ হওয়া প্রায় অসম্ভব ৷ সর্বশেষ সরকারী তথ্য অনুসারে, চলতি আর্থিক বছরের প্রথম আট মাসে (এপ্রিল থেকে নভেম্বর) কেন্দ্রীয় সরকারের মোট কর সংগ্রহ হয়েছে 7.5 লাখ কোটি টাকা ৷ এই অর্থবছরে 16.5 লাখ কোটি টাকা কর সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছিল সরকার ৷ ফলে নভেম্বর পর্যন্ত সেই লক্ষ্যমাত্রার কেবল 45.5 শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে ।
অরুণ জেটলির প্রয়াণের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের অর্থনীতি সামলানোর দ্বায়িত্ব তুলে দেন নির্মলা সীতারমনের হাতে ৷ দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি 2.0 -র সূচনার পর থেকেই ভারতের নিম্নমুখী অর্থনীতি সামলানোর চেষ্টা করেন নির্মলা সীতারমন ৷ কিন্তু, তা সফল হয়নি ৷
2018-19 অর্থবছরের শেষ ভাগে GDP-র বৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছিল 5.8 শতাংশে ৷ 2019-20 অর্থবছরের প্রথম ভাগে (এপ্রিল-জুলাই) সূচক দাঁড়ায় 5 শতাংশ ৷ অর্থবর্ষের দ্বিতীয়ভাগে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) তা আরও কমে 4.5 শতাংশে এসে পৌঁছায় ৷ 2012-13 সালের শেষ ভাগের পর এই প্রথম অর্থনীতির সূচকের এত ব্যাপক হারে পতন হয় ৷ 2019 সালের জুলাইয়ে পেশ করা বাজেটে রাজস্ব আদায় নিয়ে যে ছবি তুলে ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী, তা এখনও অনেক দূরে ৷
‘ইন্ডিয়া রেটিং’ সংস্থার প্রধান অর্থনীতিবিদ সুনীল সিনহা বলেন, "এই মুহুর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল অর্থনীতিকে সচল করা ৷ অর্থনীতির বৃদ্ধি থমকে দাঁড়ানোয় রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতাও প্রভাবিত হয়েছে ৷"
CGA (কন্ট্রোলার জেনেরাল অব অ্যাকাউন্টস)-র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতীয় অর্থনীতির রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার কর্পোরেশন করেও পতন চোখে পড়ার মতো ৷ গত অর্থবর্ষের প্রথম 8 মাসের সঙ্গে তুলনায় এই অর্থবর্ষে কর আদায়ের পরিমাণে পতন হয়েছে 2652 কোটি টাকা ৷ 2018-19 আর্থিক বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসে কর্পোরেশন কর বাবদ আয় হয়েছিল 2,91,254 কোটি টাকা ৷ আর চলতি আর্থিক বছরে ওই 8 মাসে আয় হয়েছে 2,88,602 কোটি টাকা৷
বৃহত্তর চিত্রে এই তফাত খুব সামান্য ৷ কিন্তু অর্থমন্ত্রী গত বাজেটে বলেছিলেন কর্পোরেশন কর আদায় এই আর্থিক বছরে 14.15 শতাংশ বৃদ্ধি পাবে ৷ 2018-19 আর্থিক বছরে আদায় হওয়া 6.71 লাখ কোটি টাকার তুলনায় এই আর্থিক বছর অর্থাৎ 2019-20 সালে কর আদায় হবে 7.66 লাখ কোটি টাকা৷ এই লক্ষ্য অপূর্ণ থাকার সম্ভাবনাই বেশি৷
গতবছরের সেপ্টেম্বরে কর্পোরেট কর রেটে ছাড় ঘোষণার পর অর্থনীতির হাল আরও খারাপ হতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা ৷ যার প্রভাব এই বছরের বাজেট পেশের পরই কিছুটা জানা যাবে ৷ এবং 2021 সালের বাজেটেই এই কর ছাড়ের ফলে রাজস্ব আদায় ও লাভ-লোকসানের সঠিক চিত্র জানা যাবে৷
তবে কর ছাড়ের বিরূপ প্রভাব সেপ্টেম্বরে ঘোষণার পরের দুই মাসে অর্থ্যাৎ অক্টোবর ও নভেম্বরেই টের পাওয়া গেছে ৷ অক্টোবর, 2019-এ আদায় হওয়া কর্পোরেশন করের পরিমাণ ছিল 23,429 কোটি টাকা ৷ যেখানে 2018 সালের ওই মাসে এর পরিমাণ ছিল 26,648 কোটি টাকা ৷ নভেম্বরে পতনের হার আরও বেড়ে কর্পোরেশন কর আদায়ের পরিমাণ 15,846 কোটি টাকায় দাঁড়ায় ৷ যা 2018 সালের ওই মাসে ছিল 20,864 কোটি টাকা ৷
এর ফলে চলতি আর্থিক বছরের প্রথম আট মাসে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার মাত্র 45.5 শতাংশ ৷ 2018-19 আর্থিক বছরে এই আট মাসে যা ছিল লক্ষ্যমাত্রার 49.4 শতাংশ ৷
GST ও আয়কর বাবদ আদায় করা অর্থের পরিমাণ সামান্য বৃদ্ধি পেলেও অর্থনীতিবিদদের মতে, পরিস্থিতি বিগত কয়েক মাসের তুলনায় আরও খারাপ হতে পারে ৷ উল্লেখ্য, বাজেট অনুযায়ী GST বাবদ 6.63 লাখ কোটি টাকা ও আয়কর বাবদ 5.69 লাখ কোটি টাকা আয় হয়েছে ৷
