ETV Bharat / bharat

সংবিধান আমাদের ব্যর্থ করেনি, আমরা সংবিধানকে ব্যর্থ করেছি : গোপালকৃষ্ণ গান্ধি - Gopalkrishna Gandhi

ভারতের দক্ষিণ, উত্তর-পূর্ব এলাকাগুলির বিভিন্ন এলাকাগুলি বিভিন্ন সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী ছিল ৷ কিন্তু কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকা উচিত ৷ দেশের ঐক্য-অখণ্ডতা সম্পর্কে কী বললেন গোপালকৃষ্ণ গান্ধি, তাঁর সাক্ষাৎকার নিম্নে দেওয়া হল ৷

গোপালকৃষ্ণ গান্ধি
গোপালকৃষ্ণ গান্ধি
author img

By

Published : Apr 17, 2021, 12:23 PM IST

হায়দরাবাদ, 16 এপ্রিল : ভারতের বিশিষ্ট কূটনীতিক এবং মহাত্মা গান্ধির নাতি গোপালকৃষ্ণ গান্ধির একান্ত সাক্ষাৎকার নেয় ইটিভি ভারত ৷ তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা পদে নিযুক্ত ছিলেন ৷ ভারতের রাষ্ট্রপতির সচিব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ৷ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ৷ প্রশাসনিক, কূটনীতি, সাংবিধানিক ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে অগাধ অভিজ্ঞতা ৷

  • আমরা কি জাতি হিসেবে উন্নততর হচ্ছি, যেভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং শহিদরা ভেবেছিলেন ?

অনেক দিক থেকেই আমরা জাতি হিসেবে অগ্রগতি করছি । আমি পাঁচটা দিকের কথা বলব, যেখানে নিঃসন্দেহে আমরা এগিয়েছি ।

এক, সম্মতির বয়স । এক্ষেত্রে আমি বলতে চাইছি, গড়পরতা যে বয়সে আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, সেটা বেড়েছে । এর ফলে নাবালিকা মায়েদের মৃত্যু কমেছে, জন্ম দেওয়ার পর রক্তপাত, শিশুমৃত্যুও কমে এসেছে । এর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ।

দুই, জন্মের পর শিশুদের গড় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ভারতে নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে । এর কৃতিত্ব ব্যাপক টিকাকরণ এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি, যদিও এক্ষেত্রে এখনও অনেকটাই খামতি রয়ে গেছে ।

তিন, দেশের শহরাঞ্চলে অস্পৃশ্যতার মতো রীতি ক্রমশ পিছু হটছে । আমাদের শহরাঞ্চলে সমাজের বঞ্চিত অংশের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে । কিন্তু গ্রামাঞ্চলে ছবিটা এখনও আশানুরূপ বদলায়নি ।

চার, নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক বাছাই এখন ভারতের গণতান্ত্রিক রোজনামচায় পরিণত হয়েছে । যেভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশাসনিক শক্তি, প্রযুক্তির সহায়তা এবং জনগণের সহযোগিতার অসাধারণ সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে চলে, তা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি ।

পাঁচ, দেশজুড়ে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার নাটকীয় উন্নতি হয়েছে । যাতায়াত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তা স্বাধীনতার আগে অকল্পনীয় ছিল ।

কিন্তু আবার বহু ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি হয়নি । আমি আবার পাঁচটা কারণ তুলে ধরব ।

এক, আমাদের সংবিধান লিঙ্গভিত্তিক সাম্যের কথা বললেও, নারীদের বিরুদ্ধে হিংসা, মেয়েদের সবথেকে বেশি যন্ত্রণা দেওয়া গার্হস্থ্য হিংসা, শিশুদের নিগ্রহ ও পাচার বাধাহীনভাবে চলেছে ।

দুই, বেড়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ বয়সে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে যার গুরুতর প্রভাব পড়ে গ্রামাঞ্চল এবং শহর বা শহরতলির বস্তি এলাকায় । যদিও সবুজ বিপ্লব এবং তার মূল কারিগর, অধ্যাপক এমএস স্বামীনাথনের জন্য দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিপুলভাবে বেড়েছে, এবং দুধও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে এবং বণ্টন হচ্ছে, যার পিছনে রয়েছে আমূলের ড. কুরিয়েনের উদ্যোগ ।

তিন, আদিবাসী সহ দলিতদের বঞ্চনা ব্যাপকভাবে চলছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে তথাকথিত আগ্রাসী উন্নয়ন এবং বিল্ডার লবি । হাতে করে বর্জ্য পরিষ্কারের যে ছবি বেজওয়াদা উইলসন সামনে এনেছেন, তা হল দৃশ্যমান থেকেও অদৃশ্য এক বঞ্চনা ও হিংসার রূপ ।

