নায়া রায়পুর, 26 ফেব্রুয়ারি: ভারত জোড়ো যাত্রা শেষ করেছেন তিনি ৷ প্রতিদিন 20-25 কিলোমিটার হেঁটেছেন ৷ কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর 3 হাজার 500 কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করেছে কংগ্রেস ৷ নেতৃত্বে রাহুল গান্ধি। জম্মু-কাশ্মীরে তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিল প্রশাসন ৷ তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ৷ কিন্তু কাশ্মীরে পৌঁছে তিনি কী দেখলেন ? কংগ্রেস সাংসদের দাবি, কাশ্মীরের মানুষের আবেগ তিনি বুঝেছেন, মোদি সরকার বোঝেনি ৷
রাহুলের কথায় জম্মু-কাশ্মীর
রাহুল বলেন, "কাশ্মীরে যখন ঢুকলাম উপত্যকায় বরফ ছিল, রোদ ছিল ৷ হাজার হাজার লোক আমাদের সঙ্গে হাঁটছে ৷ একজন আমার কাছে এসে বলল, রাহুলজি একটা প্রশ্ন, যখন কাশ্মীরের মানুষের কষ্ট হয়, বাকি হিন্দুস্তানের এত আনন্দ কেন হয় ?" আমি বললাম, ভুল বুঝছেন ৷ প্রত্যেক ভারতীয় আপনাদের সঙ্গে আছেন ৷ কিছু বাছাই করা লোক আছে, যাঁরা খুশি হন ৷ তাঁদের সংখ্যা হাজার হবে ৷ কিন্তু দেশের নাগরিক কোটি কোটি ৷" তাঁর এই উত্তরে খুশি করে দিয়েছিল ওই যুবককে ৷
কাশ্মীরে ঢুকে তিনি চারদিকে তেরঙা দেখেন ৷ তিনি বলেন, "পুলিশ বলেছিল 2 হাজার লোক আসবে ৷ আমার নিরাপত্তাকর্মীরাও তাই ভেবেছিলেন ৷ কিন্তু 40 হাজার লোক এল ৷ পুলিশ 40 হাজার লোক দেখে দড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল ৷ রোকো পার্টি সব পালিয়ে গেল ৷" তাঁর কথায়, কাশ্মীর হিন্দুস্তানের সবচেয়ে জঙ্গি অধ্যুষিত এলাকা। কিন্তু চারদিকে শুধুই তেরঙা ৷ কারা এই তেরঙা নিয়ে লাগিয়েছিলেন, বা হাতে নিয়েছিলেন, তাঁদের তিনি জানেন না ৷ এ প্রসঙ্গে রাহুল বলেন, "আমাদের সঙ্গে ছিলেন 125 জন ৷ এদিকে হাজার হাজার মানুষ তেরঙা নিয়েছে ৷ এই গল্প পুরো কাশ্মীরের ৷ অনন্তনাগ, পুলওয়াামার মতো জঙ্গি অঅধ্যুষিত এলাকাতেও এই জিনিস হয়েছে ৷" সিআরপিএফ-এর কর্মীরাও তাঁকে বলেছেন, "এরকম তো জীবনে দেখিনি ৷" রাহুলের দাবি, এখানেই তাঁর কাছে হেরেছে প্রধানমন্ত্রী তথা মোদি সরকার ৷
ভারত জোড়ো যাত্রায় কাশ্মীরের মানুষের মন বুঝেছেন রাহুল ৷ তিনি বলেন, "সংসদে প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি গিয়ে ললাচৌকে তেরঙা উত্তোলন করেছি ৷ কিন্তু হিন্দুস্থানের প্রধানমন্ত্রী কাশ্মীরকে বোঝেননি ৷ নরেন্দ্র মোদিজি বিজেপির 15-20 সদস্যের সঙ্গে গিয়ে লালচৌকে তেরঙা উত্তোলোন করেছেন ৷ আর ভারত জোড়ো যাত্রায় লক্ষ লক্ষ কাশ্মীরি যুবকের হাতে ছিল এই তেরঙা পাতাকা ৷ প্রধানমন্ত্রী এই পার্থক্যটা বুঝতে পারেননি ৷ আমরা হিন্দুস্তানের ভাবনা, এই তেরঙার ভাবনা কাশ্মীরের মানুষদের মধ্যে ঢুকিয়েছি ৷ আপনারা তা ছিনিয়ে নিয়েছেন ৷"
