সবচেয়ে খারাপ স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ভারত ৷ দেশ এই ধরনের সংকট আগে কখনও দেখেনি । সেই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর ভারত ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে । কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা ক্রমশ কমতে শুরু করেছে এবং দেশ জুড়ে ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে । এর ফলে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে । অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পূর্বভাসও সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে । উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদন সংক্রান্ত শিল্প আরও শক্তিশালী হয়েছে । ব্যবসার পুনরুজ্জীবনের চেষ্টার মধ্যেই এই উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে । দ্য সিজনালি অ্যাডজাস্টেড ম্যানুফ্যাকচারিং পারচেজিং ম্যানেজারস সূচক ডিসেম্বরে ছিল ৫৬.৪ । নভেম্বরের থেকে তা সামান্য বেশি ছিল । নভেম্বরে ওই সূচক ছিল ৫৬.৩ । অন্যদিকে, যাত্রীবাহী যানবাহন বিক্রয়ের পরিমাণ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । যাত্রীবাহী যানবাহন বিক্রিকে অর্থনীতিতে চাহিদার অন্যতম প্রধান সূচক হিসেবে ধরা হয় । এছাড়া শেয়ার বাজারেও বৃদ্ধির ভালো প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে । ২০২১ সালের ২১ শে জানুয়ারি প্রথমবারের জন্য সবচেয়ে উপরে উঠে সেনসেক্স ৫০ হাজার পেরিয়েছে । ২০২০ সালের এপ্রিলে যখন দেশ জুড়ে লকডাউন জারি করা হয়েছিল, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে তা প্রায় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ।
আরও পড়ুন:কোরোনা অতিমারিতে নির্বাচন এবং সেই সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ
এছাড়াও, ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক তার সর্বশেষ মাসিক বুলেটিনে ভারতীয় অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বৃদ্ধির আশাও প্রকাশ করেছে । আর এই পুনরুজ্জীবন ‘ভি’ আকারে এগিয়ে চলেছে বলে জানানো হয়েছে । উপরে উল্লিখিত সূচকগুলির কার্য সম্পাদন এবং বাজারে একই ধরনের প্রতিক্রিয়ার জেরে ২০২০ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে দেশের অর্থনীতি চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছিল । তখন বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২৩.৯ শতাংশ । যা স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে কম বৃদ্ধি ছিল । কিন্তু এখন অর্থনীতির এই ইতিবাচক পারফরম্যান্সকে স্বাগত জানানো উচিত । কিন্তু এর জন্য নীতি নির্ধারকদের খারাপ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া থেকে বিরত হওয়া উচিত নয় । তার ফলে আমরা যে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে চলেছি, তার থেকে লাইনচ্যুত হতে পারি । এখন এমন এক সময়, যখন অর্থমন্ত্রী কয়েকদিনের মধ্যে বাজেট পেশ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন সেই চ্যালেঞ্জগুলিকে বুঝে নেওয়া দরকার, যেগুলি পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । আর অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সেগুলির প্রতিকার করার প্রয়োজনও রয়েছে ।
আরও পড়ুন:রাজ্যে গত 24 ঘণ্টায় সামান্য বাড়ল সংক্রমণ
সমস্যা এখনও রয়েছে :
প্রথম এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল আয় বৈষম্য । যা কোভিড-১৯ দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পর আরও গভীর হয়েছে ও আরও বিস্তার লাভ করেছে । আর এর কারণ হল, প্যানডেমিকের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং সমাজের ভিন্ন ভিন্ন স্তরে রোজগার কমেছে । যখন শ্রমজীবী শ্রেণি চাকরি হারিয়েছে এবং তাদের সঞ্চয় ক্রমশ কমে গিয়েছে, তখন একই সঙ্গে অন্য একটি শ্রেণির উন্নতি হয়েছে । অক্সফামের রিপোর্ট থেকে সেটা স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়েছে । যেখানে বলা হয়েছে যে গত ১০ মাসে ভারতীয় ধনকুবেরদের সম্পদের পরিমাণ 35 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । এই রিপোর্ট অনুসারে, এই সময়কালে শীর্ষস্তরের ১০০ জন কোটিপতির সম্পদ যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, তা দিয়ে দশ বছর ধরে এমজিএনআরইজিএ প্রকল্প চালু রাখা যায় । অন্যদিকে কর্পোরেটদের সম্পদের এই বৃদ্ধি পাওয়া আবার কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাকে একই ভাবে উজ্জ্বল করতে পারেনি । এই সব কারণের জন্যই এখনও চাকরিতে নতুন নিয়োগের বিষয়টি গতি পায়নি । আর অনেক জায়গায় যাঁরা কাজ করছেন, সেই কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে । এটি সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে । যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্য এবং তা বজায় রাখার উপর ক্ষতিকারক হবে ।