চার, আমাদের নির্বাচনগুলোতে সবথেকে বড় জয় হয় যার, তাঁর নাম মিস্টার মানি, এবং তার ভাই মিস্টার মাসল । এই দুই-মাথাওয়ালা দানব আমাদের নির্বাচনী বাছাইকে বিকৃত করে, গণতন্ত্রকে পরিহাসে পরিণত করার ভয় দেখায় ।

পাঁচ, শারীরিকভাবে আমরা এখন একটা গ্রিড, কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক সংহতি থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে । শহর ও মেট্রোপলিটান এলাকায় বসবাসকারী, ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকা, প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল অংশের সঙ্গে দরিদ্র ভারতের ব্যবধান উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে । সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের কৃষিজীবী সমাজ । পালাগুম্মি সাইনাথ এই বিষয়টিকে বিশ্বের নজরে এনেছেন ।

  • স্বাধীনতার সাত দশক পরেও আমরা উন্নয়নশীল দেশ । দারিদ্র, বেকারত্ব, অপুষ্টি, লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে আমরা বহু সমীক্ষায় সামনের সারিতে । এটা কি আমাদের সবার লজ্জা নয় ?

এমন কোনও দেশ, কোনও সমাজ নেই, এমনকী সবথেকে উন্নতদের মধ্যে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না, যারা উন্নয়নশীল নয় । তাই উন্নয়নশীল দেশ হওয়া ভুল বা অস্বাভাবিক কিছু নয় । আমাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো বিভিন্ন উপায়ে এমন উন্নয়নশীল সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছে, যা শুধু ধনী ভারতবর্ষ নয়, ন্যায়সঙ্গত ভারতবর্ষ হবে । সমস্যা রয়েছে আমাদের উন্নয়নের নীতিগুলোতে, যা সাম্প্রতিককালে অসমান, অবিচারপূর্ণ, এবং পরিবেশগত দিক থেকে দেখলে বিপজ্জনকভাবে এবং উন্মত্তভাবে দিশাহীন । যদি সরকারি নীতি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ এমনভাবে চলে যে গ্রাম মানেই শিল্পতালুক, জলাশয় মানেই ভবিষ্যতের হাইরাইজের প্লট, গরীব গ্রামবাসীদের বসতভিটে বা লাঙল দেওয়া জমি মানেই অর্থকরী রিয়েল এস্টেট, নদী মানেই বিদ্যুৎ, জঙ্গল মানেই কাঠ আর পাথর মানেই সিমেন্ট – তাহলে আমরা আমাদের সম্পদকে ধ্বংস করছি এবং দুটো ভারত তৈরি করছি – একটা ধনী এবং আরেকটা অনিশ্চয়তাপূর্ণ ।আর নির্বাচনের সময় টাকার খেলা এই অর্থনৈতিক বৈষ্যমের বিস্ফোরণ আটকে দিচ্ছে, যা রাজনৈতিক সংঘাতে পরিণত হয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে । খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের স্বাধীনতার উত্তরাধিকারকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনা দরকার ।

  • চিন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর একই সময় স্বাধীন হয়েছে । কিন্তু তারা ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে ! আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছি না?

অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয়নি । স্বরাজের লক্ষ্যে আমাদের নিজস্ব ভাবনাই আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল । গান্ধি আয়ারল্যান্ড এবং অ্যামেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, কিন্তু তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে একটা দেশীয় দিশা দিয়েছিলেন, যা দারুণ ফল দিয়েছিল । এবং অবশ্যই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও তার ভূমিকা পালন করেছিল । একইরকমভাবে, ড. আম্বেদকরও নকল না করেই অন্যান্য গণতান্ত্রিক সংবিধানকে ব্যবহার করেছিলেন এবং তাঁর খসড়াকে একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভারতীয় রূপ দিয়েছিলেন । এর প্রস্তাবনায় অভিনবভাবে স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রীর আগে ন্যায়কে রাখা হয়েছে । তাই অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা বা তাদের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করাটা আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানের পথ হতে পারে, এমনটা নয় ।

  • রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের সময় জাতি, ধর্ম, আঞ্চলিকতা এবং ভাষার নামে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে । টাকা, মদ আর বন্দুকের নল বড় ভূমিকা পালন করে ! নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই বহু অশুভ কার্যকলাপের উৎস । কেন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা এগুলো বন্ধ করতে পারে না ?

