দিল্লি: বুধবার বিদেশ সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা তাঁর দুই দিনের ঢাকা সফর শেষ করেছেন । COVID 19-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হওয়া প্রতিষেধকের প্রাথমিক স্তরের ট্রায়ালে বাংলাদেশের বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়ে এসেছেন । কিন্তু অন্তত একজন পর্যবেক্ষক মনে করছেন যে এই সফরে তিস্তার বিষয়টি আলোচনার সূচিতে ছিল । কারণ, তিস্তা নদীর জলের ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকাকে 1 বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজিং ।
ওই পর্যবেক্ষক, যিনি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে খুব আগ্রহের সঙ্গে বিশ্লেষণ করেন, তিনি নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে ETV ভারত-কে বলেছেন, ‘‘তিস্তার জলের বিষয়টি এই সফরের (শ্রিংলার সফরের) অ্যাজেন্ডার মধ্যে অবশ্যই ছিল ।’’
ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘ভারত হয়তো তাদের বলেছে যে আমরা চিন্তিত ।’’
শ্রীংলা মঙ্গলবার ঢাকায় পৌঁছান। মার্চ মাসে প্যানডেমিক সংক্রান্ত বিধিনিষেধ জারি হওয়ার পর এটাই ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ সফর ৷ বুধবার তিনি বাংলাদেশের বিদেশ সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ৷ তিনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানান যে বাংলাদেশকে COVID 19-এর ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়টি ভারত অগ্রাধিকার দেবে । এই ভ্যাকসিনের এখন তৃতীয় স্তরের ট্রায়াল চলছে ।
শ্রিংলা তাঁর এই আচমকা কিন্তু ছোট্ট সফরকে ‘দারুণ সন্তোষজনক’ বলে ব্যাখ্য করেন । আর বলেন, ‘‘যখন ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে যাবে, তখন বন্ধু, অংশীদার এবং প্রতিবেশীরা কিছু বলার আগেই তা পেয়ে যাবে । আমাদের কাছে বাংলাদেশকে সব সময় অগ্রাধিকার দেওয়া হয় ।’’
ভারতের বিদেশ সচিব এর আগে বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশনে কাজ করেছেন । তিনি জানান যে ভারত সারা বিশ্বের ভ্যাকসিনের 60 শতাংশ উৎপাদন করে । এখন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছানো গেছে যেখানে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে ।
অন্যদিকে মোমেন জানান যে তাঁদের দেশে ভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু করার জন্য বাংলাদেশ ভারতকে সাহায্য করতে প্রস্তুত ।
তিনি বলেন, ‘‘তারা (ভারত) আমাদের জানিয়েছে যে ভ্যাকসিন শুধুমাত্র ভারতের জন্য তৈরি হবে না । প্রাথমিক স্তরেও এটা বাংলাদেশে পাওয়া যাবে ।’’
এই প্যানডেমিক ছড়িয়ে পড়ার পর ভারত বাংলাদেশকে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (PPE), অন্যান্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সরঞ্জাম এবং ট্যাবলেট দিয়েছে ।
মঙ্গলবার মোমেন জানান যে বাংলাদেশ চাইছে সমস্ত রকম ভ্যাকসিনের ব্যবহার করতে । সেটা চিনের হোক, কিংবা রাশিয়ার বা আমেরিকার ।
মঙ্গলবার রাতে শ্রিংলা ঢাকা পৌঁছান । তার পর তিনি দেখা করতে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে । সেখানে তিনি এই দুই দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার বার্তা দেন । আর এই বার্তা তিনি নিয়ে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তরফ থেকে ।
বুধবার মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর শ্রিংলা হাসিনার সঙ্গে ঘণ্টাখানেক ধরে চলা বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে এনে জানান যে এই প্যানডেমিকের সময় চলাকালীনও যাতে ভারত ও বাংলাদেশের দুর্দান্ত সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই কারণেই মোদী তাঁকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন ।
তিনি বলেন, ‘‘এই কোভিডের সময় খুব বেশি যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছে না ৷ কিন্তু সম্পর্ক অবশ্যই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত । আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমনটাই মনে করেন । সেই কারণেই আমি এখানে এসেছি ।’’
‘‘আমাদের শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত । আর আমি প্রাথমিক ভাবেই সেই দিকটিতেই নজর দিতে এসেছি ।’’
ভারত হল বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহায্যকারী অংশীদার ৷ এছাড়া দুই পক্ষই জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে যোগাযোগ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলি নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছে ।
2020-21 সালে দুই দেশ মুজিব বর্ষ, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম শতবর্ষ পালন করার জন্য একাধিক কর্মসূচির পরিকল্পনা তৈরি করেছিল । এছাড়াও ভারত ও বাংলাদেশ, উভয় পক্ষ আগামী বছর তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের 50 বছর পালন করবে ।
