কলকাতা, 14 অক্টোবর: দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর অবেশেষে সাংগঠনিক রদবদলের পথে হাঁটছে কংগ্রেস (Congress President Election) ৷ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের সভাপতি বেছে নিতে চলেছে কংগ্রেস ৷ প্রায় 20 বছর বাদে আবারও নির্বাচন হবে কংগ্রেসর শীর্ষপদের জন্য ৷ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ধরলে এই নির্বাচন (Congress President Election 2022) বেশ কয়েকটি কারণে বাকিগুলোর থেকে আলাদা ৷
কংগ্রেসের সভাপতি পদে এবার লড়াই হচ্ছে দলের দুই হেভিওয়েট নেতার মধ্যে ৷ মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং শশী থারুর ৷ দু'জনেই প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী । দুই দক্ষিণ ভারতীয়র এই লড়াই ইতিমধ্যেই জমে উঠেছে ৷ রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ মনে করে এই লড়াইটা আরও জমাটি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা ছিল ৷ কিন্তু সভাপতি নির্বাচন থেকে এক প্রাক্তন ও এক বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সরে যাওয়ায় লড়াই হচ্ছে শশী থারুর (Shashi Tharoor) এবং মল্লিকার্জুন খাড়গের (Mallikarjun Kharge) মধ্যে ৷
কংগ্রেসের নির্বাচনের খবর যখন প্রথম প্রকাশ্যে আসে সে সময় বাকিদের থেকে খানিকটা হলেও এগিয়ে ছিলেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলত (Ashok Gehlot) ৷ প্রায় সেই সময়ই শশী থারুরের নামও ঘুরতে শুরু করে রাজনৈতিক মহলে ৷ জানা যায় সোনিয়া গান্ধির সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনে লড়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছেন রাষ্ট্রসংঘে (UNO) ভারতের এই প্রাক্তন প্রতিনিধি ৷ কিন্তু দলীয় অসন্তোষে লড়াই থেকে সরতে হয় অশোককে ৷ কংগ্রেসের একটি অংশ চেয়েছিল অশোকের জায়গায় মুখ্যমন্ত্রী করা হোক ডেপুটি সচিন পাইলটকে (Sachin Pilot) ৷
কিন্তু অশোক ঘনিষ্ঠ বিধাযকদের একটা বড় অংশের বিধায়কই সচিনকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাননি ৷ তাঁরা ইস্তফা পর্যন্ত দিয়ে দিন ৷ বিধায়কদের এই আচরণ মেনে নিতে পারেনি দলের হাইকমান্ড (Congress High Command) ৷ অস্বস্তিতে পড়েন অশোক নিজেও ৷ দিল্লি গিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি ৷ তবে কাজের কাজ হয়নি ৷ দলের শীর্ষপদে বসার আশা পরিত্যাগ করে মরুরাজ্যের মসনদ নিয়েই খুশি থাকতে হল অতীতের জাদুকরকে ৷ মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দ্বিগবিজয় সিংও একটা সময় সভাপতি আসনে বসার আগ্রহ দেখান ৷ কিন্তু দলের একটা বড় অংশই তাঁকে সমর্থন না-ও করতে পারেন ধরে নিয়ে রণেভঙ্গ দেন একদা রাহুল গান্ধির রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ৷ নানা সমীকরণের শেষে লড়াইটা এসে দাঁড়াল দুই নেতার মধ্যে ৷ বিপুল রাজনৈতিক টানাপোড়েন ছাড়াও এই নির্বাচনের বেশ কয়েকটি বিশেষ দিক আছে ৷
আরও পড়ুন: কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনের প্রচারে বঙ্গে আসছেন খাড়গে-থারুর
কংগ্রেসের দুর্দিনে ভোট
সেই শুরু থেকে শেষ 137 বছরে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের পথে হেঁটেছে কংগ্রেস (Indian National Congress) ৷ একসময় নেতাজিও (Netaji Subhash Chandra Bose ) নির্বাচনের মধ্য়ে দিয়ে সভাপতি হয়েছেন ৷ পরে এই সাংগনিক নির্বাচনে জিতে দলের সভাপতি তথা স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর পদ নিশ্চিত করেছিলেন জওহরলাল নেহরু (Jawaharlal Nehru) ৷ সেবার তাঁর সামনে ছিলেন ভারতীয় রাজনীতির লৌহপুরুষ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল (Sardar Vallabhbhai Patel) ৷ জানা যায় সেসময় দেশের বেশিরভাগ প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি সর্দারকেই সভাপতি চেয়েছিল ৷ কিন্তু গান্ধিজি চেয়েছিলেন নেহরুকে ৷ এরপরের ইতিহাস সবার জানা ৷ স্বাধীন ভারতের প্রথম কয়েকটি দশক কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচন নিয়ে তেমন বড় কোনও রাজনৈতিক টানাপোড়েন তৈরি হয়নি ৷ জওরহরলাল নেহরু থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধি (Indira Gandhi) বা কে কামরাজ (k kamaraj ) এবং নিজলিঙ্গাপারা (S.Nijalingappa) দলের রাশ নিজেদের হাতে রেখেছিলেন প্রায় বিতর্কহীনভাবেই ৷
