ETV Bharat / bharat

চারিদিকে প্রাণবায়ুর হাহাকার ! দায় কার ?

দেশের দৈনিক উৎপাদিত অক্সিজেনের গোটাটাই যদি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলেও দিনে 800 মেট্রিক টন ঘাটতি । যে 162 টি প্ল্যান্ট তৈরির পরিকল্পনার কথা হয়েছে, সেগুলি যদি সময়মতো তৈরি হয়ে যেত, তাহলে দিনে আরও 158 মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদিত হত । ঘাটতি তাতেও থাকত, তবে কিছুটা কমত ।

Oxygen Crisis
ছবি
author img

By

Published : Apr 28, 2021, 8:48 PM IST

Updated : Apr 28, 2021, 10:17 PM IST

মুম্বই ও নয়াদিল্লি, 28 এপ্রিল : ফের একবার দাঁত-নখ বের করতে শুরু করেছে করোনা । আছড়ে পড়েছে দ্বিতীয় ঢেউ । লাগামছাড়া হয়েছে সংক্রমণ । আর তার সঙ্গে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিবর্ণ রূপ । হাসপাতালে বেড নেই । বেড যাও বা পাওয়া যাচ্ছে, অক্সিজেন নেই । চারিদিকে হাহাকার । অক্সিজেনের অভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন একের পর এক রোগী । নিরুপায় চিকিৎসকরাও । চোখের সামনে রোগীদের মৃত্যুর কোলে পড়তে দেখছেন ।

গোটা দেশে একই ছবি । সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি দিল্লি আর মহারাষ্ট্রে । গোটা দেশ যখন প্রাণবায়ুর এক চরম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে কঙ্গনা রানওয়াত একটি টুইট করলেন । সাম্প্রতিককালে কঙ্গনা যখনই টুইট করেছেন, তখনই বোমা ফাটিয়েছেন । এবারও তাই । অক্সিজেনের হাহাকারের জন্য দায়ি করলেন দিল্লি ও মহারাষ্ট্র সরকারকেই । অভিযোগ, পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে যে টাকা অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছিল তা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পুরোপুরি ব্যর্থ দিল্লি ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীরা । সেই টাকা অন্য খাতে খরচ করেছে রাজ্যগুলি ৷

  • Kha gaye PMcares ka paisa and now asking for oxygen... Where’s the money gone ? Why these two characters did not build oxygen plants ? Why? We need answers and hisab of the money allocated to them .... pic.twitter.com/9w86Og8nTd

    — Kangana Ranaut (@KanganaTeam) April 24, 2021 " class="align-text-top noRightClick twitterSection" data=" ">

বেশ কিছু সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্র উদ্ধৃত করে একই অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে । এক্ষেত্রেও অভিযোগ, অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রের পাঠানো টাকা রাজ্য সরকারগুলি ব্যবহার করতে দেরি করছে ।

বাস্তব ছবিটা কেমন...

কেন্দ্র কি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য রাজ্যগুলিকে টাকা দিয়েছিল ?

না । জেলায় জেলায় অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রের তরফে কোনও টাকা দেওয়া হয়নি রাজ্যগুলিকে । স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা (সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি)-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রেসার সুইং অ্যাডসর্পশন প্রযুক্তিতে অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলির জন্য ।

2020 সালের 21 অক্টোবর সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি একটি টেন্ডার ডাকে । লক্ষ্য ছিল 14 টি রাজ্যে 150 টি পিএসএ অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা । পরে অবশ্য সেই তালিকায় আরও 12 টি প্ল্যান্ট যুক্ত হয় । আর এই গোটা প্রক্রিয়ার খরচটা এসেছিল পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে ।

আরও পড়ুন : টুইট করে অক্সিজেন চেয়েছিলেন, যুবকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের যোগীরাজ্য়ে

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই টেন্ডারটি যে সময় ডাকা হয়েছিল, সেটি ছিল গত বছরের অক্টোবর মাসে । আর দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল গত বছরের মার্চে । অর্থাৎ, গোটা প্রক্রিয়ায় শুরু হতে হতে কেটে গিয়েছিল আট মাস । মানে আট মাস পুরো নষ্ট ।

অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির দায় কার ?

সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি হল স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি সংস্থা । টেন্ডার ডাকা, টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের নথি পরীক্ষা করে দেখা, মূল্য নির্ধারণ করা, ভেন্ডরদের বাছাই করা থেকে শুরু করে সেই ভেন্ডররা মাল ঠিক ভাবে পাঠাচ্ছে কি না, সেই গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখার কাজ এই সংস্থার ।

যে ভেন্ডরদের বাছাই করা হয়েছে, তাদেরই জেলার হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগানোর কথা ।

এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির দায়িত্ব ছিল খুবই সীমিত । রাজ্যগুলিকে শুধু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য বৈদ্যুতিক কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তৈরি করে রাখা । জেলার হাসপাতালগুলির কাজ ছিল শুধু ভেন্ডরদের জানিয়ে দেওয়া যে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য প্রস্তুত রয়েছে ।

তাহলে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য দেরি কেন ? এর দায় কার ?

আগেই বলা হয়েছে, প্রায় আট মাস দেরি হয়ে গিয়েছিল কেন্দ্রের জন্য । 2020 সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত শুধু টেন্ডার ডাকতেই কেটে গিয়েছিল । এই হেলায় নষ্ট হওয়া আটটা মাস যদি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য কাজে লাগানো যেত, তাহলে হয়ত পরিস্থিতি এতটা খারাপ হত না ।

Oxygen Crisis
টেন্ডার ডেকে কাজের বরাত দিতে দিতেই পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়

যাই হোক, সেই টেন্ডার জমা দেওয়ার অন্তিম সীমা ধার্য করা হয়েছিল গতবছরের 10 নভেম্বর । চুক্তিপত্র চূড়ান্ত হতে হতে আরও একমাস । জেলা হাসপাতাল ও ভেন্ডরের বিভিন্ন সূত্র মারফত খবর, ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত চুক্তিপত্র হস্তান্তর হয় । অর্থাৎ, যখন থেকে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ শুরু হয়, ততক্ষণে করোনা দেশে ঢোকার দশ মাস পেরিয়ে যায় ।

টেন্ডারের নথি বলছে, অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর জন্য ভেন্ডরদের সময় লাগার কথা ছিল কম করে 45 দিন । বিশেষজ্ঞরাও বলছেন চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ হয়ে যাওয়া উচিত ।

আরও পড়ুন : খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার বদলাতে কর্মী ছিল না হাসপাতালে, মৃত 4

এদিক হিসেব বলছে, টেন্ডার দেওয়ার চার মাস কেটে যাওয়ার পরও 162 টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের মধ্যে মাত্র 33 টি বসানো হয়েছে ।

বিভিন্ন রাজ্যের বেশ কিছু হাসপাতালের আধিকারিকরা বলছেন, যাঁদের টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের দেখাই পাওয়া যায়নি । যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও জবাব মেলেনি । এমনকি যে তিনটি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে একটি সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি 13 এপ্রিল ব্ল্যাকলিস্টেড করে দেয় ।

তবে অন্য এক সংস্থা আবার অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগানোর কাজে দেরির জন্য দায়ি করছে হাসপাতালগুলিকে । তাদের অভিযোগ, বৈদ্যুতিক কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে দেরি করেছিল হাসপাতালগুলি ।

Oxygen Crisis
রাজ্য না কেন্দ্র ? দায় কার...

কোনও কোনও রাজ্যে কি মাত্রাতিরিক্ত দেরি হয়েছে ?

শুধু কঙ্গনাই নয়, বিজেপি সমর্থক বলে পরিচিত অনেক বিশিষ্টজনই সোশ্যাল মিডিয়ায় অ-বিজেপি রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে অক্সিজেন প্ল্যান লাগানোর ক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ এনেছেন ।

অক্সিজেন সঙ্কটের সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি রাজধানীতে । হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেন শেষ । ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগীদের । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় সরকারের এক আধিকারিক সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কেজরিওয়ালের সরকার সময় মতো অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য সাইট রেডিনেস সার্টিফিকেট দিতে পারেনি ।

যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে দিল্লি সরকার । কেজরির সরকারের তরফে বলা হয়েছে, দিল্লির হাসপাতালগুলির জন্য যে সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার টিকিও খুঁজে পাওয়া যায়নি । যে 162 টি হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগানোর কথা ছিল, তার মধ্যে ছিল কেন্দ্রের অধীনস্থ সফদরগঞ্জ হাসপাতালও । কিন্তু সেখানও এখনও পর্যন্ত অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি হয়নি ।

এই 162 টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের মধ্যে 14 টি অনুমোদিত হয়েছিল বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের জন্য । এটিই একটি রাজ্যের জন্য সর্বাধিক । এখানে রাজনীতি রয়েছে কি না, সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতেই পারে । কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য বলছে, উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যেও একটি মাত্র প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে ।

তার মানে কি অক্সিজেন সঙ্কটে রাজ্যগুলির কোনও দায়বদ্ধতা থাকছে না ?

এটা ঠিক যে 162 টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর দায়িত্ব পুরোটাই বর্তায় কেন্দ্রের উপর । গোটা বিষয়টির টাকা এসেছিল পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে । কিন্তু তা বলে, আজকের এই অক্সিজেন সঙ্কটের জন্য রাজ্যগুলির দায় একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না । কেন্দ্র 162 টি প্ল্যান্ট বসাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তার মানে এটি নয় যে, রাজ্যগুলিকে নিজস্ব উদ্যোগে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা থেকে কেউ আটকে রেখেছিল ।

আর এই ধরনের পিএসএ অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করতে খুব একটা বেশি খরচও নেই । 162 টি প্ল্যান্ট তৈরি করতে বাজেট ধরা হয়েছিল মাত্র 201 কোটি টাকা । মানে গড়ে এক একটি প্ল্যান্টের জন্য খরচ 1.25 কোটি টাকা । আর এই প্ল্যান্টগুলির অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা 100 লিটার প্রতি মিনিট থেকে শুরু করে 1000 লিটার প্রতি মিনিট । একটি 1000 লিটার প্রতি মিনিটের ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট 100-160 জন রোগীকে অক্সিজেন দিতে পারে ।

উদাহরণ হিসেবে ধরে নেওয়া যাক ছত্তিশগড়ের কথা । সেখানে একটি ইস্পাত প্রস্তুতকারী সংস্থাকে গতবছর 20 টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছিল । তার মধ্যে 15 টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট এই মুহূর্তে কার্যকর । আবার এর উল্টো ছবি দেখা যাবে ছত্তিশগড় সংলগ্ন মধ্যপ্রদেশেই । সেখানে নিজস্ব কোনও অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই । 14 এপ্রিল মধ্যপ্রদেশ সরকার 13 টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের বরাত দিয়েছে ।

তবে দিল্লি সরকারের আধিকারিকদের অনেকে বলছেন, ছত্তিশগড়ের মতো করে দিল্লিতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা সম্ভব নয় । কারণ, রাজধানীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি । তবে আবার অনেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিল্লি সরকার ও রাজধানীর হাসপাতালগুলি উভয়ের পক্ষেই অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা সম্ভব ।

গত সপ্তাহে মহারাষ্ট্রের পুণেতে এক সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির কাজ চলছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে ।

এই অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলি তৈরি হলে কি প্রাণবায়ুর সঙ্কট আসত না ?

এইমুহূর্তে গোটা দেশে দৈনিক অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা 7 হাজার 200 মেট্রিক টন । দিল্লি হাইকোর্টে কেন্দ্রের জমা দেওয়া তথ্যের হিসেব বলছে, 21 এপ্রিল দেশে শুধু মেডিকেল অক্সিজেনেরই চাহিদা ছিল 8 হাজার মেট্রিক টন ।

অর্থাৎ, দেশের দৈনিক উৎপাদিত অক্সিজেনের গোটাটাই যদি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলেও দিনে 800 মেট্রিক টন ঘাটতি । যে 162 টি প্ল্যান্ট তৈরির পরিকল্পনার কথা হয়েছে, সেগুলি যদি সময়মতো তৈরি হয়ে যেত, তাহলে দিনে আরও 158 মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদিত হত । ঘাটতি তাতেও থাকত, তবে কিছুটা কমত ।

মুম্বই ও নয়াদিল্লি, 28 এপ্রিল : ফের একবার দাঁত-নখ বের করতে শুরু করেছে করোনা । আছড়ে পড়েছে দ্বিতীয় ঢেউ । লাগামছাড়া হয়েছে সংক্রমণ । আর তার সঙ্গে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বিবর্ণ রূপ । হাসপাতালে বেড নেই । বেড যাও বা পাওয়া যাচ্ছে, অক্সিজেন নেই । চারিদিকে হাহাকার । অক্সিজেনের অভাবে প্রাণ হারাচ্ছেন একের পর এক রোগী । নিরুপায় চিকিৎসকরাও । চোখের সামনে রোগীদের মৃত্যুর কোলে পড়তে দেখছেন ।

গোটা দেশে একই ছবি । সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি দিল্লি আর মহারাষ্ট্রে । গোটা দেশ যখন প্রাণবায়ুর এক চরম সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই পরিস্থিতিতে কঙ্গনা রানওয়াত একটি টুইট করলেন । সাম্প্রতিককালে কঙ্গনা যখনই টুইট করেছেন, তখনই বোমা ফাটিয়েছেন । এবারও তাই । অক্সিজেনের হাহাকারের জন্য দায়ি করলেন দিল্লি ও মহারাষ্ট্র সরকারকেই । অভিযোগ, পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে যে টাকা অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছিল তা ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পুরোপুরি ব্যর্থ দিল্লি ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীরা । সেই টাকা অন্য খাতে খরচ করেছে রাজ্যগুলি ৷

  • Kha gaye PMcares ka paisa and now asking for oxygen... Where’s the money gone ? Why these two characters did not build oxygen plants ? Why? We need answers and hisab of the money allocated to them .... pic.twitter.com/9w86Og8nTd

    — Kangana Ranaut (@KanganaTeam) April 24, 2021 " class="align-text-top noRightClick twitterSection" data=" ">

বেশ কিছু সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্র উদ্ধৃত করে একই অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে । এক্ষেত্রেও অভিযোগ, অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রের পাঠানো টাকা রাজ্য সরকারগুলি ব্যবহার করতে দেরি করছে ।

বাস্তব ছবিটা কেমন...

কেন্দ্র কি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য রাজ্যগুলিকে টাকা দিয়েছিল ?

না । জেলায় জেলায় অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রের তরফে কোনও টাকা দেওয়া হয়নি রাজ্যগুলিকে । স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা (সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি)-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রেসার সুইং অ্যাডসর্পশন প্রযুক্তিতে অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলির জন্য ।

2020 সালের 21 অক্টোবর সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি একটি টেন্ডার ডাকে । লক্ষ্য ছিল 14 টি রাজ্যে 150 টি পিএসএ অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা । পরে অবশ্য সেই তালিকায় আরও 12 টি প্ল্যান্ট যুক্ত হয় । আর এই গোটা প্রক্রিয়ার খরচটা এসেছিল পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে ।

আরও পড়ুন : টুইট করে অক্সিজেন চেয়েছিলেন, যুবকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের যোগীরাজ্য়ে

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, এই টেন্ডারটি যে সময় ডাকা হয়েছিল, সেটি ছিল গত বছরের অক্টোবর মাসে । আর দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল গত বছরের মার্চে । অর্থাৎ, গোটা প্রক্রিয়ায় শুরু হতে হতে কেটে গিয়েছিল আট মাস । মানে আট মাস পুরো নষ্ট ।

অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির দায় কার ?

সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি হল স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ একটি সংস্থা । টেন্ডার ডাকা, টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীদের নথি পরীক্ষা করে দেখা, মূল্য নির্ধারণ করা, ভেন্ডরদের বাছাই করা থেকে শুরু করে সেই ভেন্ডররা মাল ঠিক ভাবে পাঠাচ্ছে কি না, সেই গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখার কাজ এই সংস্থার ।

যে ভেন্ডরদের বাছাই করা হয়েছে, তাদেরই জেলার হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগানোর কথা ।

এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির দায়িত্ব ছিল খুবই সীমিত । রাজ্যগুলিকে শুধু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য বৈদ্যুতিক কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তৈরি করে রাখা । জেলার হাসপাতালগুলির কাজ ছিল শুধু ভেন্ডরদের জানিয়ে দেওয়া যে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য প্রস্তুত রয়েছে ।

তাহলে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য দেরি কেন ? এর দায় কার ?