আমরা যেমন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও তেমনই । নির্বাচকরা যা, নির্বাচন ব্যবস্থাও তেমনই হয়ে যায় ।

  • ভারত ‘শক্তিশালী কেন্দ্র – দুর্বল রাজ্যে’র দিকে এগিয়ে চলেছে । এমনটা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কী হবে ?

আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দুর্বল কেন্দ্র এবং শক্তিশালী রাজ্যও দেখেছি । সেটা খারাপ দিকগুলো বন্ধ করার কোনও পদ্ধতি নয় । কে শক্তিশালী আর কে দুর্বল তাতে কিছু তফাৎ হয় না । কে ন্যায়ের পক্ষে আর কে নয় – সেটাই আসল কথা ।

  • ধনী-গরিবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে । মাল্টি-বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যার দিক থেকে ভারত তৃতীয়, আবার একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যায় মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন । আমাদের সংবিধান নির্মাতারা কি এটা আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ?

সংবিধান আমাদের হতাশ করেনি, আমরা সংবিধানকে হতাশ করেছি । (আমার কথা নয়, ধার করা) এর স্থপতিরা প্রজাতন্ত্রকে গড়ে তোলার কাজটা করেছিলেন, আমরা তা বজায় রাখার কাজটা করতে পারিনি ।

  • স্বাধীনতার আগে শক্তিশালী সরকারি ক্ষেত্রের ভিত স্থাপন করা হয়, যাতে ভারত সর্বক্ষেত্রেই আক্ষরিক অর্থে স্বাধীন থাকতে পারে । কিন্তু সরকারগুলো বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে । সেক্ষেত্রে পাবলিক সেক্টরের ভবিষ্যৎ কী ?

জনগণের অবস্থা যেমন, তেমনই ।

  • ভারতীয় সমাজ কি মূলগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ? যদি তাই হয়, তাহলে সমাজে ক্রমশ দক্ষিণপন্থার দিকে ঝোঁক বাড়তে থাকার কারণ কী ?

ডান বা বাম কোনও জায়গা নয়, এক একটা দিশা । তারা বদলাতে পারে, এবং বদলায়ও । ভারত একটা জায়গা, কোনও দিশা নয় । রাজনৈতিক হাওয়া যে দিশাই দেখাক না কেন, ভারত সবকিছুর মধ্যেই টিকে থেকেছে এবং থাকবেও ।

  • ভবিষ্যতে কী কংগ্রেস বা বামেদের মতো সর্বভারতীয় দলগুলো কোনও বিকল্পের সন্ধান দিতে পারবে ?

যদি কংগ্রেস বামদিকে ঝুঁকে থাকে এবং বামেরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে, তাহলে তারা শক্তিশালী থাকবে । এবং যদি তারা ইগো একপাশে সরিয়ে রেখে একসঙ্গে বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে কাজ করে, তাহলে তারা অপ্রতিরোধ্য । ব্রিটেন আমাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল করেনি । আমরা ভেদাভেদ করেছি, ওরা শাসন করেছে । (এটা আমার বাকচাতুর্য নয় । আমি এটা ধার করেছি । সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়ও আমাদের সৎ থাকা প্রয়োজন ।)

  • আমরা আমাদের দেশে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘন দেখছি । অনেক বিশিষ্টজনই বলছেন যে এর ফলে, দেশের ঐক্য ও সংহতি বিপদের মুখে পড়বে । আপনি ভবিষ্যৎটা কীভাবে দেখেন ?

ভারতের দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বকে আমাদের সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় আত্মার স্বার্থে অনমনীয় থাকতে হবে । এই দুই অঞ্চলই কখনও না কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা পোষণ করেছে, এবং দুজনেই পরে গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে সেই ভাবনাকে অপ্রয়োজনীয় বলে সরিয়ে দিয়েছে । কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে তারা আদর্শ ।

ভূ-রাজনৈতিক রাজ্যের ভাবনা পেরিয়ে আমাদের ভাবনাচিন্তা করতে হবে, যদিও তারা সত্য । (আগামী দিনগুলোতে আরও রাজ্য তৈরি হবে) । আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে বাস্তুতন্ত্রের পরিসরগুলোকে সম্মান জানাবে, এবং মানচিত্রের কথা আমাদের ভাবা উচিত । ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক মানচিত্র এবং ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোকে অপরিবর্তিত রেখে, আমাদের ভালর জন্যেই বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক মানচিত্র তৈরি করা উচিত, যেখানে মরুভারত, অরণ্য ভারত, উপকূলবর্তী ভারত, হিমালয় সংলগ্ন ভারত ইত্যাদি চিহ্নিত করা থাকবে, যাতে তাদের লুঠের বদলে সংরক্ষণ করা যায় । আন্দামান ও লাক্ষাদ্বীপকে প্রযুক্তি-বাণিজ্যিক উদ্যোগের পক্ষে লাভজনক হিসেবে দেখা হয় । সংরক্ষণ করার যোগ্য, মূল্যবান, ভঙ্গুর বাসভূমি, যেখানে সংবেদনশীল জনবিন্যাস রয়েছে – এভাবে তাদের দেখা হয় না ।

ফেডারেলিজ়মের অর্থ শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ট্যাক্সের ভাগাভাগি নয় । এটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্রকে চিহ্নিত করা এবং সম্মান করার বিষয়ও বটে ।

  • আজ কি গান্ধির ভাবধারার প্রকৃত উত্তরসূরি কেউ আছে ?

