হায়দরাবাদ, 29 অক্টোবর: ধারাবাহিক বিস্ফোরণে রবিবার কেঁপে ওঠে কেরলের এর্নাকুলামের কালামাসেরির একটি কনভেশন সেন্টার ৷ ওই কনভেনশন সেন্টারে এদিন জেহভা'স উইটনেসেস নামে একটি খ্রীষ্টান ধর্মীয় গোষ্ঠীর তরফে প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল ৷ বিস্ফোরণের সময় সেখানে প্রার্থনাসভা চলছিল ৷ এই বিস্ফোরণের বলি হয়েছেন 1 জন, আহত কমপক্ষে 50 জন ৷ তাঁদের মধ্যের 6 জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক ৷ এই বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে থানায় আত্মসমর্পণও করেছেন ডমিনিক মার্টিন নামে এক ব্যক্তি ৷ আত্মসমর্পণের আগে সোশাল মিডিয়ায় এক ভিডিয়োবার্তায় ওই ব্যক্তি নিজেকে ওই গোষ্ঠীর প্রাক্তন সদস্য বলেও দাবি করেছেন ৷ এই ধর্মীয় গোষ্ঠীটি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ও শিশুদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ ডমিনিকের ৷ আত্মসমর্পণকারী ব্যক্তি জেহভা'স উইটনেসেস নামে ওই খ্রিষ্টান ধর্মীয় গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ করে বলেছেন, এদের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার উপর কোনও বিশ্বাস নেই ৷
কারা এই জেহভা'স উইটনেসেস ?
জেহভা'স উইটনেসেস হল একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী, এরা খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী ৷ জানা গিয়েছে, এই গোষ্ঠীটির আদর্শ ও বিশ্বাস মূলধারার খ্রিষ্টধর্মের থেকে আলাদা ৷ এই ধর্মীয় গোষ্ঠীটির ওয়েবসাইট jw.org তে বলা হয়েছে, বিশ্বে তাদের সদস্য সংখ্যা 86 লক্ষেরও বেশি ৷ মার্কিন বাইবেল স্কলার চার্লস টাইস রাসেল 1876 সালে ওই গোষ্ঠীটির সূচনা করেন ৷ বাইবেল স্টুডেন্টস নামক একটি নিরপেক্ষ বাইবেল শিক্ষামূলক সংগঠন পরে জেহভা'স উইটনেসেসের সঙ্গে মিশে যায় ৷ এই গোষ্ঠীটির সদস্যরা জেহভা নামক ভগবানকে সৃষ্টিকর্তা বলে মনে করেন ও তার উপাসনা করেন ৷ অন্য খ্রিষ্টান চার্চগুলি যেখানে ট্রিনিটিতে বিশ্বাসী, সেখানে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা মনে করেন যিশু ভগবান নন, বরং তিনি ছিলেন ভগবানের দূত ৷
এই গোষ্ঠীটি মনে করে যিশু হলেন 'ভগবানের সন্তান' ৷ তাদের ওয়েবসাইটে লেখা, "আমরা যিশুখ্রিষ্টের দেওয়া শিক্ষাকে মানি এবং আমাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে তাকে সম্মান করি ৷ তিনি আমাদের কাছে ভগবানের সন্তান ৷ তাই আমরা খ্রিষ্টান ৷ যাই হোক, আমরা বাইবেল থেকে জেনেছি যে যিশু সর্বশক্তিমান ভগবান নন, ট্রিনিটি মতবাদেরও কোনও পুঁথিগত ভিত্তি নেই ৷ "
আরও পড়ুন: কেরল বিস্ফোরণকাণ্ডে ভিডিয়ো বার্তায় হামলার দায় স্বীকার করে থানায় আত্মসমর্পণ মার্টিনের
এই ধর্মীয় গোষ্ঠীটি বিশ্বাস করে, ভগবানের রাজত্ব স্বর্গথেকে চালানো হয় খুব দ্রুত পৃথিবীতে ভগবানের উদ্দেশ্য সাধিত হবে ৷ এই গোষ্ঠীটি বিশ্বাস করে, সমস্ত পাপীদের ধ্বংস করার পর, জেহভা ধার্মিকদের মৃত্যু, রোগ এবং বার্ধক্য থেকে মুক্ত জীবনদান করবেন। এই দলটি এও বিশ্বাস করে যে, জেহভা ভালো মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জীবন দেবেন ৷ এদের পুজোয় ক্রস, মূর্তি বা অন্যান্য প্রতীক ব্যবহার করা হয় না।