ETV ভারত কে সুনীল সিনহা বলেন, "আমাদের হিসাব অনুযায়ী গত বছর কর্পোরেট ট্যাক্স রেটে ছাড় ঘোষণার পর সরকারের কর বাবদ আয়ের পরিমাণ বাজেটে প্রকাশিত অঙ্কের তুলনায় 1.7 থেকে 1.8 লাখ কোটি টাকা কম হবে ৷ আমাদের হিসাব অনুযায়ী এই বছর কর বাবদ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ সরকারের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী 1.45 লাখ কোটি টাকা নয় ৷ আয় হবে 70 থেকে 80,000 কোটি টাকা ৷ তবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় মিলিয়ে মোট আদায়ের পরিমাণ দাঁড়াবে 1.7-1.8 লাখ কোটি টাকা ৷"
সম্প্রতি রয়টার্সের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বছর প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় কম হবে ৷ যদি এই অনুমান সত্য হয়, তাহলে বিগত দুই দশকে এই ঘটনা প্রথমবার ঘটবে ৷
নির্মলা সীতারমন গতবছরের জুলাইয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে বলেছিলেন, প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ 11.25 শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে ৷ 2018-19 অর্থবর্ষে আদায় হওয়া 12 লাখ কোটি টাকা 2019-20 অর্থবর্ষে বেড়ে দাঁড়াবে 13.35 লাখ কোটি টাকায়৷ অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পিছনে যথেষ্ট কারণও আছে, বিগত দুটি অর্থবর্ষে বাণিজ্যিক ও ব্যক্তিগত কর বাবদ আয়- উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ 2017-18 সালের তুলনায় 2018-19 সালে এক লাখ কোটি টাকা আয় বৃদ্ধি হয়েছে৷
2017-18 অর্থবর্ষে কর্পোরেশনে কর বাবদ আয় হয়েছিল 5.71 লাখ কোটি টাকা ৷ সেই অনুযায়ী 2018-19 অর্থবর্ষে কেন্দ্রের কর্পোরেশন কর আয়ের লক্ষ্য রাখা হয়েছিল 6.21 লাখ কোটি টাকা ৷ লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে কর্পোরেশন কর আয় হয় 6.71 লাখ কোটি টাকা ৷ যা তার আগের অর্থবর্ষের চেয়ে এক লাখ কোটি টাকা বেশি ৷
একইভাবে, 2017-18 সাল থেকে 2018-19 সালে আয়কর বাবদ আয়ের পরিমাণও বেড়ে 4.31 লাখ কোটি টাকা থেকে 5.71 লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে ৷ অর্থাৎ এক লাখ কোটি টাকা আয় বেড়েছে৷
তবে কর বাবদ আয় বৃদ্ধির ফলে লাভের চিত্র বদলে গেল এক বছরেই ৷ কারণ GDP বৃদ্ধি 5.8 শতাংশ থেকে মাত্র নয় মাসে কমে দাঁড়ায় 4.5 শতাংশে ৷
সুনীল সিনহা বলেন, GDP বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে বলা হয়েছিল কেন্দ্রের আয় তাদের লক্ষ্য আয়ের তুলনায় 1.7 লাখ কোটি টাকা কম হবে GDP বৃদ্ধিকে 5.5 বা 5.6 শতাংশ ধরে৷ বর্তমানে বহু সংস্থাই GDP বৃদ্ধির হার 5 শতাংশের কম হবে বলে মনে করছেন ৷
এই মাসেই IMF ( ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড) দেশের GDP বৃদ্ধি 4.8 শতাংশে কমে দাঁড়াবে বলে অনুমান করেছে ৷
তবে অর্থমন্ত্রীর সমস্যার ইতি এখানেই শেষ নয় ৷ সুনীল সিনহা জানান, "আমরা আপাতত 5.5-5.6 শতাংশ GDP বৃদ্ধিকে মাথায় রেখেই রাজস্ব আদায়ের হিসাব করছি, যা আসল GDP বৃদ্ধির হার ৷ কিন্তু আয়কর আদায়ের পরিমাণ নির্ভর করে ন্যূনতম GDP বৃদ্ধির উপর, আসল GDP বৃদ্ধির হারের উপর নয় ৷"
অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ভাগে( জুলাই-সেপ্টেম্বর) ন্যূনতম GDP বৃদ্ধি হার ছিল 8 শতাংশ, যেখানে বাজেটে কেন্দ্রের অনুমান ছিল 11 থেকে 12 শতাংশ ৷ প্রকৃত GDP বৃদ্ধির হার ন্যূনতম GDP থেকে পাইকারি দামের হার (WPI) কে বাদ দিয়ে গণনা করা হয় ৷ তার মধ্যে অন্তর্গত থাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি দেশের মোট দেশীয় উৎপাদন মূল্যের ফলে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ৷
সুনীল সিনহা ভারত রেটিংয়ের জন্য ম্যাক্রো-ইকোনমিক সূচকগুলি নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছেন ৷ তিনি বলেন, যে পথই গ্রহণ করুক না কেন, সরকার অনুমানিক কর সংগ্রহের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরেই থাকবে ৷
(প্রতিবেদনটি লিখেছেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক কৃষ্ণানন্দ ত্রিপাঠী)