অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন ভারত সফর ঘিরে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ হবে বলে আশা করা হয়েছিল ৷ এই সফরের ঘোষণা করার সময় ট্রাম্প জানান, যদি সহমতে পৌঁছানো যায়, তবেই বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষর হবে ৷ ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও বাণিজ্যের বিষয়গুলিই প্রশাসনের নীতিকে পরিচালিত করবে ৷ অ্যামেরিকা ও ভারত বরাবরই পরস্পরকে কৌশলগত সহযোগী বলে মনে করে ৷ অথচ দুই দেশের বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্যা কিছুতেই মিটছে না ৷ দুই দেশের মধ্যে দুগ্ধজাতীয় ব্যবসা, কৃষিক্ষেত্র ও প্রযুক্তিক্ষেত্র নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে ৷ চিন, মেক্সিকো, জাপানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সাক্ষর করে ট্রাম্প এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) মতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলির উপর সেভাবে ভরসা করেন না ৷
ব্যবসা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা ভারতের সবচেয়ে বড় সহযোগী ৷ ২০১৪ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল 182 বিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলার ৷ এটা অনুমান করা ভুল হবে না যে যদি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক আগের অবস্থায় ফিরে যায়, তাহলে এই সংখ্যাটা কয়েক বছরের মধ্যে 200 বিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলারে পৌঁছে যাবে ৷ এই বাণিজ্য সম্ভাবনার জন্যই অ্যামেরিকা ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি এখনই খুব প্রয়োজন ৷ এই বিষয়ে চিনের বাস্তবসম্মত প্রচেষ্টা থেকে আমাদের এক-দু’টি বিষয় শেখা উচিত ৷ আমাদের দেশগুলির মধ্যে তৈরি এই বাণিজ্য উত্তেজনা প্রশমিত হলে তবেই আমাদের সঙ্গে অ্যামেরিকার কৌশলগত সম্পর্ক আরও মজবুত হবে ৷
চিনের ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার রাখার কৌশল তৈরিও এবার ট্রাম্পের আলোচ্য সূচির উপরের দিকে থাকবে ৷ গত বছর পেন্টাগনের তরফে ‘Indo-Pacific’ শব্দ ব্যবহারের পরিবর্তে ‘Asia-Pacific’ শব্দ ব্যবহার করা হয় ৷ এর থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থায়িত্বরক্ষায় ভারতকে অ্যামেরিকা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে ৷ ভারত, অ্যামেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথ সামরিক অনুশীলনকে এই অঞ্চলে চিনের আগ্রাসনের প্রেক্ষিতেই দেখা উচিত ৷ গত বছর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনের মাঝে এই চার দেশের বিদেশমন্ত্রীরা বৈঠক করেন ৷ ওই বৈঠক থেকেই ইঙ্গিত মিলেছিল যে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে সামলাতে সামরিক অনুশীলন হতে চলেছে ৷
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর গোটা বিশ্বের কাছে অ্যামেরিকার অবস্থান কিছুটা হলেও নেমেছে ৷ এই পরিস্থিতিতে আর্থিক ও সামরিক ক্ষেত্রে গোটা বিশ্বের কাছে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে সক্ষম হয়েছে চিন ৷ ভারতের প্রতি চিনের এই আগ্রাসী মনোভাবের একাধিক প্রমাণ মিলেছে ৷ রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ অধিবেশনে কাশ্মীর ইশুতে সরব হওয়াও চিনের এই আগ্রাসী মনোভাবের একটি অংশ ৷ এটা এখন সর্বজনবিদিত যে চিন ও পাকিস্তান সামরিক দিক দিয়ে ভারতের কাছে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে ৷ চিন বিশ্বজুড়ে অ্যামেরিকার প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে ৷ তাই নিজেদের সুরক্ষার জন্য ভারতের উচিত অ্যামেরিকা ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি করা ৷ চিন-বিরোধী কোনও শিবিরে আমাদের যুক্ত হওয়া উচিত নয় ৷ কিন্তু কূটনৈতিক উপায়ে চিনের এই আগ্রাসী মনোভাবের জবাব দেওয়াও জরুরি ৷ চিন যেভাবে দক্ষিণ চিন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে এবং সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করছে, তা গোটা বিশ্বের জন্যই বিপদসংকেত দিচ্ছে ৷ অ্যামেরিকাও বুঝতে পারছে যে তাদের একার পক্ষে চিনের এই আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব নয় ৷ তাই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ৷ দুই দেশের বিভিন্ন চুক্তির নিরিখে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে অনুশীলন ও সংযোগরক্ষায় সহযোগিতা আমরা দেখতে পেয়েছি ৷ গত 12 বছরে ভারত অ্যামেরিকার কাছ থেকে 20 বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে ৷ এর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায় ৷
ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে যতবার শীর্ষস্তরের বৈঠক হয়েছে, ততবাই পাকিস্তানের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে ৷ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও বহুবার জানিয়েছেন যে দুই দেশ রাজি থাকলে তিনি কাশ্মীর বিষয়ে মধ্যস্থতা করতে রাজি ৷ প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পের উপস্থিতিতে এক সাংবাদিক বৈঠকের সময় জানিয়েছিলেন যে এই বিষয়ে মধ্যস্থতার কোনও অবকাশ নেই ৷ সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার প্রসঙ্গে পাকিস্তানকে বারবার অ্যামেরিকা বলেছে যে সন্ত্রাসবাদীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার কাজ বন্ধ করার জন্য ৷
ভারত ও অ্যামেরিকার মধ্যে সন্ত্রাসবাদ দমনে সর্বোচ্চস্তরের পারস্পরিক সহযোগিতা বরাবর বজায় থেকেছে এবং এই বিষয়টি আরও মজবুত করা প্রয়োজন ৷ ট্রাম্প ভারতকে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা ফের শুরু করার অনুরোধ করতে পারেন ৷ এই পরিস্থিতিতে এটা প্রমাণিত যে পাকিস্তানের সঙ্গে এখন কোনও গঠনমূলক আলোচনা চলতে পারে না ৷ সাধারণত ভারত সফরের পরে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্টরা পাকিস্তানেও যেতেন ৷ কিন্তু এবার ট্রাম্প সেটা করছেন না ৷ পাকিস্তান যে এই মুহূর্তে সফর সহায়ক নয়, সেই বার্তাই ট্রাম্প দিয়ে দিলেন ৷
লিখছেন সুরেশ বাফনা