আগেই বলা হয়েছে, প্রায় আট মাস দেরি হয়ে গিয়েছিল কেন্দ্রের জন্য । 2020 সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত শুধু টেন্ডার ডাকতেই কেটে গিয়েছিল । এই হেলায় নষ্ট হওয়া আটটা মাস যদি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য কাজে লাগানো যেত, তাহলে হয়ত পরিস্থিতি এতটা খারাপ হত না ।

Oxygen Crisis
টেন্ডার ডেকে কাজের বরাত দিতে দিতেই পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়

যাই হোক, সেই টেন্ডার জমা দেওয়ার অন্তিম সীমা ধার্য করা হয়েছিল গতবছরের 10 নভেম্বর । চুক্তিপত্র চূড়ান্ত হতে হতে আরও একমাস । জেলা হাসপাতাল ও ভেন্ডরের বিভিন্ন সূত্র মারফত খবর, ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত চুক্তিপত্র হস্তান্তর হয় । অর্থাৎ, যখন থেকে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ শুরু হয়, ততক্ষণে করোনা দেশে ঢোকার দশ মাস পেরিয়ে যায় ।

টেন্ডারের নথি বলছে, অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর জন্য ভেন্ডরদের সময় লাগার কথা ছিল কম করে 45 দিন । বিশেষজ্ঞরাও বলছেন চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর কাজ হয়ে যাওয়া উচিত ।

আরও পড়ুন : খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার বদলাতে কর্মী ছিল না হাসপাতালে, মৃত 4

এদিক হিসেব বলছে, টেন্ডার দেওয়ার চার মাস কেটে যাওয়ার পরও 162 টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের মধ্যে মাত্র 33 টি বসানো হয়েছে ।

বিভিন্ন রাজ্যের বেশ কিছু হাসপাতালের আধিকারিকরা বলছেন, যাঁদের টেন্ডার দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের দেখাই পাওয়া যায়নি । যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও জবাব মেলেনি । এমনকি যে তিনটি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে একটি সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস সোসাইটি 13 এপ্রিল ব্ল্যাকলিস্টেড করে দেয় ।

তবে অন্য এক সংস্থা আবার অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগানোর কাজে দেরির জন্য দায়ি করছে হাসপাতালগুলিকে । তাদের অভিযোগ, বৈদ্যুতিক কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে দেরি করেছিল হাসপাতালগুলি ।

Oxygen Crisis
রাজ্য না কেন্দ্র ? দায় কার...

কোনও কোনও রাজ্যে কি মাত্রাতিরিক্ত দেরি হয়েছে ?

শুধু কঙ্গনাই নয়, বিজেপি সমর্থক বলে পরিচিত অনেক বিশিষ্টজনই সোশ্যাল মিডিয়ায় অ-বিজেপি রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে অক্সিজেন প্ল্যান লাগানোর ক্ষেত্রে গাফিলতির অভিযোগ এনেছেন ।

অক্সিজেন সঙ্কটের সব থেকে খারাপ পরিস্থিতি রাজধানীতে । হাসপাতালগুলিতে অক্সিজেন শেষ । ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে রোগীদের । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় সরকারের এক আধিকারিক সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কেজরিওয়ালের সরকার সময় মতো অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির জন্য সাইট রেডিনেস সার্টিফিকেট দিতে পারেনি ।

যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে দিল্লি সরকার । কেজরির সরকারের তরফে বলা হয়েছে, দিল্লির হাসপাতালগুলির জন্য যে সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার টিকিও খুঁজে পাওয়া যায়নি । যে 162 টি হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট লাগানোর কথা ছিল, তার মধ্যে ছিল কেন্দ্রের অধীনস্থ সফদরগঞ্জ হাসপাতালও । কিন্তু সেখানও এখনও পর্যন্ত অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি হয়নি ।

এই 162 টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের মধ্যে 14 টি অনুমোদিত হয়েছিল বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশের জন্য । এটিই একটি রাজ্যের জন্য সর্বাধিক । এখানে রাজনীতি রয়েছে কি না, সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতেই পারে । কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য বলছে, উত্তরপ্রদেশের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যেও একটি মাত্র প্ল্যান্ট তৈরি হয়েছে ।

তার মানে কি অক্সিজেন সঙ্কটে রাজ্যগুলির কোনও দায়বদ্ধতা থাকছে না ?

