‘বিশ্ব মানব পাচার বিরোধী দিবস’ হিসেবে বিশেষ একটি দিন বেছে নেওয়ার পিছনে কারণ রয়েছে ৷ রাষ্ট্রসংঘের তরফে বলা হয়েছে, মানব পাচার সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে এবং যাদের পাচার করা হয় তাদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষার জন্য 30 জুলাই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে ৷
মানব পাচার কী ?
রাষ্ট্রসংঘ এই বিষয়ে একটি সংজ্ঞা দিয়েছে ৷ সাধারণত কোনও ব্যক্তিকে জোর করে, হুমকি দিয়ে, মিথ্যা বলে, ক্ষমতার জোরে অন্য ব্যক্তি এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যায় ৷ অপহৃত ব্যক্তিকে অপব্যহার করে এবং তাঁকে শোষণ করে- তখন তাকে মানব পাচার হিসেবে ধরা হয় ৷ মানব পাচারকে একটি জঘন্য অপরাধ হিসেবে সারা বিশ্বে গণ্য করা হয় ৷ এর ফলে প্রত্যেক দেশ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় ৷ তথ্য বলছে, সারা বিশ্বে যত মানুষ পাচার হন তার 72 শতাংশ মহিলা ও নাবালিকা ৷ রাষ্ট্রসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ (UNODC) বলছে, 2004 সালে বিশ্বে যে পরিমাণ শিশু পাচার হয়েছে, তা 2016 সালে দ্বিগুণ হয়েছে ৷
কোন কোন ক্ষেত্রের জন্য মানব পাচার বেশি হয় ?
- অনেক সময় ভিন্ন জায়গায় পরিচারকের কাজের প্রলোভন দেখিয়ে মহিলা, শিশু বা পুরুষদের নিয়ে যাওয়া হয় ৷ কাজে যোগ দেওয়ার পর তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হয় ৷ টাকা-পয়সা দেওয়া হয় না ৷ এমনকী তাদের বলা হয়, সেখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা নেই ৷ পরিচারকের কাজ করতে তাঁরা বাধ্য হন ৷
- মহিলা, শিশু বা পুরুষদের যৌনপল্লিতে পাচার করার ভূরি ভূরি নিদর্শন রয়েছে ৷
- বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমিকের কাজ করানোরও অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন সময় ৷ এক দেশ থেকে অন্য দেশে শ্রমিকের কাজ করতে গিয়ে এরকম হয়রানির মধ্যে পড়েন অনেকে ৷ শ্রমিকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে মনে করা হয় এবং তাঁদের বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা হয় ৷
- ঋণ পরিশোধের জন্য অনেক সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয় ৷ যতদিন না সেই ঋণ পরিশেধ হয়, ততদিন কাজ ছেড়ে যেতে পারেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ৷ সারা বিশ্বে দাসত্বের অন্যতম উদাহরণ এটি ৷
- শিশুকে দিয়ে করানো যেকোনও ধরনের জোরপূর্বক শ্রম আইনি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় ৷
- বিনা অনুমতিতে মহিলা ও নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়ার প্রথা আজও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত রয়েছে ৷ বিশেষত দরিদ্র ও সমাজে পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে মহিলা ও নাবালিকাদের অর্থের প্রলোভন দেখায় পাচারকারী ও জঙ্গি সংগঠনগুলি ৷ এরপর তাদের অপরাধমূলক ও জঙ্গি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য করা হয় ৷
নাদিয়া মুরাদ, যিনি 2018 সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান, প্রথম পাচার হওয়া মহিলা যাঁকে রাষ্ট্রসংঘ তাদের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর হিসেবে নিয়োগ করে ৷ মানব পাচার ও যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের জন্য নাদিয়া নোবেল পান ৷
ভারতে মানব পাচার
