ভারত একটা অভূতপূর্ব জনস্বাস্থ্য সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । কখনও কোনও স্বাস্থ্য সংকট দেশকে এভাবে পুরোপুরি থমকে দাঁড় করিয়ে দেয়নি । বেশিরভাগ ভারতীয়র কাছে লকডাউন শব্দটা অপরিচিত ছিল । সম্ভবত অনেকেই শব্দটার মানে বুঝতে পেরেছেন 22 মার্চ যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে দেশজুড়ে একদিনের লকডাউনের আহ্বান জানান ৷ এবং নিঃস্বার্থ পরিষেবা দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও সাফাইকর্মী এবং নিরাপত্তাকর্মীদের সম্মান জানাতে বলেন ।
মার্চ থেকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশ যখন কোরোনা ভাইরাস সংক্রমণের জেরে মহামারী রুখতে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখন সরকার আরও একটি সংকটের মুখোমুখি হয়েছে ৷ স্পষ্ট গাইডলাইনের অভাবে নিগমবোধ ঘাট কর্তৃপক্ষ COVID-19 সংক্রমণে 13 মার্চ মারা গেছেন এমন এক বৃদ্ধার দেহ সৎকার করতে অস্বীকার করে । ওই বৃদ্ধা যেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন, সেই RML হাসপাতালের ডাক্তারদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত সৎকার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় । যখন মৃতের পরিবার অনন্তকাল ধরে শ্মশানে অপেক্ষা করছিলেন, তখন সংবাদমাধ্যম বিষয়টি তুলে ধরায় প্রশাসন সেখানে হস্তক্ষেপ করে ।
এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । বিহারের একটি গ্রামে পরিবারের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য COVID-19 সংক্রমণের জেরে মৃত ব্যক্তির দেহ দীর্ঘক্ষণ বাড়িতে ফেলে রাখা হয়েছিল । সেই বাড়িতে অনেকে জড়ো হয়েছিলেন ৷ যার জেরে গোটা গ্রামকেই কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় ৷ কলকাতায় কোরোনা আক্রান্ত আরও একজনের মৃতদেহ নিতে পরিবারের সদস্যরা আসেননি ৷ অন্যদিকে শ্মশানের আশপাশের বাসিন্দারা সংক্রমণের ভয়ে শেষকৃত্য করতে দিতে অস্বীকার করেন । 10 ঘণ্টা পর শেষপর্যন্ত বৈদ্যুতিক চুল্লিতে ওই মৃতদেহ সৎকার করা হয় ।
COVID-19 সংক্রমণে মৃতদের সৎকার নিয়ে গাইডলাইন দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক । যেখানে মৃতদেহের ক্ষেত্রে সতর্কতা, সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ জীবাণুমুক্ত করা নিয়ে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে ৷ তা সত্ত্বেও দেশে বেশির ভাগ মৃতদেহ খোলা জায়গায় সৎকার হওয়ায় কিছুটা উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে । শহরগুলিতে বৈদ্যুতিক চুল্লি থাকলেও বিভিন্ন জেলা ও গ্রামে খোলা জায়গায় বা নদীর ধারে সৎকার করা হয়, যাতে পরিবেশে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি থেকে যায়, যদি না মৃতদেহ যথাযথ নিয়ম মেনে সৎকার করা হয় ।
COVID-19 সংক্রমণের কোনও অতিরিক্ত ঝুঁকি নেই, এই ব্যাপারে শ্মশান ও কবরস্থানের কর্মীদের আরও সংবেদনশীল করার লক্ষ্যে গাইডলাইনে বলা হয়েছে, হাত ধোওয়া, মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করার মতো সাধারণ নিয়মগুলো মানতে হবে কর্মীদের ।