ওই ধর্মীয় গোষ্ঠীটির বিশ্বাস শুধুমাত্র বাইবেলের উপর ভিত্তি করে। যদিও তারা সম্পূর্ণ বাইবেল মেনে নেয়, তারা মৌলবাদী নয়। এদের মতে, বাইবেলের বেশিরভাগ অংশই রূপক ভাষায় বা প্রতীক ব্যবহার করে লেখা, এবং তারা সেগুলোকে আক্ষরিক অর্থে নেয় না। তারা সতর্কতা অবলম্বন করে এবং রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার, জাতীয় পতাকাকে অভিবাদন না করার, জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়া এবং সামরিক চাকরি না করার উপর জোর দেয়। এই অবস্থানের কারণে, তাদের কার্যকলাপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ অনেক দেশে আইনি লড়াই এবং নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছে ৷
কেরলে জেহভা'স উইটনেসেস:
এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর অন্তর্গত কিছু সদস্য 1905 সালে ধর্ম প্রচারের জন্য কেরলে এসেছিলেন । রাসালপূরম হল সেই জায়গা যেখানে প্রথম প্রচারক টিসি রাসেল 1911 সালে তিরুঅনন্তপুরম জেলায় প্রচার করেছিলেন । অনুমান করা হয়, কেরলে 15 হাজারেরও বেশি জেহভার সদস্য রয়েছেন ৷ তাদের প্রাথমিক কর্মসূচি ছিল মাল্লাপল্লী, মীনাদাম, পাম্পাদি, ভাকাথানাম, কাঙ্গাজা, আয়ারকুন্নাম এবং পুথুপল্লীর মতো এলাকায় ।
আরও পড়ুন: কেরলে বিস্ফোরণের পর দিল্লি জুড়ে হাই-অ্যালার্ট, গির্জায় বাড়ানো হল নিরাপত্তা
বর্তমানে কেরল রাজ্যজুড়ে জেহভা সাক্ষীদের উপস্থিতি রয়েছে। কেরলের অনেক অংশে বছরে তিনবার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই গোষ্ঠীটি 200টিরও বেশি জায়গায় কাজ করে। জেহভার অনুগামীরা দাবি করেন যে তাদের বার্ষিক সম্মেলনে 20 লক্ষেরও বেশি মানুষ যোগ দেন ৷ তবে তারা বড়দিন, ইস্টার বা জন্মদিন উদযাপন করে না।
1986 সালের জাতীয় সংগীত বিতর্ক:
1986 সালে কেরল এই ধর্মীয় গোষ্ঠীটি প্রথম জাতীয়স্তরে সকলের নজরে উঠে আসে ৷ সেবছর জাতীয় সঙ্গীত বিতর্কে আইনি লড়াইয়ে এই গোষ্ঠীটি জয় পায় ৷ জাতীয় সঙ্গীত গাইতে আপত্তি থাকায় এই গোষ্ঠীটির তিন শিশুকে একটি স্কুল থেকে বহিস্কার করা হয় ৷ কিডাঙ্গুরের এনএসএস হাইস্কুলের ঘটনা ছিল সেটি ৷ স্কুলটিতে জাতীয় সঙ্গীত চলার সময় তারা উঠে দাঁড়ালেও, গাইত না ৷ এটা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস বলে দাবি করেছিলেন শিশু তিনটির বাবা অধ্যাপক ভিজে ইমান্যুয়েল ও তাঁর স্ত্রী লিল্লিকুট্টি ৷ এরপর মামলাটি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায় ৷ 1986 সালের 11 অগস্ট রায় ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত ৷ আদালত এই শিশু তিনটিকে স্কুলে পড়া চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় ৷ এরপর ইমান্যুয়েলের তিন সন্তান ও ওই গোষ্ঠীটির সদস্য আরও 9 জন পড়ুয়া ওই স্কুলে যায় ৷ কিন্তু একদিন মাত্র স্কুলে যাওয়ার পরেই ইমান্যুয়েলের তিন সন্তান প্রথাগত শিক্ষাগ্রহণ ছেড়ে দেয় ৷