সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন মাত্র কিছু দিন আগেই । তেমন ভাবে মুখ খোলার সুযোগ-সময় পাননি নতুন সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নারাভানে । সুযোগটা পেলেন সেনাদিবসে । সেনা ধান হিসেবে প্রথমবার সাংবাদিক সম্মেলন করে বুঝিয়ে দিলেন সংবিধান মেনে চলাই সেনাবাহিনীর প্রথম-প্রধান কাজ । নতুন সেনাপ্রধানের কথায়, ‘‘দেশের সংবিধানই সব সময়ে সেনাবাহিনীর পথপ্রদর্শক । সংবিধানের প্রস্তাবনায় বর্ণিত আদর্শের প্রতি আনুগত্য রেখে চলারই শপথ নেন সেনার অফিসার বা জওয়ানেরা ।’’ তিনি আরও বললেন, "সংবিধানে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার কথা বলা আছে । বলা হয়েছে, সকলের সমান অধিকারের কথাও।" সেনাপ্রধান বুঝিয়ে দিলেন, আগামী দিনে এই বিষয়গুলির দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চলেছেন তিনি ।
সেনা দিবসের আগে প্রতি বছরেই সেনাপ্রধান নিয়ম মাফিক সাংবাদিক বৈঠক করেন । সেই বৈঠকেই নতুন সেনাপ্রধান বলেন, ‘‘সংবিধানের প্রস্তাবনার সার কথা- ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ । তা রক্ষা করতেই সেনাবাহিনী লড়ছে । সীমান্তে মোতায়েন বাহিনীর প্রধান কাজ হল, দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সংবিধানের মূল্যবোধকে রক্ষা করা । আমাদের সব সময়ে এ কথা মনে রাখতে হবে ।’’
গোটা দেশে যখন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও NRC-র বিরুদ্ধে সংবিধানকে হাতিয়ার করেই প্রতিবাদ হচ্ছে, ঠিক সে সময় সেনাপ্রধানের মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ । জেনেরাল নারাভানের পূর্বসূরি, প্রাক্তন সেনাপ্রধান তথা বর্তমান চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ জেনেরেল বিপিন রাওয়াত NRC-বিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমরা দেখছি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা বহু মানুষের ভিড়কে নেতৃত্ব দিয়ে শহরে অগ্নিসংযোগ ও হিংসা ছড়াচ্ছে । এটা কখনওই নেতৃত্ব হতে পারে না । যারা মানুষকে ভুল পথে চালিত করে, তারা কখনওই নেতা নয় ।’’ এর পরেই সেনাপ্রধান বলেন, ‘‘এক জন নেতা হলেন তিনি, যিনি আপনাকে ঠিক অভিমুখে চালনা করবেন, আপনাকে ঠিক পরামর্শ দেবেন এবং আপনার আশপাশের মানুষদের খেয়াল রাখবেন ।’’ সেই মন্তব্যের পরই শুরু হয় রাজনৈতিক তরজা । নতুন সেনাপ্রধান সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের কথা বলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অরাজনৈতিক চরিত্রের কথা যেভাবে মনে করিয়ে দিলেন, তা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ।
আরও একটি বিষয়ে আজ পূর্বসূরির সঙ্গে পার্থক্য বজায় রেখেছেন জেনেরাল নারাভানে । মোদি জমানায় এমনিতেই সার্জিকাল স্ট্রাইক, বালাকোট হানার মতো সেনার কৃতিত্বের রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল । তারপরে প্রাক্তন সেনাপ্রধান BJP সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের সুরে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখলের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন । জেনেরাল নারাভানে এ বিষয়ে প্রশ্নের মাপা জবাব দিয়ে বলেন, ‘‘বহু বছর আগেই সংসদে প্রস্তাব এসেছিল যে গোটা জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অংশ । যদি সংসদ চায় পাক-অধিকৃত কাশ্মীরও আমাদের দখলে আসুক, তা হলে অবশ্যই আমরা পদক্ষেপ করব ।’’ কিন্তু সেনা কোনও প্রচার চায় না বলেও তিনি স্পষ্ট করেন । সেনাপ্রধান শুধু একবার নন, একাধিক বার সংবিধানের প্রসঙ্গ টেনেছেন । তিনি বলেন, ‘‘নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করতে পারলে আমাদের কাজে ভুল হবে না ।’’
সন্দেহ নেই, সেনাপ্রধান যেভাবে রাজনীতি থেকে সেনাকে দূরে থাকার কথা বলেছেন, এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ । রাজনীতি থেকে সেনাকে মুক্ত করে পেশাদারিত্বে জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি । পেশাদার সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার দিকে সব থেকে বেশি মন দেবে । আর এটাই দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ।
সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার আরও একটি তাৎপর্য রয়েছে । শুধু সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখা নয়, রাজনীতিকেও সেনাবাহিনীর থেকে মুক্ত রাখতে হবে । জাতীয় স্বার্থে সব রাজনৈতিক নেতাদের উচিত সেনাবাহিনীকে তাদের রাজনৈতিক আলোচনা থেকে দূরে রাখা । কিছু দিন আগে কংগ্রেস নেতা অধীররঞ্জন চৌধুরি সেনাপ্রধানকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, "কথা কম বলুন, কাজটা বেশি করুন ।" এই মন্তব্য পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় । স্যামুয়েল হান্টিংটন তাঁর 'সোলজ়ার অ্যান্ড দা স্টেট' নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন, যদি সাধারণ মানুষ সেনাবাহিনীকে তাদের কাজ ঠিক মতো পালন করতে দেন, তাহলে তা শুধু দেশের প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে ।
রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া সেনাবাহিনীর সাংবিধানিক কর্তব্য । এটাই তাদের প্রথম-প্রধান দায়িত্ব, অনেকে মনে করেন সামরিকের উপর বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ থাকলে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা স্পষ্ট হয় ।
প্রায় প্রতি দিনই নিহত হচ্ছেন । এটা শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ রেখায় যুদ্ধ করতে গিয়ে নয়, কারগিল বা সিয়াচেনের মতো এলাকায় প্রকৃতিক সঙ্গে লড়াই করতে গিয়েও বহু জওয়ান প্রাণ হারান । দেশের সুরক্ষার জন্য বহু জওয়ান অত্যন্ত প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশে দিনের পর দিন কাটান । তাঁরা নিজের জীবন বিপন্ন করে তাঁরা দেশের সেবা করে চলেছেন ।
এই দিক থেকে সেনাপ্রধানের মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । এতে কোনও সন্দেহ নেই, বর্তমান সেনাপ্রধানের মন্তব্য তাঁর পূর্বতনকে অস্বস্তিতে ফেলবে । আমরা আশা করতে পারি, বর্তমান সেনাপ্রধানের মন্তব্য সেনাবাহিনীকে তাদের কাজের ক্ষেত্রে বাড়তি অক্সিজেন জোগাবে । ভারতীয় সেনা দেশের সব কটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সব থেকে উৎকৃষ্টমানের, একে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য । এটা দরকার আমাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য, দেশের জন্য, আমাদের নিরাপত্তার জন্য ।