উত্তরপ্রদেশের পর কেরালা হল দ্বিতীয় রাজ্য যেখানে সর্বাধিক সংখ্যায় আরএসএস এর ‘শাখা’ রয়েছে । একদিকে যখন উত্তরপ্রদেশে শাসন করছে বিজেপি সরকার, তখন অন্যদিকে কেরালা বিজেপির একজন মাত্র বিধায়ক রয়েছেন । কেরালা নির্বাচনের ইতিহাসে প্রথমবার 2016 সালে বিজেপি কোনও আসনে জয়লাভ করে । কেরালা প্রায় 5 হাজারের বেশি আরএসএস-এর শাখা রয়েছে । কিন্তু আরএসএস-এর শাখার এই ব্যাপক উপস্থিতি বিজেপির জন্য ভোট তৈরি করতে পারেনি । 2006 সাল পর্যন্ত কংগ্রেস বা সিপিএমের ভোট ব্যাঙ্কে ভাঙন ধরাতে পারেনি । এটা মানতেই হবে ।
1980 সালে বিজেপি তৈরি হয় । তারপর থেকে এই দল শিখেছে যে অস্থির রাজনৈতিক পরিবেশে অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য কীভাবে অধ্যাবসায় দেখাতে হয় । যখন ভারতীয় জন সংঘ ও জনতা পার্টির ক্যাডারদের নিয়ে বিজেপি তৈরি হয়, তখন তারা হিন্দুত্বকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক উদ্যমতার মধ্যে আটকে পড়েছিল । আর কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে কাজ করে অধিকাংশ রাজ্যে নিজেদের একটি শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে ।
একটা রাজ্য যেখানে গঠনমূলক রাজনীতির জন্য অস্থির পরিস্থিতি রয়েছে, একটা রাজ্য যেখানে দেশের অধিকাংশ সংস্কারমূলক আন্দোলন আকার পেয়েছিল এবং সফলভাবে পরিচালিত হয়েছিল, একটা রাজ্য যেখানে গেরুয়া পরিহিত সাধুরা দলিতদের উন্নতির কথা বলেন এবং ব্রাহ্মণ্যবাদকে অস্বীকার করেন, সেই রাজ্য কেরালায় বিজেপির এইগুণ লক্ষ্যে অবিচল থেকে অবিরাম লড়াই করতে সাহায্য করেছে । আর বিজেপিকে নিজেদের ক্যাডার গড়ে তুলতেও সাহায্য করেছে । এই শক্তি সঞ্চয় করার পর তারা এখন 20 টি বিধানসভা আসনে কড়া লড়াই করার আশা করছে এবং আসন্ন নির্বাচনে অন্তত 5 টি আসনে জয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ।
কেরালায় বিজেপির রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে 2006 সালের পর থেকে বিজেপি সেখানে ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধি করতে শুরু করে । তখনও পর্যন্ত কেরালার 140 টি বিধানসভা কেন্দ্রের অধিকাংশতে বিজেপির 5 হাজার থেকে 10 হাজার ভোট গড়েছিল । তাদের এলডিএফ অথবা ইউডিএফ এর থেকে অনেকটা নিচে তৃতীয় স্থানে থেকেই সন্তুষ্ট থাকতে হত ।
নিজেদের লক্ষ্য থেকে সরে আসা এবং উদারবাদী কেরালার বিশ্বাস জয় করার কাজে হাল ছেড়ে দেওয়া ওই দলের পক্ষে সবচেয়ে সহজ ছিল । কিন্তু এই রাজ্যের বিজেপি ও আরএসএস নেতৃত্বের অন্য পরিকল্পনা ছিল । তারা বুঝতে পেরেছিল যে বড় এলাকাগুলিতে যুদ্ধ করার চেয়ে ছোট অঞ্চলগুলিতে কঠিন লড়াই করার গুরুত্ব বেশি । এই ধরণের এলাকাগুলির জাতি ও সম্প্রদায় গত শক্তি বিশ্লেষণ করা হয় । বিজেপি কেরালায় দু’টি বিধানসভা আসনের উপর নজর দেয় । তার মধ্যে একটি কাসারগোড়ের মঞ্জেসরম এবং অন্যটি ত্রিবান্দামের নেমম ।
মঞ্জেসরমে কানাড়া ব্রাহ্মণদের একটা বড় অংশ থাকে । যারা ঐতিহাসিক ভাবে হিন্দুত্ববাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী । তাই তারা বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি করার কাজে সাহায্য করেছিল । কাসাড়াগড়ে রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করতে গিয়ে বিজেপি স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পেরেছিল । এই কাজে তারা সাহায্য পেয়েছিল ম্যাঙ্গালোরের ব্যবসায়ীদের । তবে এই আসনে এখনও বিজেপি জিততে পারেনি । এখানে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মুসলিম । যারা ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ বা আইইউএমএল এর সমর্থক । এই দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ অংশ । মঞ্জেসরমে জিততে না পারার কারণ হিসেবে বিজেপির অভিযোগ ছিল যে সিপিএম ক্যাডাররা আইইউএমএল-কে ভোট দিয়েছে ।
আরও পড়ুন : বাকস্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল অ্য়ামেরিকার
একই ভাবে নেমম এলাকায় আরএসএস বেশ শক্তিশালী এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারই হিন্দু । তাঁরাই কেরালায় বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি সাহায্য করছিল । কেরালায় বিজেপির প্রথম সভাপতি ও রাজাগোপাল এই কেন্দ্র থেকে একাধিকবার হেরেছেন । তারপরও দল আশা ছাড়েনি । প্রতিটি নির্বাচনে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট চাওয়ার পরও হেরে যাওয়ায় সোশাল মিডিয়ায় ও রাজাগোপালকে নিয়ে ট্রোল করা হয় । তাঁকে ‘ইলেকশন আঙ্কল’ বলা শুরু হয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত 2016 সালে তিনি নেমম বিধানসভা আসনে জিততে সক্ষম হন এবং কেরলে বিজেপির প্রথম বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন । তাই এবার সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনের ভোটের ধরন বিশ্লেষণ করে বিজেপি 20 টি আসনে জেতার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে ।