বডি ব্যাগের যেদিকে মুখ আছে, সেদিকের চেন খুলে (সেটা সাবধানতা অবলম্বন করে একজন কর্মী করবেন) মৃতদেহ দেখার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে ৷ যাতে আত্মীয়রা শেষবার মৃতদেহ দেখতে পারেন । ধর্মগ্রন্থ পাঠ, পবিত্র জল ছিটানো এবং অন্যান্য পরলৌকিক কাজের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, সেক্ষেত্রে মৃতদেহ ছোঁয়ার প্রয়োজন নেই । গাইডলাইনে মৃতদেহ স্নান করানো, চুম্বন করা এবং জড়িয়ে ধরায় কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে ৷ সৎকার বা কবর দেওয়ার পর কর্মীদের এবং পরিবারের সদস্যদের ভালোভাবে হাত পরিষ্কার করতে হবে ।
গাইডলাইন অনুযায়ী, ছাই থেকে কোনও ঝুঁকি নেই এবং শেষকৃত্যের পর তা সংগ্রহ করা যেতে পারে । যদিও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে শ্মশান বা কবরখানায় বড়সড় জমায়েত এড়ানো উচিত ৷ কারণ এটা সম্ভব যে নিকট আত্মীয়দের মধ্যেও উপসর্গ থাকতে পারে এবং তাঁদের থেকেও ভাইরাস ছড়াতে পারে । স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের দাবি, একজন কোরোনা আক্রান্ত রোগীর মৃতদেহ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা কম, যদি স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবারের সদস্যরা গ্লাভস বা মাস্কের মতো সাধারণ সতর্কতা সংক্রান্ত বিধিগুলো মেনে চলেন ৷ কারণ COVID-19 সংক্রমণ প্রধানত ছড়ায় ড্রপলেট থেকে ।
এটা একটা নতুন রোগ হওয়ায়, কীভাবে একজন সন্দেহভাজন বা একজন নিশ্চিতভাবে COVID-19 আক্রান্তের দেহ সৎকার হবে, সে সম্পর্কে তথ্যের অভাবের কথা মেনে নিয়ে সরকার বলেছে, এটা নির্ধারণ করা হয়েছে মহামারী সম্পর্কে বর্তমান জ্ঞানের ভিত্তিতে ।
একটা লিক-প্রুফ প্লাস্টিকের বডি ব্যাগে দেহ রাখতে হবে । বডি ব্যাগের বাইরের অংশ 1 শতাংশ হাইপোক্লোরাইট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা যেতে পারে । মর্গে ব্যবহৃত কাপড় বা পরিবারের দেওয়া কাপড় দিয়ে বডি ব্যাগটি মুড়ে রাখা যেতে পারে ৷ এই গাইডলাইন একটা সময়োপযোগী পদক্ষেপ । যদিও সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, প্রয়োজনের সময় এই গাইডলাইন যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয় । মৃতদেহ পরিবহন এবং শববাহী গাড়ির পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা করতে হবে ৷ আর যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল কর্মীদের হতে হবে সংবেদনশীল এবং প্রশিক্ষিত । বিভিন্ন স্তরে প্রশাসনকে এইসব নিয়মের ব্যাপারে জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে । স্যানিটাইজ়ার ব্যবহার, হাত পরিষ্কার করা এবং বাড়িতে থাকা নিয়ে সরকার সংবাদমাধ্যমে যে প্রচার চালাচ্ছে, একেও তার অংশ করে তুলতে হবে ।
ভারত এখনও পর্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে । মৃত্যুর হার যতক্ষণ পর্যন্ত কম থাকবে, সৎকার ততক্ষণ পর্যন্ত বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না । কিন্তু এমন অভূতপূর্ব এবং অনিশ্চিত সময়ে কোনও কিছুকেই ধ্রুবসত্য বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয় । তাই ভারতকে এ ব্যাপারেও প্রস্তুত থাকতে হবে এবং COVID-19-এর বিরুদ্ধে প্রচারে এই বিষয়টিকেও অন্তর্ভূক্ত করতে হবে । অসতর্কতার বলি হওয়ার থেকে প্রস্তুত থাকা ভালো, আর ভারত এখনও পর্যন্ত প্রমাণ করতে পেরেছে যে তার ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা দুই-ই রয়েছে ।