নয়াদিল্লি, 22 সেপ্টেম্বর: কানাডার মাটিতে জুন মাসে খালিস্তানপন্থীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারের খুনের ঘটনায় ভারত সরকারের এজেন্টদের যুক্ত থাকার অভিযোগ তুলে বিপত্তি বাঁধিয়েছেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ৷ কানাডার সেনেটে দাঁড়িয়ে ট্রুডো যে অভিযোগ তুলেছেন তার জেরে কার্যত টালমাটাল দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ৷ তাঁর এই মন্তব্যের বিরূপ প্রভাবে যে দুই দেশের এহেন কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হবে তা সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি কানাডার প্রধানমন্ত্রী ৷ জান্টিন ট্রুডোর অভিযোগকে ইতিমধ্যেই 'আজগুবি ও উদ্দেশ্যপ্রণদিত' বলে পালটা আক্রমণ করেছে ভারত ৷ দুই দেশই একজন করে শীর্ষ কূটনীতিককে নিজেদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে ৷ মনে করা হচ্ছে এই ইস্যুতে কানাডার বিরুদ্ধে 'ইটের বদলে পাটকেল' নীতি নিয়েছে ভারত ৷
ভারতের তরফে ইতিমধ্যেই কানাডায় যাওয়া অথবা বসবাসকারী ভারতীয়দের জন্য ট্রাভেল অ্যাডভাইজারি জারি করা হয়েছে ৷ যেখানে বলা হয়েছে, "কানাডায় ভারত বিরোধী কার্যকলাপের বাড়বাড়ন্ত মাথার রেখে এবং রাজ্যনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত বিদ্বেষ জনিত অপরাধ ও হিংসার কথা মাথায় রেখে সে দেশে বসবাসকারী ও সফররত ভারতীয়দের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে ৷" সম্প্রতি সেদেশে ভারতীয় কূটনীতিক ও ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও এই ট্রাভেল অ্যাডভাইজারিতে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ কানাডায় ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ চলছে বলেও দাবি করা হয়েছে ভারতের তরফে জারি করা ওই নির্দেশিকায় ৷
সাধারণ পশ্চিম এশিয়া বা আফ্রিকার যুদ্ধ বিধ্বস্থ কোনও দেশের ক্ষেত্রে এই নির্দেশিকা জারি করা হয়ে থাকে ৷ কিন্তু জি-7 গোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য দেশ কানাডার ক্ষেত্রে বিদেশ মন্ত্রকের এই ধরণের নির্দেশিকা থেকেই স্পষ্ট সেদেশে খালিস্তানপন্থীদের কার্যকলাপের বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ভারত ৷ এখানেই না থেমে, কানাডার নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রদানও আপাতত স্থগিত রেখেছে ভারত ৷ এই প্রসঙ্গে ইটিভি ভারতের সঙ্গে কথা বলেছেন অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন থিঙ্ক ট্যাঙ্কের স্টাডিজ ও বিদেশ নীতি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট হর্ষ ভি পন্থ ৷ তাঁর মতে, ভারত যে দেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোনও কার্যকলাপ বরদাস্ত করবে না সেই বার্তা এইসব পদক্ষেপের মাধ্যমে কানাডাকে দিয়েছে ৷ তাঁর কথায়, "গত কয়েক মাস ধরেই নয়াদিল্লি ট্রুডোকে বলে আসছে যে বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে কানাডা খালিস্তানপন্থীদের জঙ্গি কার্যকলাপকে সমর্থন করতে পারে না ৷"
আরও পড়ুন: হরদীপ-হত্যায় ঘুরপথে ফের ভারতকে নিশানা করেও একসঙ্গে পথচলার বার্তা ট্রুডোর
