না না করেও দেড়টা বছর ! রাস্তার ধুলো, মাটির গন্ধ সে ভাবে গায়ে লাগেনি ৷ কিন্তু, এপ্রিল মাসের ওই দিনটা যখন জানতে পারলাম আমিও পজিটিভ, কী করব, কী ভাবব, কী বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না ৷ চোখ দুটো বুজে আসছিল ৷ ভয়ে-আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসছিল ৷
মনে তখন একটাই প্রশ্ন...
কী ভাবে...
যাই হোক, মনটাকে শক্ত করলাম ৷ এক নতুন লড়াইয়ের জন্য মনে মনে শপথ নিলাম ৷ নিজেকে বোঝালাম, আমার গোটা জীবনটাই তো সংগ্রামের ৷ লড়াইয়ের ৷ এবার না হয় আর একটা লড়াই ৷
শুরু করলাম করোনার বিরুদ্ধে লড়াই ৷ করোনা নিয়ে ঘর করা ৷ নিজেকে আরও বেশি করে গৃহবন্দি করে ফেললাম ৷ প্রথম দিকে বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারছিলাম না ৷ খেতে পারছিলাম না ৷ খিদে ছিল না ৷ সঙ্গে হাজারো ওষুধের চাপ ৷ আট-দশ দিন এ ভাবেই কেটে গেল ৷ তার পর একটু একটু করে ভাল হতে শুরু করলাম ৷ যেন বাঁচার আলো নিয়ে ওঠা সূর্যটাকে আবারও দেখতে শুরু করলাম ৷
ছোট থেকেই বই পড়তে বড্ড ভালবাসি ৷ এই করোনা যুদ্ধে বই-ই হয়ে উঠেছিল আমার এক মাত্র সঙ্গী-সখা-বন্ধু ৷ এই সময়টার জন্য বেছে নিয়েছিলাম লেখা-পড়া আর ঘরের কাজকে ৷ আর বেড়ালগুলোর দেখাশোনা ছিলই ৷
একটা কথা বলতেই হবে, কোভিড আক্রান্ত হয়ে আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ভয়ঙ্কর ভাবে হয়নি ৷ সব থেকে বড় কথা অক্সিজেনের দরকার পড়েনি ৷ যদিও ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম ৷ আমার পরিচিত ছিলেন, যাঁরা আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রয়োজনে ব্যবস্থা করে দেবেন ৷ তবে অক্সিজেনের দরকার পড়েনি ৷ আর হ্যাঁ, এখন আর কোনও সমস্যা নেই ৷
এপ্রিলের পনেরো তারিখ থেকে আমার উপসর্গগুলো লক্ষ্য করা গিয়েছিল ৷ দেড় বছর নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখার পরও এমন হল ৷ খারাপ লেগেছিল ৷ সাবধানেই ছিলাম ৷ কারণ আমার তো ডায়াবেটিস আছে, হাইপারটেনশন আছে... এজন্য বাড়তি সতর্ক ছিলাম ৷ এখন ভালই আছি ৷ পড়াশোনা, ঘরের কাজ আর বেড়ালদের নিয়ে সময় কাটছে ৷
আস্তে আস্তে সুস্থ হয়েছি ৷ ভাল আছি ৷ অবশ্যই শারীরিক ভাবে ৷ মানসিক ভাবে খুবই ভারাক্রান্ত ৷ নিজের জন্য নয় ৷ আমার দেশ, আমার পরিচিত বিশ্ব-জনের কথা ভেবে ৷ তাঁদের বিপদের কথা ভেবে ৷ কী চলছে গোটা বিশ্ব জুড়ে ৷ লাখো লাখো মানুষ মারা যাচ্ছেন ৷ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও তো কেউ নিজেকে নিরাপদ বলে দাবি করতে পারছেন না ৷ এই তো শুনলাম, এক পরিচিত চিকিৎসক দুটো ডোজ নেওয়ার পরও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৷ ডক্টর রাওয়াতের কথাটা শোনার পর থেকেই মনটা ভারাক্রান্ত ৷ আমিও তো একটি ডোজ নিয়েছিলাম ৷ তা-ও তো রক্ষা পেলাম না ৷ 9 মার্চ প্রথম ডোজ নিয়েছিলাম ৷ কিন্তু, কোথায় কী...
ভয়ঙ্কর একটা সময় চলছে ৷ দিল্লি তো শ্মশান হয়ে গিয়েছে ৷ কত লোক মারা যাচ্ছেন ৷ শ্মশানে জায়গা হচ্ছে না... পার্কিং প্লেস, পার্ক সব জায়গায় চিতা জ্বলছে ৷ হাসপাতালে বেড নেই ৷ অক্সিজেনের অভাব ৷ মানুষ ফুটপাতে বসে অক্সিজেন নিতে বাধ্য হচ্ছেন ৷ ফুটপাতে শুয়ে, অক্সিজেনের জন্য কাতরাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ ৷ এই দৃশ্যগুলো দেখে আমার নিজের কষ্টটা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে ৷ সেই মানুষ গুলোর জন্য কষ্ট পাচ্ছি ৷ ওদের জন্য কাঁদছি...
আরও পড়ুন: একবছর ঘরের বাইরে পা না রেখেও করোনায় আক্রান্ত তসলিমা