প্রতিদিন এতটা পথ হাঁটা কি সহজ ছিল তাঁর জন্য ? আজ নয়া রায়পুরে কংগ্রেসের প্লেনারি অধিবেশনে তিনি সেই স্মৃতিচারণ করলেন, "নৌকায় বসেছিলাম ৷ পুরো দলের সঙ্গে রোয়িং করছিলাম ৷ আমার পায়ে ভীষণ ব্যথা ছিল ৷ আমি ওই ছবিতে হাসছি ৷ কিন্তু আমার ভিতরে কান্না পাচ্ছিল ৷" তিনি এমনিতে ফিট মানুষ ৷ 10-12 কিলোমিটার দৌড়ে নেওয়া রাহুল গান্ধির অহঙ্কার ছিল 20-25 কিলোমিটারে কী সমস্যা হবে ? কলেজে ফুটবল খেলার সময় চোট লেগেছিল ৷ তা সেরেও গিয়েছিল ৷ হঠাৎ এই যাত্রা শুরুতে সেই পুরনো ব্যথা ফিরে এল ৷ তাই, সকালে উঠে তিনি ভাবতেন, কী করে হাঁটবেন ?
আরও পড়ুন: দেশকে হিংসামুক্ত করাই ভারত জোড়ো যাত্রার লক্ষ্য, শ্রীনগরে বললেন রাহুল
ভারত জোড়া যাত্রা আর তাঁর ঘর
প্রথম কৃষকদের সঙ্গে দেখা হলে তিনি তাঁর জ্ঞান দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতেন ৷ চাষবাস, মনরেগা, সারের ব্যাপারে কথা বলতেন ৷ ধীরে ধীরে এসব বন্ধ হয়ে গেল ৷ তিনি বলেন, "মনে শান্তি এল ৷ নিস্তব্ধতায় শুনতে পাচ্ছিলাম ৷ ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন এল ৷" আর যখন গন্তব্যস্থল জম্মু ও কাশ্মীরে পৌঁছেছেন ? তাঁর কথায়, "অদ্ভুত, আমি একেবারে চুপ করে গেলাম ৷ ধ্যান করলে যেমন হয়, প্রিয়াঙ্কা বিপাসনা করে ঠিক ওরকম চুপ করে গেলাম ৷"
এর মধ্যে উঠে আসে তিনি ঘরহারা ৷ তাঁর স্মৃতিচারণায়, "আমার তখন 6 বছর বয়স ৷ 1977 সালের কথা ৷ নির্বাচন এল ৷ আমি কিছু জানতাম না ৷ একদিন বাড়িতে অদ্ভুত একটা আবহাওয়া ৷ মাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল ? মা বললেন, আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি ৷ ততদিন আমি ভাবতাম বাড়িটা আমাদের ৷ জানতে চাইলাম, মা আমরা বাড়ি কেন ছাড়ছি ?" সোনিয়া গান্ধি তখন বলেছিলেন প্রথমবার, "রাহুল এটা আমাদের ঘর নয়, সরকারের ৷ এবার যেতে হবে ৷" কোথায় যাব? জানি না ৷ কোথায় যাব ? আমি হয়রান হয়ে গেলাম ৷ আমি ভেবেছিলাম, ওটা আমাদের বাড়ি ৷ 52 বছর হয়ে গিয়েছে ৷ আমার কাছে বাড়ি নেই, আজও নেই ৷ আমাদের পরিবারের যে ঘর, তা এলাহাবাদে, তাও আমাদের ঘরবাড়ি নয় ৷
ভারত জোড়ো যাত্রায় যখন বেরলেন তখন তিনি ঘর বানালেন ৷ তাঁর কথায়, "মাথায় একটা আইডিয়া এল ৷ অফিসের লোকজনকে ডাকলাম ৷ বললাম, এখানে হাজার লোক হাঁটছে ৷ ধাক্কা লাগবে, লোকের চোট লাগবে, খুব ভিড় ৷ আমাদের এই কাজটা করতে হবে ৷ আমার চারধারে 20-25 ফুট খালি জায়গা থাকবে ৷ হিন্দুস্তানের লোক আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে ৷ আগামী 4 মাসের জন্য ওইটাই আমার ঘর ৷ এই ঘর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাবে সকাল 6টা বিকেল 5টা পর্যন্ত ৷ এই ঘরে সবাই আসবে । আমি ভাবলাম কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত এই ছোট বাড়িটাকে নিয়ে যাচ্ছি ৷"