মানব পাচার ভারতের 20 থেকে 65 মিলিয়ন মানুষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে ৷ দেশের মধ্যে মহিলা ও নাবালিকাদের বিভিন্ন যৌনপল্লিতে ও জোরপূর্বক বিয়ের মাধ্যমে পাচার করা হয় ৷ যেসব জায়গায় ছেলেদের অমুপাতে মেয়েদের সংখ্যা অনেক কম, সেখানে নারী পাচার আকছার দেখা যায় ৷ পাশাপাশি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিক, পরিচারক, ভিক্ষুক ও কৃষি ক্ষেত্রে শিশুশ্রমের মতো উদাহরণ প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায় ৷ জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির কাছে শিশুদের পাচার করা হয় ৷
ভারতে পাচার সংক্রান্ত সাংবিধানিক ধারা ও বিভিন্ন আইন
- অ্যান্টি ট্রাফিকিং সেল (ATC)- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে অ্যান্টি ট্রাফিকিং নোডাল সেল তৈরি করা হয় ৷ মানব পাচারের মতো অপরাধ রুখতে রাজ্য সরকারগুলি যেসব পদক্ষেপ করে, তা নজরে রাখা এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ করে এই সেল ৷
- পাচার বিরোধী আইন- 2018 সালে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মেনকা গান্ধি অ্যান্টি ট্রাফিকিং বিল সংসদে পেশ করেন ৷ কিন্তু বিলটি লোকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় পাশ হয়নি ৷
- সব রাজ্যে পাচার বিরোধী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রস্তাব ওঠে সংসদে ৷ পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে, অভিযুক্তের 10 বছরের জেল ও এক লাখ টাকা জরিমানার দাবি করা হয় ৷ বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম, শিশুশ্রম এবং যেখান থেকে AIDS-এর মতো রোগ ছড়াতে পারে ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে বাধ্য করা হয়- সেই সব অপরাধের জন্য এই আইন চালুর দাবি ওঠে ৷
- মানেকা গান্ধি যে বিল পেশ করেছিলেন, তাতে ন্যাশনাল অ্যান্টি ট্রাফিকিং ব্যুরো (NATB) তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয় ৷ পাশাপাশি 10 কোটি টাকা খরচ করে পুনর্বাসন কমিটি ও ফান্ড এবং ত্রাণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেওয়া হয় বিলে ৷ পাচারে ব্যবহৃত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয় ৷
সাংবিধানিক ধারা
- 23(1) ধারা- দেশে মানব পাচার এবং বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য করা নিষিদ্ধ এবং আইনত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে ৷
- 21 ধারা- 1) সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, বাঁচার অধিকার শুধু শারীরিক নয়, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচা ৷
2) ইমমরাল ট্রাফিক (প্রিভেনশন) অ্যাক্ট, 1986-এর অধীনে যৌনপল্লিতে পাচার করার অভিযোগে শাস্তি পেতে হবে ৷
3) 1976-এর বন্ডেড লেবার সিস্টেম (অ্যাবলিশন) আইন অনুযায়ী ভারতে বাধ্য শ্রম এবং জোরপূর্বক শ্রম নিষিদ্ধ ৷ পাশাপাশি 1986-র চাইল্ড লেবার (প্রোহিবিশন অ্যান্ড অ্যাবলিশন) ও জুভেনাইল জাস্টিস আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ ৷
4) ভারতীয় সংবিধানের 366(এ) ও 372 ধারা অনুযায়ী যথাক্রমে অপহরণ ও শিশুদের যৌনপল্লিতে বিক্রি নিষিদ্ধ ৷
5) ফ্যাক্টরিজ় অ্যাক্ট বা কারখানা আইন, 1968-র মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা হয় ৷
ভারতে বর্তমান অবস্থা
- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে মানব পাচার বিরোধী ইউনিট (AHTU) তৈরিতে রাজ্যগুলিকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয় ৷ দেশের 332টি জেলায় এই ইউনিট তৈরি করা হয়েছে ৷
