বালাসোর, 22 ডিসেম্বর: হাতে গোনা ক'দিন ৷ তারপরই নতুন বছর ৷ তবে এবছরটি ট্রেন দুর্ঘটনার কারণে আগামী বহু বছর মানুষের মনে থাকবে ৷ 2023 সালে একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে দেশে ৷ সবচেয়ে ভয়াবহ 2 জুনের সন্ধ্যায় ওড়িশার বালাসোর স্টেশনের কাছে তিন ট্রেনের সংঘর্ষ ৷
সন্ধ্যা 7টা নাগাদ তিনটি ট্রেনের সংঘর্ষে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে বালাসোরের বাহানাগা স্টেশনের কাছে ৷ শালিমার-হাওড়া করমণ্ডল এক্সপ্রেসটি চেন্নাই যাচ্ছিল ৷ ট্রেনটি বাহানাগা স্টেশনের কাছে একটি মালগাড়িকে ধাক্কা মারে ৷ এর ফলে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বেশ কয়েকটি বগি পাশের ট্র্যাকে ছিটকে পড়ে ৷ ওই ট্র্যাক দিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে যশবন্তপুর সুপারফাস্ট ট্রেন আসছিল ৷ সেটি বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়ার দিকে যাচ্ছিল ৷ ট্র্যাকে লাইনচ্যুত বগিগুলির সঙ্গে ওই ট্রেনের ধাক্কা লাগে ৷ ফলে যশবন্তপুর সুপারফাস্টের কয়েকটি বগিও লাইনচ্যুত হয় ৷ করমণ্ডল এক্সপ্রেসের প্রায় 21টি বগি লাইনচ্যুত হয় ৷
তড়িঘড়ি শুরু হয় উদ্ধারকার্য ৷ দুর্ঘটনার পরদিন সকালে মনে হচ্ছিল যেন, কেউ হাতে করে একটি ট্রেনের বগি আরেকটি ট্রেনের উপর তুলে দিয়েছে ৷ অথবা বগিগুলি এদিক ওদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে ৷ প্রাথমিক রিপোর্টে জানা যায়, কমপক্ষে 233 জনের মৃত্যু হয়েছে এবং 900 জন যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছে ৷ পরে প্রায় 300 জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ৷
ট্রেন দুর্ঘটনার পরদিন অর্থাৎ 3 জুন ঘটনাস্থলে পৌঁছন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ৷ তিনি জানান, আহতরা কটক, ভুবনেশ্বর এবং কলকাতায় সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা পাবেন ৷ রেলমন্ত্রী আশ্বস্ত করেন, ভারতীয় রেল ক্ষতিপূরণ দেবে ৷ এর সঙ্গে শুরু হয় তদন্ত ৷ পরে অবশ্য রেল বোর্ড সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় ৷ ঘটনাস্থলে পৌঁছন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক ৷ এমনকী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে পৌঁছন বালাসোরে ৷
দুর্ঘটনার কারণ এবং মৃতের সংখ্যা নিয়ে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয় ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, এই দুর্ঘটনায় 500 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ অন্যদিকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অশ্বিনী বৈষ্ণব বলেন, "ওড়িশা সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী 238 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷" এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জোর দিয়ে জানান, 2 জুন রাতে 238 জনের মৃত্যু হয়েছে ৷ এছাড়া তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে রেল মন্ত্রককে অবহেলার অভিযোগ তোলেন ৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা থেকে মৃতদের পরিবারপিছু 5 লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ৷ গুরুতর আহতদের 1 লক্ষ টাকা এবং সামান্য আহতদের 50 হাজার টাকা আর্থিক সাহায্যের আশ্বাস দেন ৷ পরে তা দেওয়া হয় ৷ 3 জুনই বালাসোরের বাহানাগা বাজারে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ তিনি একটি পর্যালোচনামূলক বৈঠকও করেন ৷ দুর্ঘটনার 51 ঘণ্টা পর 4 জুন রাতে প্রথম একটি মালবাহী গাড়ি ওই রুট দিয়ে যায় ৷ তারপর ধীরে ধীরে ওই রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয় ৷
এই ট্রেন দুর্ঘটনায় সুরক্ষা কবচের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ৷ তৃণমূল দাবি করে, ট্রেনে সুরক্ষা কবচ লাগানো থাকলে এই দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত ৷ প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়, করমণ্ডল এক্সপ্রেসটি লুপ লাইনে ঢুকে পড়েছিল ৷ আর সেখানে সেই সময় মালবাহী ট্রেনটি দাঁড়িয়ে ছিল ৷ এই ট্রেনটির মেন লাইনে থাকার কথা ছিল ৷ তদন্তকারী আধিকারিকরাও জানান, এই রুটে সুরক্ষা কবচ ছিল না ৷
সেপ্টেম্বরের প্রথমে এই দুর্ঘটনায় তিন জন রেল আধিকারিককে গ্রেফতার করা হয় ৷ এর আগে জুলাই মাসে সিবিআই সিনিয়র সেকশন ইঞ্জিনিয়ার (সিগন্যাল) অরুণ কুমার মহন্ত, সেকশন ইঞ্জিনিয়ার আমির খান্দ এবং টেকনিশিয়ান পাপ্পু কুমারকে গ্রেফতার করে ৷ তাঁরা তিনজনই বালাসোরের রেলকর্মী ৷ তাঁদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং প্রমাণ বিলোপের অভিযোগে চার্জশিট পেশ করে পুলিশ ৷
কবচ কী ? ট্রেনচালক বা লোকো পাইলট সিগন্যাল ঠিকঠাক দেখতে না পেলে বা তা অনুসরণ না করলে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে থাকে ৷ এক্ষেত্রে কবচ সতর্ক করে ৷ কবচ থাকলে তা একই রুটে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে অন্য একটি ট্রেন এলে তা জানিয়ে দেয় ৷ এটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ৷ সেই অনুযায়ী লোকো পাইলট ব্রেক কষে ট্রেনটি থামাতে পারেন ৷
সংবাদসংস্থায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, 12841 করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে আপ-মেন লাইনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি দেওয়া হয় ৷ তবে সেটি লুপ লাইনে ঢুকে পড়ে ৷ সেখানে ছিল মালবাহী ট্রেন ৷ দু'টি ট্রেনের মধ্যে ধাক্কায় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের বেশ কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত হয় ৷ এদিকে পাশের মেন লাইনের ট্র্যাক ধরে হাওড়া যাচ্ছিল 12864 বেঙ্গালুরু যশবন্তপুর সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ৷ সেটি ওই লাইনচ্যুত বগির সঙ্গে ধাক্কা লাগে ৷
এর মধ্য়ে এই দুর্ঘটনায় বহু দেহ শনাক্ত না-হওয়ায় সমস্যায় পড়ে ওড়িশা সরকার ৷ 150টি দেহ এমন ছিন্নভিন্ন অবস্থায় ছিল, যে সেগুলি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি ৷ এই অবস্থায় মুখ্যসচিব প্রদীপ জেনা জানান, দাবি করা হয়নি এমন দেহগুলির শেষকৃত্য করে ফেলা হবে ৷ সেগুলির ডিএনএ ও আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করে রেখেছে সরকার ৷ এছাড়া আরও 28টি দেহের শনাক্তকরণ বাকি ছিল ৷ 4 মাস সময়েরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কেউ এই দেহগুলির দাবি জানায়নি ৷ তাই 11 অক্টোবর সকাল 8টায় ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত 28 জনের দেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে ভুবনেশ্বর পৌরনিগম ৷
আরও পড়ুন: