দায়বদ্ধতা এবং স্বচ্ছতা যে কোনও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশাসনের দুই চোখ । কাজেই এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে দেশে ক্ষমতা, দুর্নীতির সমর্থক হয়ে উঠেছে । যার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য সেই সব রাজনৈতিক দলের, যারা ঔপনিবেশিক যুগের ‘অফিসিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্ট’কে ঢাল করে, গোপনে জনতার টাকা লুঠ করার বাঁধ খুলে দিয়েছে । যদিও সুপ্রিম কোর্ট 1986 সালে সংবিধানের 19 নম্বর ধারায় এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, এই ধারায় সমস্ত নাগরিক বাক স্বাধীনতার অধিকার পাবেন । কিন্তু সরকার পরবর্তী 19 বছরে তাকে বৈপ্লবিক আইনে পরিণত করার আগ্রহই দেখায়নি । ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির অন্ধকার কাটাতে উদ্যোগীদের দিশারী আলো হিসাবে উঠে আসা তথ্যাধিকার আইন কার্যকর করার পর 15 বছর কেটে গেল । অথচ দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে সুশাসনে স্বচ্ছতা আনার কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে কোনও রকম তদন্তের চেষ্টা হলেই শেষে গিয়ে তা হতাশায় পর্যবসিত হচ্ছে । তথ্যাধিকার আইনকে নিরাপত্তা দেওয়ার বদলে প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পরিচালিত রাজ্য সরকারগুলি, এর উদ্যমকে খর্ব করার জন্য একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালিয়েই যাচ্ছে । যদিও গত 15 বছরে 3 কোটিরও বেশি আবেদন জমা পড়েছে, যার মাধ্যমে RTI—এর সুযোগসুবিধা প্রকাশ্যে এসেছে, তবু মাত্র 3 শতাংশ মানুষ এই আইনের আওতায় তথ্য জানতে চেয়েছেন । সেন্ট্রাল এবং স্টেট লেভেল ইনফর্মেশন কমিশনে 2.2 লক্ষ মামলা ঝুলে আছে আর সেন্ট্রাল কমিশন যে সেখানে জমা পড়া অভিযোগের মীমাংসায় 2 বছর সময় নিচ্ছে, তা ইঙ্গিত করে যে, ‘ফুল-প্রুফ’ কোনও ব্যবস্থা এখনও গড়ে ওঠেনি । 29 টি ইনফর্মেশন কমিশনের মধ্যে 9টিতেই কর্মচারীর অভাব এবং কমিশনার নিয়োগে মসৃণ কাজের প্রক্রিয়া চালু রাখায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মানতে সরকারের অনীহা ৷ গোটা সিস্টেমটিকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছে । প্রতি বছর যে 40 থেকে 60 লাখ RTI আবেদন জমা পড়ছে, তার মধ্যে 55 শতাংশের ক্ষেত্রেই কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না আর 10 শতাংশেরও কম আবেদন গৃহীত হচ্ছে । এটা প্রমাণ করে যে সরকারি দপ্তরগুলি তাদের কাজ করার আদিম পন্থা থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি ।
‘রূপোর পাত্র’কে ‘মাটির হাঁড়ি’তে পরিণত করার সরকারের কূটনীতি বিস্ময়কর । আকাশকুসুম ভাবাদর্শ পেশ করে ইনফর্মেশন অ্যাক্ট কার্যকর করার কিছু বছরের মধ্যেই UPA সরকার ছবিটা বদলে দিয়েছিল ৷ ঘোষণা করা হয়েছিল যে, দলিল-দস্তাবেজের উপর কর্তৃপক্ষের মতামত এই আইনের আওতায় আসবে না । এতে তাদের দুষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থ আরও বেশি চরিতার্থ হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায় । এর ফলে ইনফর্মেশন কমিশনে ঘনিষ্ঠদের নিয়োগ করার প্রবণতা আরও বেড়ে যায় । যেদিন থেকে RTI আইন কার্যকর হয়েছে, সেখানে ইনফর্মেশন কমিশনার হিসাবে নিযুক্তদের মধ্যে অন্তত 60 শতাংশই প্রাক্তন সরকারি অফিসার । ইনফর্মেশন কমিশনের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তার মধ্যে 83 শতাংশই সরকারি চাকুরে ৷ এমনিতেই 25 শতাংশ শূন্যপদ থাকায় গোটা সিস্টেমটাই দুর্দশার কবলে আর এই ক্ষত আরও গভীরতর হয়েছে, যখন NDA সরকার গত বছরে এই আইনে আরও সংশাধনী এনেছে । ফলে গোটা সিস্টেম আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে । ইলেকশন কমিশন এবং ইনফর্মেশন কমিশনের মধ্যে যে কোনও সমতাই নেই, তা ধার্য করে ইনফর্মেশন কমিশনের সদস্যদের প্রভাব খর্বকারী সংশোধনী তৈরি করে এবং তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় এনে, তাদের নিয়োগ, কাজের মেয়াদ, বেতন, ভাতা প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করে ৷ কেন্দ্র আদপে তাদের স্বাধীনতাকেই নিয়ন্ত্রণ করেছে । বিচারবিভাগীয় ব্যবস্থা, যারা গত বছর নভেম্বরে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিল যে সুপ্রিম কোর্টসহ প্রধান বিচারপতির অফিস, RTI-এর আওতায় আসবে ৷ তবে শর্তসাপেক্ষে এই সব ক্ষেত্রে আদপে তথ্যাধিকারকেই জোরালো সমর্থন করেছে । আবার এই একই সময় দেশের প্রধান বিচারপতির মন্তব্য যে, কিছু মানুষের দোষে RTI-এ দুর্নীতির প্রবেশ ঘটেছে কারণ এটিকে ব্ল্যাকমেল করার যন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, আর এতে সকলের উপর প্রভাব পড়েছে । গণতন্ত্রের জন্য নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি । নাগরিক অধিকার হিসাবে এর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সকলেরই দায়িত্ব ।