আরও পড়ুন: সরকার-মিডিয়া চুপ,একার স্বর আরও তীব্র হবে, টুইটে দাবি মহুয়ার
গৌতম আদানি প্রসঙ্গে
রাহুল গান্ধি সংসদে আদানিকে নিশানা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "গৌতম আদানি 609 থেকে 2 নম্বরে কী করে পৌঁছলেন ৷ বিদেশনীতিতে বাংলাদেশ, ইজরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, সব জায়গায় তিনি সুবিধে পান ৷ ইজরায়েলে ডিফেন্সের ক্ষেত্রে, রাজাপক্ষেও বলেছেন নরেন্দ্র মোদির চাপে তিনি আদানিকে কনট্রাক্ট দিয়েছেন ৷ প্রধানমন্ত্রী, আপনার সঙ্গে আদানির সম্পর্ক কী ?" তাঁর অভিযোগ, "সব মন্ত্রী, সরকার, আদানির রক্ষা করতে উঠেপড়ে লাগলেন ৷ বললেন, আদানির উপর যে আক্রমণ করে, সে দেশদ্রোহী ৷ আদানি দেশভক্ত ৷" রাহুলের প্রশ্ন, বিজেপি ও আরএসএস তাঁকে রক্ষা করতে উঠেপড়ে লেগেছেন কেন ? কী এমন আছে আদানির মধ্যে ? বিজেপি, মন্ত্রীদের রক্ষা করার দরকার পড়ছে ৷"
সংসদে আদানি আক্রমণে কংগ্রেস সভাপতি খাড়গে ও তাঁর বক্তব্যকে খারিজ করা হয়েছে ৷ তাও তিনি বলেন, "আমরা জিজ্ঞাসা করব, হাজার বার, আদানির সত্যতা বেরিয়ে আসছে ৷ আমরা থামব না ৷ যে লোক আদানি কোম্পানিতে কাজ করে, এই আপনাদের কোম্পানি দেশের ক্ষতি করছে. পুরো পরিকাঠামোকে ছিনিয়ে নিচ্ছে ৷ মনে রাখবেন, আজাদির লড়াই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে হয়েছিল ৷ ওরাও হিন্দুস্তানের সব সম্পদ, সব পরিকাঠামো, বন্দর, সব নিয়ে নিয়েছিল ৷ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে ৷ দেশের বিরুদ্ধে কাজ হচ্ছে ৷ কংগ্রেস পার্টি লড়বে ৷"
তাঁর মতে, কংগ্রেস তপস্বীদের দল, পূজারিদের নয় ৷ চার মাসের ছোট্ট তপস্যায় জনগণের মধ্যে, দেশে প্রাণ ফিরেছে ৷ এই তপস্যা বন্ধ হবে না ৷ কংগ্রেস সভাপতি খাড়গে ও বর্ষীয়ান নেতাদের প্রতি রাহুল গান্ধির বার্তা, "এই তপস্যার প্রোগ্রাম চলবে ৷ প্রতিটা কার্যকর্তা, নেতার থাকবেন ৷ চোট লাগুক ৷ সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে, প্রবীণ নেতারা, তপস্যার প্রোগ্রাম তৈরি করুন ৷ আমরা সবাই মিলেমিশে তপস্যায় অংশ নেব ৷ রক্ত, ঘাম দেব ৷ এই দেশ এই তপস্যায় দাঁড়াব ৷ আপনারা প্রোগ্রাম বানান, আমি আমার দল নিয়ে তৈরি ৷" পুরো বক্তৃতায় তিনি দেশকে হিন্দুস্থান বলে সম্বোধন করেন ৷