কেউ থাকুক, বা না থাকুক, তাতে কিছুই এসে যায় না । গান্ধি নিজে থাকলেও তাতে গুরুত্ব দিতেন না । গান্ধি চেয়েছিলেন, যাতে আমরা স্বরাজের ভাবধারা সম্পর্কে সচেতন থাকি, যার অর্থ সুরাজ

  • স্বাধীনতা সংগ্রামের চিন্তাধারা ধারণ করার জন্য আপনি তরুণ প্রজন্মকে কি পরামর্শ দেবেন ? দেশকে আরও ভালভাবে গড়ে তুলতে তাদের গঠনমূলক ভূমিকা কী হতে পারে ?

আমি পরামর্শ দেওয়ার কে ? আমাদের প্রজন্ম শুধুই কথা বলে গেছে । তরুণরা সেইসব বুড়োদের পরামর্শ শুনতে শুনতে ক্লান্ত, যারা কেবল ভুলের পর ভুল করে গেলেও নিজেদের জ্ঞানের আধার ভাবে । তরুণরা চায় সৎ পরামর্শ, যেখানে পুরনো ভুল স্বীকার করে নেওয়াও থাকবে, আত্মসংশোধনের তৎপরতা থাকবে এবং ক্ষমতার লোভ থাকবে না – রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুক্ষেত্রেই ।

  • ছ’দশক কংগ্রেসের শাসন সত্ত্বেও, হিন্দু আধিপত্যবাদের বৃদ্ধির পিছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন ? কংগ্রেস এটাকে আটকাতে পারল না কেন ?

আইনজীবী এবং দার্শনিক মেনকা গুরুস্বামী সম্প্রতি ভারতকে মেজরিটি অফ মাইনরিটিজ় বলে বর্ণনা করেছেন । এর থেকে সত্যি বর্ণনা আর হয় বলে আমার জানা নেই । নওরোজি, বেসান্ত, তিলক, গোখলে, গান্ধি, পটেল, আজাদ, নেহরু, রাজাজি, পেরিয়ার, কামরাজ, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস এটা জানত । একইরকমভাবে বি আর আম্বেদকর, দাক্ষায়নী ভেলায়ুধম, আম্মু স্বামীনাথন, দুর্গাভাই দেশমুখ, হংস মেহতা, কুডসিয়া ইজাজ রাসু, রাজকুমারী অমৃত কউরের আইনসভাও এব্যাপারে অবহিত ছিল । সংখ্যালঘুদের এই সমন্বয়ের কথা ভুলে গিয়ে সংখ্যাগুরুত্বের প্রতিযুক্তিই এই আধিপত্যবাদের জন্ম দিয়েছে । তবে আমি একে অমোঘ বলে মনে করি না । নদী যেভাবে চড়াইয়ের দিকে বইতে পারে না, সেরকমই এটা স্থায়ী হবে না ।

  • ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু দক্ষিণপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্লিখন করা হচ্ছে । এর ফল কী হতে পারে ?

অন্যান্য ইতিহাসের মতো ভারতের ইতিহাসকেও যেমন ইচ্ছে লেখা যাবে না । সময়ের পাণ্ডুলিপিতে, জীবনের কলম দিয়ে তা লেখা হয়ে রয়েছে ।

  • গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী ? আপনার কী মনে হয় যে গত কয়েক বছরের অচলাবস্থা থেকে তারা ফের উঠে দাঁড়াতে পারবে ?

