মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাবারের চেয়েও বেশি প্রয়োজন জল । মানুষ জল ছাড়া বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে না । তাই সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, নাগরিকদের জন্য জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা তাদের বেঁচে থাকার অধিকারের মধ্যে পড়ে । কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রী গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত বলেছেন, "নাগরিককে জল সরবরাহ করা সরকারের দায়িত্ব ।" সম্প্রতি গজেন্দ্র সিং শেখাওয়াত হায়দরাবাদে গিয়েছিলেন । সেখানে তিনি জানান, মিশন ভগীরথ-র পাশাপাশি সরকার পানীয় জল সরবরাহের বিশেষ উদ্যোগ নিতে চলেছে । তিনি বলেন, "জল জীবন প্রকল্পের অধীনে সরকার 2024 সালের মধ্যে দেশের 14.6 কোটি পরিবারকে নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহ করার পরিকল্পনা নিয়েছে ।" এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে প্রায় 3.6 লাখ কোটি টাকা । আদতে এই প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল সংসদের গত বাজেট অধিবেশনে । তিন মাস আগে শোনা গিয়েছিল যে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘নল সে জল’ প্রকল্প শুরু করবে এবং বিভিন্ন রাজ্যের চাহিদা বুঝে ‘জল জীবন’ চালু করা হবে । পাশাপাশি শেখাওয়াত জানিয়েছে, এই প্রকল্পের খরচ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় কেন্দ্রের একার পক্ষে তা রূপায়ণ করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে রাজ্যগুলিকেও প্রকল্পের খরচ কিছুটা বহন করতে হবে । কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সংস্থাগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে, দেশের 256 জেলার 1592টি ব্লকে ‘জল শক্তি অভিযান’ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করার জন্য । যদি রাজ্যগুলি তাদের অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে এই প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ করে তবে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে পানীয় জল সরবরাহ করে তাদের তৃষ্ণা নিবারণ করা সম্ভব হবে ।
যারা মাইলের পর মাইল হেঁটে প্রতিদিন পানীয় জল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে, তাদের দুর্দশা বর্ণনা করতে কোনও শব্দই যথেষ্ট নয় । UINCEF–র সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, বিশ্বজুড়ে মহিলা ও শিশুদের প্রতিদিন বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করতে মোট 20 কোটি কর্মঘণ্টা ব্যয় করতে হয়, যা 22800 বছরের সমান । এছাড়া সরকারের তরফে লোকসভায় যে তথ্য পেশ করা হয়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে ভারতের 21 টি রাজ্যের 153টি জেলায় মানুষ যে পানীয় জল ব্যবহার করে তাতে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে । গত বছর ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশের 16টি রাজ্যে ভূগর্ভস্থ জলে বিপজ্জনক মাত্রায় ইউরেনিয়াম রয়েছে । নীতি আয়োগের রিপোর্ট বলছে, দেশের 60 কোটি লোক জল সংকটে ভুগছে । আমাদের দেশের বিভিন্ন গ্রাম ও শহরে জল সংকট যে তীব্র আকার ধারণ করতে চলেছে, তা দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের কথা মনে করিয়ে দেয় । দেশের মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে যে সরকার ব্যর্থ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । গঙ্গা সহ একাধিক নদীতে শিল্প ও কৃষির রাসায়নিক বর্জ্য ফেলার জেরে সেগুলির জল দূষিত হয়ে গিয়েছে । যদি জল সংরক্ষণকে গুরুত্ব না দেওয়া হয় তবে ভূগর্ভস্ত জলের পরিমাণ অচিরেই তলানিতে এসে ঠেকবে । এই পরিস্থিতিতে আমাদের গড়িমসি কাটিয়ে জল সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে । জানা গেছে, প্ল্যানিং কমিশনে একদা কর্মরত মিহির শাহ আগামী 6 মাসের মধ্যে জাতীয় জল নীতির এক নতুন খসড়া বিল পেশ করতে চলেছেন । আশা করা যায় যে, শাহ কমিটি যে খসড়া বিলটি পেশ করবে তাতে দেশে জল সংরক্ষণে নির্দিষ্ট দিশা থাকবে ।
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একাধিক দেশ ইতিমধ্যে ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয় যাতে তলানিতে না ঠেকে সেই জন্য জল সংরক্ষণে বিশেষ নীতি নিয়েছে । চিনের কথা এক্ষেত্রে বলতেই হয় । চিন ইতিমধ্যে দেশে সমস্ত নদীর তীরগুলিতে জলের সঠিক মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে 95 শতাংশ সফলতা অর্জন করেছে এবং দেশে জল সংরক্ষণ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য এবং জল দূষণ প্রতিরোধে 12 লাখ কর্মী নিয়োগ করেছে । কিন্তু ভারতে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি । তার ফলে স্বাধীনতার 70 বছরের মধ্যে আমাদের দেশে জলের অধিকাংশ উৎস এখন শুকিয়ে যাওয়ার মুখে । এই পরিস্থিতি এড়াতে নতুন জল নীতি অবিলম্বে বাস্তবায়িত করা প্রয়োজন । চাষি থেকে সাধারণ মানুষ প্রত্যেকের মধ্যে জল সংরক্ষণ নিয়ে বিশেষ সচেতনতা গড়ে তোলা প্রয়োজন । জল সংরক্ষণের গুরুত্ব বোঝাতে বিষয়টি স্কুলের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত করা উচিত, যাতে ছোটোবেলা থেকেই বিষয়টি সম্পর্কে সবার মধ্যে সচেতনতা গড়ে ওঠে । যদিও আগে যে জল নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল তাতে অনেক ভালো ভালো কথা বলা হলেও বাস্তবে তা জল সংরক্ষণে বিশেষ কার্যকরী ছিল না । তা ছাড়া দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একাংশে যথেষ্ট দুর্নীতি রয়েছে, তার ফলে জল দূষণ প্রতিরোধে ঠিক মতো কাজ হয়নি । দেশে জল সংরক্ষণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল, বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, জলের পরিমিত ব্যবহার এবং ব্যবহৃত জলকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা । ভারতের পাইপলাইনের জলে প্রচুর মাত্রায় ই-কোলি ব্যকটিরিয়া রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর । যদি আমরা এই সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠতে অবিলম্বে উদ্যোগ নিই একমাত্র তবেই আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে নিজেদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারব ।