বহু রোগের কারণ জলদূষণ ৷ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জলের গুরুত্ব অপরিহার্য ৷ ঠিক তেমনই সমান গুরুত্বপূর্ণ তার শুদ্ধতা । মানব শরীরের 50 থেকে 75 শতাংশ অধিকার করে রয়েছে জল । দেহের দৈনিক তাপমাত্রা এবং শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াগুলি সক্রিয় রাখতে জল অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব পালন করে । আমরা যদি নিয়ম করে জল পান করি তাহলে শরীরের অনেক সমস্যাই মিটে যাবে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (2019)-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বে মোট জনসংখ্যার 146 মিলিয়ন মানুষ ( প্রায় 19 শতাংশ ) সঠিক-বিশুদ্ধ-স্বচ্ছ জল পান করেন না ।
জাতীয় নমুনা জরিপ (NSS) জানিয়েছে, মূলত গ্রামীণ এলাকায় অধিকাংশ মানুষ পরিশুদ্ধ না করেই জল পান করেন । একাধিক পর্যবেক্ষণের ফলে উঠে এসেছে, বিশ্বজুড়ে 80 শতাংশ রোগের কারণ অবিশুদ্ধ জল পান করা । ডায়ারিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, পোলিয়োর মতো একাধিক রোগের প্রধান কারণ দূষিত জল পান । পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর পাঁচ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যু হয় ডায়ারিয়াতে ।
যকৃত এবং পেটের রোগের অন্যতম কারণ অবিশুদ্ধ জল । দেখা গেছে, বিশ্বে 68.5 কোটি মানুষ পেটের সমস্যায় ভুগছেন । যকৃতের সমস্যা রয়েছে প্রায় 32.5 কোটি মানুষের । স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, পরিচ্ছন্নতা, আবর্জনা পরিষ্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিশ্বের অনেক দেশেই সঠিক, নিয়মিত, প্রয়োজনীয় পর্যায়ে হয় না । আজকাল মানুষজন ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে অভাব বোধ করছেন ৷ ভারতের অবস্থাও একই রকম । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিকতম রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের 78.5 মিলিয়ন মানুষ পরিশুদ্ধ পানীয় জল ব্যবহার করতে পারেন না । এর মধ্যে 14.4 মিলিয়ন ভূ-গর্ভের নিচের জল ব্যবহার করেন, যা সমান হারে দূষিত । রাষ্ট্রসংঘের মতে, পরিশুদ্ধ পানীয় জল প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্য পড়ে । কিন্তু এটা বার বার দেখা গেছে সরকার বিষয়টিতে কখনই তেমন গুরুত্ব দেয়নি ।
রাষ্ট্রসংঘ মানবজীবনের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে 2010 সালে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে । 'মানব উন্নয়ন সূচক' শীর্ষক সেই রিপোর্টে জলসম্পদ-সংরক্ষণের পাশাপাশি সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা হয় । বিশ্বের 189 দেশের মধ্যে অনুসন্ধান চালানো হয় । ছোট্ট দেশ নরওয়ে এই তালিকার শীর্ষে । 189 তম দেশটি হল নাইজেরিয়া ৷ ভারতের স্থান 128 নম্বরে । প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার অবস্থা ভারতের থেকে বেশ কিছুটা ভালো ৷ স্থান 75 নম্বরে । এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং উন্নয়নের নিরিখে জল সম্পদের ব্যবহার এবং সংরক্ষণ কেমন প্রভাব বিস্তার করে ।
সম্প্রতি 2019 সালে কেন্দ্রীয় সরকার গ্রামীণ এলাকায় জরিপ চালায়, তাতে দেখা গেছে গ্রামীণ এলাকায় 18.3 শতাংশ বাড়িতে ট্যাপের জল ব্যবহার করা হয় । শহরতলিতে প্রায় 90 শতাংশ বাড়িতে পানীয় জল সরবরাহ করা হয় । রাজধানী শহর হলেও দিল্লির অবস্থা তথৈবচ । পর্যবেক্ষণের ফলে দেখা গেছে দিল্লিতে যে জল সরবরাহ করা হয়, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পানের উপযুক্ত নয় ।
কলকাতা, জয়পুর, দেরাদুন, রাঁচি এবং রায়পুরের মতো শহরে ট্যাপের জলের মান খারাপ । যদিও এই সব শহরে জল পরিশুদ্ধ করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ করা হচ্ছে । আবার হায়দরাবাদ, ভুবনেশ্বর, তিরুবনন্তপূরম, পটনা, ভোপাল, অমরাবতী, শিমলা, বেঙ্গালুরু, চণ্ডীগড়, লখনউ এবং জম্মুতে যে পানীয় জল সরবরাহ করা হয়, তার মান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুবই নিম্নমানের । দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বইয়ের অবস্থা সে দিক থেকে খানিকটা হলেও ভালো ।
দেশের 20টি রাজ্যের অধিকাংশ শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে সেখানে অধিকাংশ মানুষই নিরাপদ-স্বচ্ছ পানীয় জল পান করতে পারেন না । ভারত জল বিভাগ (2019)-এর একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে প্রতিবছর দেশের 37.3 কোটি মানুষ জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় । এর মধ্যে 10.5 লাখ শিশুর মৃত্যু হয় ডায়রিয়াতে । দেশজুড়ে বহু মানুষ জল বাহিত রোগের দ্বারা আক্রান্ত এবং নানাভাবে এর প্রভাব পড়ছে তাঁদের কাজের ক্ষেত্রেও । সরকারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে, কিন্তু তা কোনও ভাবেই প্রয়োজনীয়তাকে স্পর্শ করতে পারেনি । সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের 100টি স্মার্ট শহর এবং জেলার সদর দপ্তরে ( উত্তর-পূর্ব-সহ) জলের মান পর্যালোচনা করবে ৷ এই কাজ করা হবে 2020 সালের মধ্যে । এরপরই কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে 2024 সালের মধ্যে প্রতিটি ঘরে শুদ্ধ পানীয় জল পৌঁছে দেবে ৷
এই কাজের জন্য 3.5 লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে । উচ্চমানের পাম্পের সাহায্যে জল সরবরাহ করা হলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব হয় । যে সকল এলাকায় শুদ্ধ জল সরবরাহ হচ্ছে, সেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা দরকার । আর সব থেকে বড় কথা সবার আগে দরকার সচেতনতা ৷ এর মাধ্যমেই একমাত্র জলবাহিত রোগের হাত থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি ৷
আচার্য নন্দীপাতি সুব্বারাও ( লেখক)