1984 সালে যখন ভারতের প্রথম মহাকাশচারী রাকেশ শর্মা তাঁর যানের মধ্যে রয়েছেন, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি জানতে চান যে ভারতকে মহাকাশ থেকে কেমন দেখতে লাগছে ? মুহূর্তের মধ্যে রাকেশ উত্তর দেন, সারে জাহাঁ সে আচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি, ভারত তার মহানতম প্রাপ্তিগুলোর থেকেও মহান, তার সবথেকে বিরাট শক্তির থেকেও বেশি শক্তিশালী । কোনওকিছুই তাকে ভাঙতে পারবে না ।

হায়দরাবাদ, 16 এপ্রিল : ভারতের বিশিষ্ট কূটনীতিক এবং মহাত্মা গান্ধির নাতি গোপালকৃষ্ণ গান্ধির একান্ত সাক্ষাৎকার নেয় ইটিভি ভারত ৷ তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা পদে নিযুক্ত ছিলেন ৷ ভারতের রাষ্ট্রপতির সচিব, দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কার হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ৷ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ৷ প্রশাসনিক, কূটনীতি, সাংবিধানিক ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে অগাধ অভিজ্ঞতা ৷

  • আমরা কি জাতি হিসেবে উন্নততর হচ্ছি, যেভাবে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং শহিদরা ভেবেছিলেন ?

অনেক দিক থেকেই আমরা জাতি হিসেবে অগ্রগতি করছি । আমি পাঁচটা দিকের কথা বলব, যেখানে নিঃসন্দেহে আমরা এগিয়েছি ।

এক, সম্মতির বয়স । এক্ষেত্রে আমি বলতে চাইছি, গড়পরতা যে বয়সে আমাদের সমাজে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, সেটা বেড়েছে । এর ফলে নাবালিকা মায়েদের মৃত্যু কমেছে, জন্ম দেওয়ার পর রক্তপাত, শিশুমৃত্যুও কমে এসেছে । এর জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ।

দুই, জন্মের পর শিশুদের গড় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ভারতে নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে । এর কৃতিত্ব ব্যাপক টিকাকরণ এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি, যদিও এক্ষেত্রে এখনও অনেকটাই খামতি রয়ে গেছে ।

তিন, দেশের শহরাঞ্চলে অস্পৃশ্যতার মতো রীতি ক্রমশ পিছু হটছে । আমাদের শহরাঞ্চলে সমাজের বঞ্চিত অংশের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে । কিন্তু গ্রামাঞ্চলে ছবিটা এখনও আশানুরূপ বদলায়নি ।

চার, নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক বাছাই এখন ভারতের গণতান্ত্রিক রোজনামচায় পরিণত হয়েছে । যেভাবে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশাসনিক শক্তি, প্রযুক্তির সহায়তা এবং জনগণের সহযোগিতার অসাধারণ সমন্বয়ের মধ্যে দিয়ে চলে, তা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি ।

পাঁচ, দেশজুড়ে সড়ক, রেল ও আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার নাটকীয় উন্নতি হয়েছে । যাতায়াত এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তা স্বাধীনতার আগে অকল্পনীয় ছিল ।

কিন্তু আবার বহু ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি হয়নি । আমি আবার পাঁচটা কারণ তুলে ধরব ।

এক, আমাদের সংবিধান লিঙ্গভিত্তিক সাম্যের কথা বললেও, নারীদের বিরুদ্ধে হিংসা, মেয়েদের সবথেকে বেশি যন্ত্রণা দেওয়া গার্হস্থ্য হিংসা, শিশুদের নিগ্রহ ও পাচার বাধাহীনভাবে চলেছে ।

দুই, বেড়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ বয়সে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে যার গুরুতর প্রভাব পড়ে গ্রামাঞ্চল এবং শহর বা শহরতলির বস্তি এলাকায় । যদিও সবুজ বিপ্লব এবং তার মূল কারিগর, অধ্যাপক এমএস স্বামীনাথনের জন্য দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বিপুলভাবে বেড়েছে, এবং দুধও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে এবং বণ্টন হচ্ছে, যার পিছনে রয়েছে আমূলের ড. কুরিয়েনের উদ্যোগ ।

তিন, আদিবাসী সহ দলিতদের বঞ্চনা ব্যাপকভাবে চলছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে তথাকথিত আগ্রাসী উন্নয়ন এবং বিল্ডার লবি । হাতে করে বর্জ্য পরিষ্কারের যে ছবি বেজওয়াদা উইলসন সামনে এনেছেন, তা হল দৃশ্যমান থেকেও অদৃশ্য এক বঞ্চনা ও হিংসার রূপ ।

চার, আমাদের নির্বাচনগুলোতে সবথেকে বড় জয় হয় যার, তাঁর নাম মিস্টার মানি, এবং তার ভাই মিস্টার মাসল । এই দুই-মাথাওয়ালা দানব আমাদের নির্বাচনী বাছাইকে বিকৃত করে, গণতন্ত্রকে পরিহাসে পরিণত করার ভয় দেখায় ।