- 2018 সালে মোট 67,134টি শিশুর নিখোঁজের রিপোর্ট এসেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (NCRB)-র কাছে ৷
- ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (অ্যামেন্ডমেন্ট) আইন, 2019 NIA-কে ভারতীয় দণ্ডবিধির 370 ও 370 (এ)-র অধীনে পাচারের মামলার তদন্তের অধিকার দেয় ৷
- রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলিতে মানব পাচার বিরোধী ইউনিট তৈরির জন্য আর্থিক সাহায্যের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার ৷ এর জন্য 100 কোটি টাকার ‘নির্ভয়া ফান্ড’ তৈরি করা হয়েছে ৷
গত তিন বছরে দেশে মানব পাচার
বছর | সংখ্যা | অভিযুক্ত |
2016 | 8132 | 159 |
2017 | 2854 | 249 |
2018 | 2465 | 432 |
প্রথম 5টি রাজ্য
পশ্চিমবঙ্গ
সাল- 2016- 3579 , 2017- 357, 2018-172
মহারাষ্ট্র
সাল- 2016- 517, 2017- 310, 2018- 311
রাজস্থান
সাল- 2016-1422 , 2017-316, 2018-86
তেলাঙ্গানা
সাল- 2016- 229, 2017- 329, 2018- 242
অন্ধ্রপ্রদেশ
সাল- 2016- 239, 2017- 218, 2018- 240
NCRB-র রিপোর্ট অনুযায়ী নিখোঁজ নারী ও শিশু
রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সর্বোচ্চ নিখোঁজ মহিলা
মহারাষ্ট্র
2016-28316 , 2017-29279 , 2018- 33964
পশ্চিমবঙ্গ
2016-24937 , 2017- 23813, 2018- 31299
মধ্যপ্রদেশ
2016- 21435, 2017- 26587, 2018- 29761
দিল্লি
2016- 12067, 2017- 12202, 2018- 13272
নিখোঁজ শিশু
মধ্যপ্রদেশ
2018- 10038
পশ্চিমবঙ্গ
2018- 8205
বিহার
2018- 6950
দিল্লি
2018- 6541
তামিলনাড়ু
2018- 4271
COVID-19’এর প্রভাব
- চলতি বছরে COVID-19 এর প্রভাব সব থেকে শিশুদের উপর পড়েছে ৷ স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা ঘরে বন্দী ৷ তাদের উপর সবথেকে বেশি যৌন নির্যাতন হয়েছে ৷
- পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরার সময় বহু শিশু পাচার হয়েছে ৷
- COVID-19 এর প্রভাব সারা বিশ্বের মানুষের উপর পড়েছে ৷ আর্থিক সংকট, জীবন ধারণে সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষ ৷ যেসব মানুষ আগেই দারিদ্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন, তাঁরা এই পরিস্থিতিতে আরও অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন ৷ সেই সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীরা ৷
- সারা বিশ্বে একটানা ও সাময়িক লকডাউনের কারণে পাচার হওয়া নারী, শিশু ও পুরুষরা বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়েছেন ৷ তাঁরা চাইলেও সেই যায়গা থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই ৷
- পাচার হওয়া ব্যক্তি ও শিশুদের উপর লকডাউনের সময় অত্যাচার বেড়েছে ৷ পাশাপাশি অনেক বেশি সময় ধরে কাজ করতে তাঁদের বাধ্য করা হয়েছে ৷ আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কায় তাঁদের স্বাস্থ্যের কথাও ভাবেনি পাচারকারীরা ৷
- পাচার হওয়া ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় নথি আটকে রাখায় সমস্তরকম সামাজিক সুরক্ষা ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ৷
- পুলিশ ও প্রশাসন COVID-19 এর মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকায় অন্যান্য বিষয়ে নজর কম ৷ ফলে বিচারের আশায় অপেক্ষা করতে হচ্ছে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের ৷