এটা ঠিক যে 162 টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর দায়িত্ব পুরোটাই বর্তায় কেন্দ্রের উপর । গোটা বিষয়টির টাকা এসেছিল পিএম কেয়ারস তহবিল থেকে । কিন্তু তা বলে, আজকের এই অক্সিজেন সঙ্কটের জন্য রাজ্যগুলির দায় একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না । কেন্দ্র 162 টি প্ল্যান্ট বসাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু তার মানে এটি নয় যে, রাজ্যগুলিকে নিজস্ব উদ্যোগে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা থেকে কেউ আটকে রেখেছিল ।

আর এই ধরনের পিএসএ অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করতে খুব একটা বেশি খরচও নেই । 162 টি প্ল্যান্ট তৈরি করতে বাজেট ধরা হয়েছিল মাত্র 201 কোটি টাকা । মানে গড়ে এক একটি প্ল্যান্টের জন্য খরচ 1.25 কোটি টাকা । আর এই প্ল্যান্টগুলির অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা 100 লিটার প্রতি মিনিট থেকে শুরু করে 1000 লিটার প্রতি মিনিট । একটি 1000 লিটার প্রতি মিনিটের ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্ট 100-160 জন রোগীকে অক্সিজেন দিতে পারে ।

উদাহরণ হিসেবে ধরে নেওয়া যাক ছত্তিশগড়ের কথা । সেখানে একটি ইস্পাত প্রস্তুতকারী সংস্থাকে গতবছর 20 টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছিল । তার মধ্যে 15 টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট এই মুহূর্তে কার্যকর । আবার এর উল্টো ছবি দেখা যাবে ছত্তিশগড় সংলগ্ন মধ্যপ্রদেশেই । সেখানে নিজস্ব কোনও অক্সিজেন প্ল্যান্ট নেই । 14 এপ্রিল মধ্যপ্রদেশ সরকার 13 টি অক্সিজেন প্ল্যান্টের বরাত দিয়েছে ।

তবে দিল্লি সরকারের আধিকারিকদের অনেকে বলছেন, ছত্তিশগড়ের মতো করে দিল্লিতে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা সম্ভব নয় । কারণ, রাজধানীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি । তবে আবার অনেক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিল্লি সরকার ও রাজধানীর হাসপাতালগুলি উভয়ের পক্ষেই অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরি করা সম্ভব ।

গত সপ্তাহে মহারাষ্ট্রের পুণেতে এক সরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট তৈরির কাজ চলছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে ।

এই অক্সিজেন প্ল্যান্টগুলি তৈরি হলে কি প্রাণবায়ুর সঙ্কট আসত না ?

এইমুহূর্তে গোটা দেশে দৈনিক অক্সিজেন উৎপাদন ক্ষমতা 7 হাজার 200 মেট্রিক টন । দিল্লি হাইকোর্টে কেন্দ্রের জমা দেওয়া তথ্যের হিসেব বলছে, 21 এপ্রিল দেশে শুধু মেডিকেল অক্সিজেনেরই চাহিদা ছিল 8 হাজার মেট্রিক টন ।

অর্থাৎ, দেশের দৈনিক উৎপাদিত অক্সিজেনের গোটাটাই যদি চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, তাহলেও দিনে 800 মেট্রিক টন ঘাটতি । যে 162 টি প্ল্যান্ট তৈরির পরিকল্পনার কথা হয়েছে, সেগুলি যদি সময়মতো তৈরি হয়ে যেত, তাহলে দিনে আরও 158 মেট্রিক টন অক্সিজেন উৎপাদিত হত । ঘাটতি তাতেও থাকত, তবে কিছুটা কমত ।

Last Updated : Apr 28, 2021, 10:17 PM IST
ETV Bharat Logo

Copyright © 2024 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.