পাঁচ, শারীরিকভাবে আমরা এখন একটা গ্রিড, কিন্তু সামাজিক-অর্থনৈতিক সংহতি থেকে আমরা এখনও অনেক দূরে । শহর ও মেট্রোপলিটান এলাকায় বসবাসকারী, ক্রমশ ওপরে উঠতে থাকা, প্রযুক্তিগতভাবে শক্তিশালী, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল অংশের সঙ্গে দরিদ্র ভারতের ব্যবধান উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে । সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের কৃষিজীবী সমাজ । পালাগুম্মি সাইনাথ এই বিষয়টিকে বিশ্বের নজরে এনেছেন ।

  • স্বাধীনতার সাত দশক পরেও আমরা উন্নয়নশীল দেশ । দারিদ্র, বেকারত্ব, অপুষ্টি, লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে আমরা বহু সমীক্ষায় সামনের সারিতে । এটা কি আমাদের সবার লজ্জা নয় ?

এমন কোনও দেশ, কোনও সমাজ নেই, এমনকী সবথেকে উন্নতদের মধ্যে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না, যারা উন্নয়নশীল নয় । তাই উন্নয়নশীল দেশ হওয়া ভুল বা অস্বাভাবিক কিছু নয় । আমাদের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো বিভিন্ন উপায়ে এমন উন্নয়নশীল সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছে, যা শুধু ধনী ভারতবর্ষ নয়, ন্যায়সঙ্গত ভারতবর্ষ হবে । সমস্যা রয়েছে আমাদের উন্নয়নের নীতিগুলোতে, যা সাম্প্রতিককালে অসমান, অবিচারপূর্ণ, এবং পরিবেশগত দিক থেকে দেখলে বিপজ্জনকভাবে এবং উন্মত্তভাবে দিশাহীন । যদি সরকারি নীতি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ এমনভাবে চলে যে গ্রাম মানেই শিল্পতালুক, জলাশয় মানেই ভবিষ্যতের হাইরাইজের প্লট, গরীব গ্রামবাসীদের বসতভিটে বা লাঙল দেওয়া জমি মানেই অর্থকরী রিয়েল এস্টেট, নদী মানেই বিদ্যুৎ, জঙ্গল মানেই কাঠ আর পাথর মানেই সিমেন্ট – তাহলে আমরা আমাদের সম্পদকে ধ্বংস করছি এবং দুটো ভারত তৈরি করছি – একটা ধনী এবং আরেকটা অনিশ্চয়তাপূর্ণ ।আর নির্বাচনের সময় টাকার খেলা এই অর্থনৈতিক বৈষ্যমের বিস্ফোরণ আটকে দিচ্ছে, যা রাজনৈতিক সংঘাতে পরিণত হয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে । খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের স্বাধীনতার উত্তরাধিকারকে খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনা দরকার ।

  • চিন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর একই সময় স্বাধীন হয়েছে । কিন্তু তারা ভারতের থেকে অনেক এগিয়ে ! আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছি না?

অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয়নি । স্বরাজের লক্ষ্যে আমাদের নিজস্ব ভাবনাই আমাদের সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল । গান্ধি আয়ারল্যান্ড এবং অ্যামেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, কিন্তু তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে একটা দেশীয় দিশা দিয়েছিলেন, যা দারুণ ফল দিয়েছিল । এবং অবশ্যই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও তার ভূমিকা পালন করেছিল । একইরকমভাবে, ড. আম্বেদকরও নকল না করেই অন্যান্য গণতান্ত্রিক সংবিধানকে ব্যবহার করেছিলেন এবং তাঁর খসড়াকে একটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভারতীয় রূপ দিয়েছিলেন । এর প্রস্তাবনায় অভিনবভাবে স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রীর আগে ন্যায়কে রাখা হয়েছে । তাই অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামা বা তাদের সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করাটা আমাদের সমস্যাগুলো সমাধানের পথ হতে পারে, এমনটা নয় ।

  • রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের সময় জাতি, ধর্ম, আঞ্চলিকতা এবং ভাষার নামে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে । টাকা, মদ আর বন্দুকের নল বড় ভূমিকা পালন করে ! নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই বহু অশুভ কার্যকলাপের উৎস । কেন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা এগুলো বন্ধ করতে পারে না ?

আমরা যেমন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও তেমনই । নির্বাচকরা যা, নির্বাচন ব্যবস্থাও তেমনই হয়ে যায় ।

  • ভারত ‘শক্তিশালী কেন্দ্র – দুর্বল রাজ্যে’র দিকে এগিয়ে চলেছে । এমনটা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে কী হবে ?

আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দুর্বল কেন্দ্র এবং শক্তিশালী রাজ্যও দেখেছি । সেটা খারাপ দিকগুলো বন্ধ করার কোনও পদ্ধতি নয় । কে শক্তিশালী আর কে দুর্বল তাতে কিছু তফাৎ হয় না । কে ন্যায়ের পক্ষে আর কে নয় – সেটাই আসল কথা ।

  • ধনী-গরিবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে । মাল্টি-বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যার দিক থেকে ভারত তৃতীয়, আবার একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যায় মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন । আমাদের সংবিধান নির্মাতারা কি এটা আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন ?

সংবিধান আমাদের হতাশ করেনি, আমরা সংবিধানকে হতাশ করেছি । (আমার কথা নয়, ধার করা) এর স্থপতিরা প্রজাতন্ত্রকে গড়ে তোলার কাজটা করেছিলেন, আমরা তা বজায় রাখার কাজটা করতে পারিনি ।

  • স্বাধীনতার আগে শক্তিশালী সরকারি ক্ষেত্রের ভিত স্থাপন করা হয়, যাতে ভারত সর্বক্ষেত্রেই আক্ষরিক অর্থে স্বাধীন থাকতে পারে । কিন্তু সরকারগুলো বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে । সেক্ষেত্রে পাবলিক সেক্টরের ভবিষ্যৎ কী ?

জনগণের অবস্থা যেমন, তেমনই ।

  • ভারতীয় সমাজ কি মূলগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ? যদি তাই হয়, তাহলে সমাজে ক্রমশ দক্ষিণপন্থার দিকে ঝোঁক বাড়তে থাকার কারণ কী ?

ডান বা বাম কোনও জায়গা নয়, এক একটা দিশা । তারা বদলাতে পারে, এবং বদলায়ও । ভারত একটা জায়গা, কোনও দিশা নয় । রাজনৈতিক হাওয়া যে দিশাই দেখাক না কেন, ভারত সবকিছুর মধ্যেই টিকে থেকেছে এবং থাকবেও ।

  • ভবিষ্যতে কী কংগ্রেস বা বামেদের মতো সর্বভারতীয় দলগুলো কোনও বিকল্পের সন্ধান দিতে পারবে ?

যদি কংগ্রেস বামদিকে ঝুঁকে থাকে এবং বামেরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে, তাহলে তারা শক্তিশালী থাকবে । এবং যদি তারা ইগো একপাশে সরিয়ে রেখে একসঙ্গে বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে কাজ করে, তাহলে তারা অপ্রতিরোধ্য । ব্রিটেন আমাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল করেনি । আমরা ভেদাভেদ করেছি, ওরা শাসন করেছে । (এটা আমার বাকচাতুর্য নয় । আমি এটা ধার করেছি । সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময়ও আমাদের সৎ থাকা প্রয়োজন ।)

  • আমরা আমাদের দেশে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘন দেখছি । অনেক বিশিষ্টজনই বলছেন যে এর ফলে, দেশের ঐক্য ও সংহতি বিপদের মুখে পড়বে । আপনি ভবিষ্যৎটা কীভাবে দেখেন ?

ভারতের দক্ষিণ ও উত্তর-পূর্বকে আমাদের সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় আত্মার স্বার্থে অনমনীয় থাকতে হবে । এই দুই অঞ্চলই কখনও না কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা পোষণ করেছে, এবং দুজনেই পরে গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে সেই ভাবনাকে অপ্রয়োজনীয় বলে সরিয়ে দিয়েছে । কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে তারা আদর্শ ।

ভূ-রাজনৈতিক রাজ্যের ভাবনা পেরিয়ে আমাদের ভাবনাচিন্তা করতে হবে, যদিও তারা সত্য । (আগামী দিনগুলোতে আরও রাজ্য তৈরি হবে) । আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে বাস্তুতন্ত্রের পরিসরগুলোকে সম্মান জানাবে, এবং মানচিত্রের কথা আমাদের ভাবা উচিত । ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক মানচিত্র এবং ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোকে অপরিবর্তিত রেখে, আমাদের ভালর জন্যেই বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক মানচিত্র তৈরি করা উচিত, যেখানে মরুভারত, অরণ্য ভারত, উপকূলবর্তী ভারত, হিমালয় সংলগ্ন ভারত ইত্যাদি চিহ্নিত করা থাকবে, যাতে তাদের লুঠের বদলে সংরক্ষণ করা যায় । আন্দামান ও লাক্ষাদ্বীপকে প্রযুক্তি-বাণিজ্যিক উদ্যোগের পক্ষে লাভজনক হিসেবে দেখা হয় । সংরক্ষণ করার যোগ্য, মূল্যবান, ভঙ্গুর বাসভূমি, যেখানে সংবেদনশীল জনবিন্যাস রয়েছে – এভাবে তাদের দেখা হয় না ।

ফেডারেলিজ়মের অর্থ শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং ট্যাক্সের ভাগাভাগি নয় । এটা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈচিত্রকে চিহ্নিত করা এবং সম্মান করার বিষয়ও বটে ।

  • আজ কি গান্ধির ভাবধারার প্রকৃত উত্তরসূরি কেউ আছে ?