ছয়ের দশকের মাঝামাঝি লালবাহাদুর শাস্তির মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে টানাপোড়েন চরমে ওঠে ৷ সেসময় কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে সবার আগে সুযোগ ছিল কে কামরাজের কাছে ৷ কিন্তু তিনি রাজি হননি ৷ সেসময় রাজনৈতিক মহলে তাঁর একটি কথা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ৷ তিনি বলেছিলেন, "নো হিন্দি, নো ইংলিশ, হাউ!" মানে হিন্দি তাঁর ভালো আসে না ৷ ইংরেজিতেও তেমন দক্ষ নন ৷ এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হবেন কী করে ? যাই হোক ইন্দিরার হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব দিয়ে জাতীয় রাজনীতির নতুন ইতিহাস রচনা করেন কংগ্রেস নেতারা ৷
সাতের দশক ইন্দিরার দশক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে ৷ জরুরি অবস্থার পর কংগ্রেসের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া এবং প্রথম অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী হওয়া সেই সাতের দশকেই ৷ আটের দশকের শুরুতেই ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস ৷ ওই সময় একশো বছরে পা দেয় কংগ্রেস ৷ তখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি দলের ভারও রাজীবের হাতে ৷ ইন্দিরা-তনয় দলের বৃদ্ধতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন ৷ নয়ের দশকে কংগ্রেসের উপর চাপ বাড়ে ৷ মাঝামাঝি সময়ে ক্ষমতা থেকেও সরে যেতে হয় শতাব্দী প্রাচীন দলকে ৷ এরপর নতুন শতকের গোড়াতেই ভোট হয় কংগ্রেসের সভাপতি পদে ৷ তখনও দল ক্ষমতায় নেই ৷ কিন্তু তাও পরিস্থিতি এখনকার মতো খারাপ ছিল না ৷ লোকসভায় সাংসদ সংখ্যা দু'সংখ্যায় নেমে যায়নি ৷ এখনকার পরিস্থিত সেটাই ৷ আর তাই ঘুরে দাঁড়াবার লড়াইটাও অনেকটাই কঠিন কংগ্রেসের কাছে ৷
আরও পড়ুন: কংগ্রেসের সভাপতি পদের ভোটে শশীর আসল প্রতিপক্ষ বেণুগোপাল
গান্ধিরা নেই কিন্তু আছেন
কংগ্রেস সভাপতি পদ আর গান্ধি পদবীর মধ্যে একটা এমন সম্পর্ক আছে যাকে চিরন্তন বললেও কম বলা হয় ৷ 137 বছরের মধ্যে গান্ধিরা কংগ্রেসের সভাপতি থেকেছেন 50 বছর ৷ এবার তাঁরা নেই ৷ সংখ্যা থেকেই স্পষ্ট গান্ধিদের বাদ দিয়ে কংগ্রেসর সভাপতি নির্বাচন আগেও হয়েছে ৷ কিন্তু এবার দলের মধ্যে গান্ধিদের যে পরিমাণ বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে তা আগে হয়নি ৷ রাজনৈতিক মহলের অনেকেই মনে করেন, এই বিরোধিতার জন্যই সভাপতি নির্বাচন থেকে সরেছেন গান্ধিরা ৷ কিন্তু প্রার্থী না হলেও কংগ্রেস নির্বাচন গান্ধিদের ছাড়া অসম্পূর্ণ ৷ তাই নেপথ্যে থেকে তাঁদের ভূমিকা সভাপতি নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করবে ৷ এই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন শশী থারুর ৷ তিনি বলেছেন গান্ধিরা এই নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন ৷ কিন্ত এই মন্তব্য করার ঠিক 24 ঘণ্টার মধ্যেই সোনিয়া গান্ধির সঙ্গে এক ফ্রেমে দেখা যায় খাড়গেকে ৷ এখানেই প্রশ্ন গান্ধিরা কি সত্যি নিরপেক্ষ? তাছাড়া গান্ধি ঘনিষ্ঠ আরও বেশ কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যেই খাড়গের হয়ে সওয়াল করেছেন ৷ তাতে গান্ধিদের ভূমিকা কতটা সেটাও জরুরি প্রশ্ন ৷
আরও পড়ুন: খাড়গের পক্ষে, শশীর জন্য শুধু শো অফ, মনোভাব বিধান ভবনের !
রাহুল গান্ধির ভূমিকা
এই পর্যন্ত কংগ্রেসের শেষ স্থায়ী সভাপতি রাহুল গান্ধি এই নির্বাচনে কোন ভূমিকায় থাকছেন সেটা রহস্য়ের ৷ এমনিতে তিনি এই নির্বাচনের প্রার্থী নন ৷ শুধু তাই নয় রাহুল এখন দিল্লিতেও নেই ৷ তবু কংগ্রেসের সর্বত্রই তিনি আছেন ৷ প্রবলভাবে আছেন ৷ রাহুল কোনদিকে তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে ৷ তাঁর অনুগামীরা রাহুলকেই সভাপতি চেয়েছিলেন ৷ কিন্ত নির্বাচনে তিনি না থাকায় এই অনুগামীদের সমর্থন কোন দিকে যাবে ? শুধু তাই নয় তাতে রাহুলের ভূমিকা কতটা থাকবে তার উপরও কংগ্রেস, সভাপতি নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করবে ৷