ত্রিবান্দাম, কোল্লাম, পালাক্কড়, ত্রিশূর ও কাসাড়াগড় জেলায় বিরোধীদের কড়া লড়াইয়ের মুখে ফেলে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তারা । এই লড়াই বিজেপির জন্য কখনও সহজ ছিল না । কারণ, তাদের আদর্শকে কেরালায় খুব কমই গ্রহণ করা হয়েছিল । শুধুমাত্র আরএসএস এর ভাবধারার প্রচারকারী এম পি পরমেশ্বরনের মতো বুদ্ধিজীবীর অংশগ্রহণ করা ছাড়া কেরলের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বা রাজনৈতিক পরিসরে আরএসএস বা বিজেপির কতৃত্ব খুব সামান্য । যখন কেরলে সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলন গতি পেয়েছে, সমস্ত জাতি ও সম্প্রদায়কে সমান অধিকার দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, ভূমি সংস্কার নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, মন্দিরে সবাইকে প্রবেশ করতে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে, তখন হিন্দুত্ববাদীদের বড় অংশ এর বিরোধিতাই করেছে । 1980 সালে বিজেপির কেরালা শাখা তৈরি হওয়ার পরও তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব আরএসএস এর অধীনেই ছিল । ধর্মীয় মেরুকরণ প্রকাশ্যে আসার পর এবং ইসলামিক মৌলবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার পর, বিশেষ করে 1990 সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে যাওয়ার পর বিজেপি নিরপেক্ষ হিন্দুদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে পেরেছিল এবং তার ফলেই কেরলের মতো একটি ‘সংস্কৃতি সমৃদ্ধ’ রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল ।
আরও পড়ুন : সোশাল মিডিয়ায় ভুয়ো খবর, টুইটার ও কেন্দ্রকে সুপ্রিম নোটিস
তবে দেশের অন্য অনেক রাজ্য যেখানে কংগ্রেস তাদের শক্তি কার্যত বিজেপির হাতে তুলে দিয়েছে, এখানেই পরিস্থিতি প্রায় একইরকম । কেরালায় কংগ্রেসের শক্তিক্ষয়ই বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করছে । কেরালায় কংগ্রেস পার্টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নরম হিন্দুত্ববাদের রাস্তা নেয় । যদিও মুসলিম সম্প্রদায় এবং খ্রিষ্টান উদ্বাস্তুদের সঙ্গেও তাঁদের একটা সংযোগ রয়েছে । দলের যে সমস্ত সমর্থকরা তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শের কেন্দ্রে ‘সংস্কৃতি’ ও ‘নীতিবোধ’কে রাখেন, তাঁরা সবসময় একেবারে শেষ সীমায় থাকতেন এবং এখন তাঁরাই ক্রমশ বিজেপির দিকে সরে যাচ্ছেন । অনেকবেশি আগ্রাসী, সংস্কারমুখী, ধর্ম বিরোধী সিপিএম কখনোই হিন্দুত্বাবাদী কংগ্রেস সমর্থকদের বিকল্প হতে পারে না । আর বিজেপি সেই লাভই ঘরে তুলছে ।
বিজেপি-র কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসা এবং অন্য রাজ্যগুলিতে তাদের কৃতিত্বমূলক উপস্থিতি কংগ্রেসের তুলনায় একেবারে বিপরীত চিত্র তুলে ধরে । যখন কংগ্রেস জাতীয় দল হিসেবে শক্তিশালী ছিল, তখন কেরালায় বিজেপি তাদের ক্যাডার বৃদ্ধি করতে পেরেছিল । এখন রাজনৈতিক প্রচারকে গতি দিতে দিল্লিতে বসে সর্বক্ষণ কাজ চলছে, যা দলের আঞ্চলিক অ্যাজেন্ডাগুলির মধ্যে সমন্বয় তৈরি করছে ও নিয়ন্ত্রণ করছে । এই ভাবেই কেরালায় বেড়ে উঠছে বিজেপি । রাজনৈতিক ব্যাখ্যা প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে সোশ্যাল মাধ্যম উঠে আসায়, তাও বিজেপিকে সাহায্য করেছে । কারণ, তাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা এবং রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণ করার জন্য বিজেপির আইটি সেল খুব শক্তিশালী ।
সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচনে বিজেপি বেশ কিছু পঞ্চায়েত এলডিএফ এবং ইউডিএফ এর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে । গ্রামীণ অঞ্চলে যে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা দেখাই যাচ্ছে । আসন্ন নির্বাচনে গ্রামীণ এলাকাগুলির উপরই বিজেপি সবচেয়ে বেশি নজর দিয়েছে । কেরালার ১৪০ টি বিধানসভা আসনে সরাসরি এলডিএফ বা ইউডিএফ এর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াই করার মতো শক্তি অর্জন করতে বিজেপির হয়ত আরও দশ বছর সময় লাগবে । কিন্তু এটা এখনই না হলেও পরে অবশ্যই হবে ।