যদিও শ্রীংলার সফরের মূল নজর ছিল COVID 19-এর ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা । লাদাখে ভারত ও চিনের মধ্যে সীমান্ত বিবাদ চলার পর বাংলাদেশে বেজিংয়ের প্রভাব বিস্তার বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে । সেই প্রেক্ষিতেও এই সফর হয়েছে বলেও এটা ব্যাপক ভাবে জল্পনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
বাংলাদেশের সরকারি চিকিৎসা গবেষণা সংস্থা এর আগে চিনের সিনোভ্যাক বায়োটেক লিমিটেডের তৈরি COVID 19 ভ্যাকসিনের তৃতীয় স্তরের ট্রায়ালে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছিল ৷ কিন্তু সেই ছাড় আপতত স্থগিত করে রাখা হয়েছে ।
তিস্তা নদীর জলের ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকাকে 1 বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেজিং । এটাই এই মুহূর্তে নয়াদিল্লির সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । এই প্রথমবার এই দক্ষিণ এশীয় দেশে নদীর জল ব্যবস্থাপনার প্রকল্পে চিন নিজেদের জড়িয়ে ফেলল ।
যদিও বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী ৷ দুই দেশ একে অপরের সঙ্গে তিস্তার জল ভাগ করে নেয় ৷ কিন্তু এই জল নিয়েই দুই দেশের মধ্যে দশকের পর দশক ধরে সমস্যা চলছে ৷
2011 সালে ঢাকা সফরে যান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ৷ সেই সফরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার জল বণ্টন চুক্তি কার্যত সাক্ষর হয়ে গিয়েছিল ৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে তা আর সাক্ষর হয়নি ৷
তিস্তা নদীর উৎস পূর্ব হিমালয়ে ৷ আর এটা ভারতের রাজ্য সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৷ যদিও এই নদী বাংলাদেশের সমতলে বন্যার অন্যতম কারণ ৷ তা সত্ত্বেও শীতকালে দুই মাস তা শুকনো থাকে ৷
বাংলাদেশের তরফে তিস্তার জলের ‘সম পরিমাণ’ বণ্টনের দাবি ভারতের কাছে করা হয়েছিল ৷ 1996 সালে সম্পাদিত গঙ্গা জল চুক্তির প্রেক্ষিতেই এই দাবি করা হয় ৷ ফরাক্কা ব্যারেজের কাছে সীমান্তে জল বণ্টন নিয়ে এই চুক্তি হয়েছিল ৷ কিন্তু তা কাজে লাগেনি ৷
আন্তঃ-সীমান্ত চুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের কোনও রাজ্য স্বকীয় ভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে ৷ সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি তুলেছিল ৷ যার ফলে বিদেশনীতি তৈরিতে সমস্যা তৈরি হয়েছিল ৷
এখন বাংলাদেশ গ্রেটার রংপুর এলাকায় তিস্তা নদী ব্যাপক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা করেছে ৷ আর তার জন্য তারা চিনের কাছে 853 মিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলার ঋণ চেয়েছে ৷ বেজিং তা দিতে রাজিও হয়েছে ৷ এই প্রকল্পের মোট খরচ 983 মিলিয়ন অ্যামেরিকান ডলার ৷ যার মাধ্যমে তিস্তার জল ধরে রাখতে একটা বড় জলাধার তৈরি করা হবে ৷
ওই পর্যবেক্ষক বলেন, ‘‘যদি ভারত মনে করে যে এর ফলে (চিনের টাকায় তৈরি হওয়া তিস্তা জল প্রকল্প) আমাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে চলেছে, তাহলে নয়াদিল্লিকে পাল্টা পদক্ষেপ করার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে হবে ৷’’
চিন এছাড়াও ভারতের পূর্বদিকে থাকা এই প্রতিবেশী দেশে প্রতিরক্ষা প্রকল্প নিয়েও গতি বৃদ্ধি করেছে ৷ এর মধ্যেই রয়েছে কক্সবাজারের পেকুয়ায় BNS শেখ হাসিনা সাবমেরিন বেস তৈরি করার প্রকল্পও ৷ এই প্রকল্পের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ নৌ বাহিনীকে দুইটি সাবমেরিন দেবে ৷
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চিনের প্রসিডেন্টের মস্তিষ্কপ্রসূত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ (BRI) প্রকল্প গ্রহণ করে নিয়েছেন ৷ এটাও নয়াদিল্লির জন্য আরও একটা উদ্বেগের বিষয় ৷ এটা চিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ৷ ভারত এই BRI প্রকল্পের অংশীদার হতে অস্বীকার করেছে ৷ কারণ, চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর পাকিস্তানের অধীকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে গিয়েছে ৷
ভারত যদিও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে বাংলাদেশের সঙ্গে ৷ তার পরও ঢাকা বঙ্গোপসাগরে নৌ ব্যবস্থা সংক্রান্ত কর্মসূচিতে চিনকে সাহায্য করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে ৷
যে ব্যক্তি ETV ভারত-এর সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি বলেন, ‘‘আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে বাংলাদেশের উপর চিনের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে এবং ঢাকা এখন চিন তাস খেলতে শুরু করেছে ৷’’