দ্বিতীয় সমস্যাটি হল গ্রামীণ মজুরির বিষয়টি একেবারে থেমে যাওয়া । কম পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত এটা চলছে । দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যত লোক কাজ করে, তার প্রায় ৪৩ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে রয়েছে । ভারতে গ্রামীণ অংশের এই কাজে মজুরি না বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সামগ্রিক ভাবে চাহিদাও হ্রাস পেয়েছে । এর ফলে শিল্প সামগ্রীর চাহিদা হ্রাস পেয়েছে । এই শিল্প সামগ্রী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলে উৎপাদিত হয় এবং এমএসএমই গুলি উৎপাদন করে । এর ফলে ভারতের শহরাঞ্চলে ও এমএসএমই - গুলিতে উৎপাদন কমে গিয়েছে ও ছাঁটাই হয়েছে । এর ফলে আয় কমে গিয়েছে । যার জেরে চাহিদা আরও হ্রাস পেয়েছে এবং মন্দার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে । কোরোনা ভাইরাস পরিস্থিতি আরও খারাপ করে দিয়েছে । সুতরাং কৃষি এবং এমএসএমই - কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন করে গড়ে তোলার কাজ অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন । কারণ, এই দু’টি ক্ষেত্র যৌথভাবে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান তৈরি করে ।
আরও পড়ুন:কোরোনায় চিকিৎসকদের মৃত্যুতে তৃণমূলকে দায়ী করলেন শুভেন্দু
কী করা যেতে পারে ?
আয়ের বৈষম্য সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবিলায় আরও বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করা খুব প্রয়োজন । আর এই ভাবেই মানুষের আয় বৃদ্ধি করা যাবে । এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে বেকারত্বের যে সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা শুধুমাত্র কোভিড-১৯ এর জন্য হয়নি । বাস্তব পরিস্থিতি হল এর জেরে সংকটজনক অবস্থা আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে । সুতরাং এই সমস্যা অনেক বেশি পরিকাঠামোগত । এই পরিস্থিতিতে বর্তমান কর্মচারী ও যাঁরা নতুন নিযুক্ত হচ্ছেন, সেই সব কর্মচারীদের জন্য নিয়োগকারী সংস্থাকে মজুরির কিছুটা ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে । অন্তত কিছু সময়ের জন্য এটা করা যেতে পারে । এই ধরনের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হলে, তা চাকরি হারানোর ঘটনাকে কমাতে পারবে । আর এই প্যানডেমিকের সময় কর্মীদের কাজের স্থিতিশীলতা তৈরি করবে এবং আয় সুনিশ্চিত করবে । অন্যদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের যে দুর্দশার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেই বিষয়টিও জরুরি ভিত্তিতে মোকাবিলা করা দরকার । কারণ, তাঁরা মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ৯৭ শতাংশ । তাঁদের সম্পর্কে তথ্য ভান্ডার তৈরি করার প্রচেষ্টা চলছে । একই ভাবে তাঁদের হাতে যেন খুব দ্রুত নগদ টাকা পৌঁছায়, সেই বিষয়টিও সুনিশ্চিত করতে হবে । এর ফলে যে শুধু তাঁদের জীবন জীবন স্থিতিশীল হবে তা নয়, আগামী দিনের অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে ।
দ্বিতীয়ত, এমএনআরইজিএস এবং কৃষিক্ষেত্রের জন্য অনেক বেশি পরিমাণে বরাদ্দ থাকা দরকার । যা গ্রামে থাকা মানুষদের চাহিদা বাড়িয়ে তুলতে পারে । যার ফলস্বরূপ চাহিদার বৃদ্ধি আরও বেড়ে যাবে । যা এই সময়ে অত্যন্ত প্রয়োজন । ২০২০-২১ আর্থিক বছরে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ৬.২ থেকে ৬.৫ এর মধ্যে হবে বলে মনে করা হচ্ছে । কিন্তু এর জন্য সরকারকে আরও খরচ করার বিষয় থেকে পিছিয়ে এলে হবে না । এটা মনে রাখতে হবে যে আমরা অভূতপূর্ব একটি সংকটের মধ্যে পড়েছি । আর এর জন্য আমাদের অসাধারণ নীতির রূপয়াণের প্রয়োজন ।
লেখক উত্তরাখণ্ডের এইচ এন বি গারহোয়াল কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ।
যে মতামত প্রকাশ করা হয়েছে, তা লেখকের নিজস্ব ।