গত কয়েকবছর ধরেই কানাডার মাটিতে বাড়ছে খালিস্তানপন্থীদের কার্যকলাপ ৷ চলতি বছরের জুন মাসে সেখানে একটি খালিস্তানপন্থী গোষ্ঠী গ্রেটার টোরন্টো অঞ্চলে একটি প্যারেড করে ৷ সেই প্যারেডে ব্যবহৃত ট্যাবলোতে দেশের প্রক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকে সমর্থন করে বার্তা লেখা হয়েছিল, "শ্রী দরবার সাহিবে আক্রমণের প্রতিশোধ" ৷ গত বছর সেপ্টেম্বরে ওন্টারিওতে মহাত্মা গান্ধির একটি মূর্তিও ভেঙে দিয়ে তার উপর 'খালিস্তান' কথাটি লেখা হয় ৷ ভারতে নিষিদ্ধ শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী 'শিখস ফর জাস্টিস' কানাডায় প্রকাশ্যেই খালিস্তানের পক্ষে সওয়াল করে থাকে ৷ পন্থের কথায়, "ট্রুডোর মন্তব্য তাঁর নিজের দেশের পরিস্থিতিকেই আরও জটিল করে তুলেছে ৷" সে দেশে বসবাসকারী হিন্দুরাও গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নু নামে খালিস্তানপন্থী একটি সংগঠনের সাম্প্রতিক একটি ভিডিয়ো বার্তার সমালোচনা করে সে দেশের জন সুরক্ষা মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে ৷
ভারত আপাতত ভিসা পরিষেবা বন্ধ রাখার বিষয়টিও কানাডার কাছে বড় চিন্তার ৷ ভারতীয় বংশোদ্ভুত প্রায় 1.6 মিলিয়ন ও প্রায় 7 লক্ষ প্রবাসী ভারতীয় কানাডার বাসিন্দা ৷ যা ওই দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় 3 শতাংশ ৷ পন্থ জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক বা অন্যান্য কারণে প্রচুর কানাডার নাগরিক প্রতি বছর ভারতে আসেন ৷ দুই দেশের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও থমকে রয়েছে এই টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে ৷ এটা কানাডার অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ কানাডা থেকে ভারত যেসব পণ্য আমদানি করে প্রয়োজনে নয়াদিল্লি তা অন্য দেশ থেকেও নিতে পারে ৷
অন্যদিকে, কানাডায় গয়না, দামি পাথর, ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য, জামাকাপড়, বিভিন্ন যন্ত্র, অর্গ্যানিক কেমিক্যালস, লোহা, স্টিল ইত্যাদি রফতানি করে ভারত ৷ আর কানাডা থেকে ভারত ডাল, নিউজ প্রিন্ট, পটাশ, অ্যাসবেসটস, কপার মিনারেল-সহ নানা শিল্প রাসয়ানিক আমদানি করে থাকে ৷ একটি হিসেব অনুযায়ী দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ 2035 সালে 6.5 বিলায়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছতে পারে সব ঠিক থাকলে, যার উপর ভিত্তি করে কানাডার জিডিপি 3.8 বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে 5.9 বিলিয়ন ডলার হতে পারে ৷
আরও পড়ুন: কানাডায় হিংসা-ঘৃণার কোনও জায়গা নেই, বার্তা সরকারের
পন্থের মতে কানাডার কাছে ব্যবসায়িক আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের বাজারও বিশাল ৷ জাস্টিন ট্রুডো সম্ভবত এই সব বিষয় মাথায় রাখেননি ওই মন্তব্যের আগে ৷ ভারত-প্রশান্ত মহাসগরায় অঞ্চলে চিনের দাপাদাপি কমাতে ও নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে কোয়াড গোষ্ঠী গঠন করে একসঙ্গে কাজ করছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও জাপান ৷ এই অঞ্চলে চিনকে আটকাতে ভারতকেই বেশি গুরুত্ব দেয় পশ্চিমী দেশগুলি ৷ ফলে এই ইস্যুতে এই দেশগুলি কতটা কানাডার সমর্থনে এগিয়ে আসবে তাও বড় প্রশ্ন ৷ পন্থের মতে, ফাইফ আইস ইন্টেলিজেন্স বলে একটি গোষ্ঠীতে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ব্রিটেন ও আমেরিকার সঙ্গে রয়েছে কানাডাও ৷ এই গোষ্ঠীর দেশগুলি নিজেদের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদান করে থাকে ৷ এই দেশগুলিও কানাডাকে পরামর্শ দিয়েছে ভারতের সঙ্গে বিরোধের উত্তাপ না চড়াতে ৷ গত কয়েক দিনে জাস্টিন ট্রুডোর গলার স্বরও এই ইস্যুতে কিছুটা নরম হয়েছে, বর্তমান বিশ্বে ভারতের ক্রম বর্ধমান গুরুত্বের কথা তিনিও স্বীকার করেছেন ৷