কেউ থাকুক, বা না থাকুক, তাতে কিছুই এসে যায় না । গান্ধি নিজে থাকলেও তাতে গুরুত্ব দিতেন না । গান্ধি চেয়েছিলেন, যাতে আমরা স্বরাজের ভাবধারা সম্পর্কে সচেতন থাকি, যার অর্থ সুরাজ

  • স্বাধীনতা সংগ্রামের চিন্তাধারা ধারণ করার জন্য আপনি তরুণ প্রজন্মকে কি পরামর্শ দেবেন ? দেশকে আরও ভালভাবে গড়ে তুলতে তাদের গঠনমূলক ভূমিকা কী হতে পারে ?

আমি পরামর্শ দেওয়ার কে ? আমাদের প্রজন্ম শুধুই কথা বলে গেছে । তরুণরা সেইসব বুড়োদের পরামর্শ শুনতে শুনতে ক্লান্ত, যারা কেবল ভুলের পর ভুল করে গেলেও নিজেদের জ্ঞানের আধার ভাবে । তরুণরা চায় সৎ পরামর্শ, যেখানে পুরনো ভুল স্বীকার করে নেওয়াও থাকবে, আত্মসংশোধনের তৎপরতা থাকবে এবং ক্ষমতার লোভ থাকবে না – রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুক্ষেত্রেই ।

  • ছ’দশক কংগ্রেসের শাসন সত্ত্বেও, হিন্দু আধিপত্যবাদের বৃদ্ধির পিছনে কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন ? কংগ্রেস এটাকে আটকাতে পারল না কেন ?

আইনজীবী এবং দার্শনিক মেনকা গুরুস্বামী সম্প্রতি ভারতকে মেজরিটি অফ মাইনরিটিজ় বলে বর্ণনা করেছেন । এর থেকে সত্যি বর্ণনা আর হয় বলে আমার জানা নেই । নওরোজি, বেসান্ত, তিলক, গোখলে, গান্ধি, পটেল, আজাদ, নেহরু, রাজাজি, পেরিয়ার, কামরাজ, ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, জয়প্রকাশ নারায়ণের কংগ্রেস এটা জানত । একইরকমভাবে বি আর আম্বেদকর, দাক্ষায়নী ভেলায়ুধম, আম্মু স্বামীনাথন, দুর্গাভাই দেশমুখ, হংস মেহতা, কুডসিয়া ইজাজ রাসু, রাজকুমারী অমৃত কউরের আইনসভাও এব্যাপারে অবহিত ছিল । সংখ্যালঘুদের এই সমন্বয়ের কথা ভুলে গিয়ে সংখ্যাগুরুত্বের প্রতিযুক্তিই এই আধিপত্যবাদের জন্ম দিয়েছে । তবে আমি একে অমোঘ বলে মনে করি না । নদী যেভাবে চড়াইয়ের দিকে বইতে পারে না, সেরকমই এটা স্থায়ী হবে না ।

  • ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু দক্ষিণপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্লিখন করা হচ্ছে । এর ফল কী হতে পারে ?

অন্যান্য ইতিহাসের মতো ভারতের ইতিহাসকেও যেমন ইচ্ছে লেখা যাবে না । সময়ের পাণ্ডুলিপিতে, জীবনের কলম দিয়ে তা লেখা হয়ে রয়েছে ।

  • গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী ? আপনার কী মনে হয় যে গত কয়েক বছরের অচলাবস্থা থেকে তারা ফের উঠে দাঁড়াতে পারবে ?

1984 সালে যখন ভারতের প্রথম মহাকাশচারী রাকেশ শর্মা তাঁর যানের মধ্যে রয়েছেন, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি জানতে চান যে ভারতকে মহাকাশ থেকে কেমন দেখতে লাগছে ? মুহূর্তের মধ্যে রাকেশ উত্তর দেন, সারে জাহাঁ সে আচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি, ভারত তার মহানতম প্রাপ্তিগুলোর থেকেও মহান, তার সবথেকে বিরাট শক্তির থেকেও বেশি শক্তিশালী । কোনওকিছুই তাকে ভাঙতে পারবে না ।

ETV Bharat Logo

Copyright © 2025 Ushodaya Enterprises Pvt. Ltd., All Rights Reserved.