ডায়মন্ড হারবার, 15 অগস্ট : পরাধীন ভারতকে ব্রিটিশ মুক্ত করতে সারা দেশ জুড়ে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তার আঁচ এসে পড়েছিল কলকাতা থেকে প্রায় 40 কিমি দূরে বজবজ 2 নম্বর ব্লকের বুড়ুল এলাকায় । সে সময় বিপ্লবীদের একমাত্র ভরসা ছিল জলপথ । হুগলি নদীর পাড়ে নলদাঁড়ি ঘাটে এসে ভিড়ত বিপ্লবীদের স্টিমার । অতি দুর্গম এলাকা হওয়ায় নলদাঁড়ি ঘাটে নেমে বুড়ুলে আশ্রয় নিতেন চরমপন্থী বিপ্লবীদের অনেকেই । বিপ্লবী অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ ও সরলা দেবীর মত স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও পা রেখেছিলেন এই নলদাঁড়ি ঘাটে ।
এখানেই বুড়ুল হাইস্কুলে অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন আরেক বিপ্লবী শহিদ অনুরূপ চন্দ্র সেন ৷ তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের প্রধান সহকারী ৷
শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থানীয় যুবকদের সশস্ত্র আন্দোলন ও সংস্কৃত চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতেন চট্টগ্রাম বিপ্লবীদলের অন্যতম সদস্য অনুরূপ চন্দ্র সেন । এর জন্য তিনি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে গুপ্ত সমিতি ও পল্লী হিতৈষণী সমিতি গড়ে তোলেন ৷ এখানেই মজুত করে রাখা হত আগ্নেয়াস্ত্র এবং নিষিদ্ধ বই ও পত্র-পত্রিকা । মূলত এখান থেকেই এলাকার যুবকদের সশস্ত্র আন্দোলন ও বৈপ্লবিক কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করতেন তিনি । সন্ধে হলেই নদীর পাড়ের বাতিঘরের কাছে যুবকদের নিয়ে চলত অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ ।
আরও পড়ুন : Independence Special : ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে 32 জন শহিদ হন কর্নাটকের জালিয়ানওয়ালাবাগে
জানা গিয়েছে, 1905 সাল থেকেই বুড়ুল-সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনুরূপ চন্দ্র সেনের হাত ধরে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মন্ত্রে দীক্ষা নেন স্থানীয় যুবকরা । মাস্টারদা সূর্য সেনের নির্দেশেই যুগান্তর দলের অন্যতম নেতা অনুরূপ চন্দ্র সেন 1922 সালে প্রথম স্টিমারে করে নলদাঁড়ি ঘাটে পা রাখেন ।
ইতিহাস রয়ে গেলেও কালের নিয়মে সেই ঘাট আজ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে । সংস্কারের অভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি বিজড়িত স্থল এখন ভরে গিয়েছে বন জঙ্গলে । শুধু নামটাই রয়ে গিয়েছে 'নলদাঁড়ি ঘাট'। শহিদ অনুরূপ চন্দ্র সেনের নামে এলাকায় একটি কলেজ গড়ে উঠলেও নতুন প্রজন্ম ভুলতে বসেছে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থানীয় ইতিহাসকে ।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর স্থানীয় বিড়লাপুর-মায়াপুরে গ্যারিসন অস্ত্রভাণ্ডার লুণ্ঠনের পরিকল্পনা করেন অনুরূপ চন্দ্র সেন । কিন্তু এলাকার জমিদার ও ব্রিটিশ পুলিশের কড়া নজরদারিতে তা ভেস্তে যায় । এই সব ঘটনার মাঝেই দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় নাম জড়ায় অনুরূপ সেনের ।
1926 সালের 19 ডিসেম্বর এক শীতের সকালে বুড়ুল থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ পুলিশ । এরপর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় নলদাঁড়ি ঘাটে । সেখান থেকে কলকাতায় । সেদিন ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে জড়ো হয়ে অনুরূপ সেনের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন এলাকার সাধারণ মানুষ । তাতে কোনও কর্ণপাত করেনি পুলিশ ৷
আরও পড়ুন : Mahatma Gandhi : বেলেঘাটার হায়দরি মঞ্জিল ও গান্ধির কিছু স্মৃতি
বিচারে সাজা ঘোষণা হওয়ার পর তাঁকে আলিপুর মেট্রোপলিটন জেলে এক মাস রাখার পর তাঁকে জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়িতে পাঠানো হয় । সেখানে প্রবল অত্যাচার ও চরম অব্যবস্থার জেরে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন অনুরূপ সেন । জেল থেকে বেরোনোর পর মৃত্যু হয় তাঁর । তবে মৃত্যুর সাল এবং তারিখ নিয়ে এখনও যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে ।
শহিদ অনুরূপ সেন বুড়ুল ছাড়লেও থেমে থাকেনি আন্দোলন । তাঁরই শিষ্য প্রভাস চন্দ্র রায়, গণেশ ঘোষ, নগেন সেন ও সুরেশ চন্দ্র ঘোষের মত বিপ্লবীদের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে সশস্ত্র আন্দোলনের মন্ত্র ।
আজ স্বাধীনতার 75 বছর ৷ কিছুটা হলেও ফিকে হয়ে এসেছে আত্মবলিদানের সেই ইতিহাস ৷ ক্রমেই যেন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে মহান বিপ্লবীদের পদধূলি ধন্য নলদাঁড়ি ঘাট ও তরুণ যুবকদের অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণকেন্দ্র । সেদিনের ইতিহাসকে আজ ঢেকে দিয়েছে আগাছা আর জঙ্গল ৷ শহিদ অনুরূপ চন্দ্র সেনের স্মৃতিও যেন ভুলতে বসেছে বুড়ুলবাসী ৷
এই বিষয়ে স্থানীয় ইতিহাস গবেষক তথা কলকাতা পুলিশের এএসআই অভিজিৎ বেরা বলেন, "স্বাধীনতার অধিকার ছিনিয়ে আনতে বিপ্লবীরা মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে ছিলেন । বুড়ুল ও নলদাঁড়ি ঘাটের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেইসব স্মৃতি। কিন্তু অবহেলা ও সংস্কারের অভাবে সেই স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি আজ ধ্বংসের মুখে । নতুন প্রজন্মের কাছে বিপ্লবী অনুরূপ চন্দ্র সেন ও বুড়ুলের ইতিহাসকে পৌঁছে দিতে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছি প্রশাসনের কাছে ।"
আরও পড়ুন : Bhagat Singh : খণ্ডঘোষের পাতাল ঘরে বসেই দিল্লি গণপরিষদে বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনা ভগৎ সিংয়ের