জাতীয় পুরস্কার জয়ী অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াতকে দমাতে শিবসেনার কর্কশ প্রয়াস এবং তাঁর সম্পত্তি নষ্ট করার নিন্দা করা উচিত সেই সমস্ত মানুষের, যাঁরা দেশের আইনের শাসন আর গণতন্ত্রকে মান্যতা দেন । এটাই সময় যখন শিবসেনাকে বলতে হবে যে তারা মুম্বইয়ের মালিক নয়, এবং কোনও ভারতীয় তাঁদের শহরে প্রবেশ করার ভিসা দেওয়ার অনুমোদন দেবে না । মুম্বই গোটা ভারতের ।
বিধিভঙ্গের অভিযোগ এনে মাত্র একদিনের নোটিসে অভিনেত্রীর পালি হলের সম্পত্তি ধ্বংস করার আগে দলের নেতা ও গুণ্ডারা বারবার ভয় দেখায় । হিমাচল প্রদেশ থেকে কঙ্গনার মুম্বইয়ের বাড়িতে ফেরার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় । এ ধরণের হুমকি যারা দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও রয়েছেন । এছাড়াও দলের নেতারা অভিনেত্রীকে কুৎসিত কটূক্তিও করেন। যদি ভারতকে এসব সহ্য করতে হয়, তাহলে দেশ গণতন্ত্রকে বিদায় জানাবে এবং গুণ্ডারাজের দরজা খুলে দেবে।
হিমাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুর সঠিকভাবেই কঙ্গনার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং বলেছেন যে মহারাষ্ট্র সরকারের কাজকর্ম ‘নিন্দনীয়’ এবং প্রতিশোধের রাজনীতিতে পরিপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘হিমাচলের মেয়ের’ এই অসম্মান বরদাস্ত করা যায় না।
শিবসেনা যখন অভিনেত্রীকে চোখ রাঙাতে সরকারের প্রতাপ আর দলের গুণ্ডাদের কাজে লাগাল, তখন হিমাচল প্রদেশ সরকার বাধ্য হয়ে কেন্দ্রের কাছে কঙ্গনার ওয়াই প্লাস নিরাপত্তার আবেদন করল, যখন ৯ সেপ্টেম্বর তিনি মুম্বইয়ে ফিরলেন ।
এতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর সতর্ক হওয়া উচিত ভবিষ্যতে কী রয়েছে ভেবে, কারণ অন্য রাজ্যের নাগরিকদের সঙ্গে শিব সেনাদের আচরণ কেউ সহ্য করবে না ।
বম্বে হাইকোর্ট যথার্থভাবেই BMC-এর কঠোর সমালোচনা করেছে এবং সম্পত্তি ধ্বংস করাকে ‘নিন্দনীয়’ আখ্যা দিয়েছে । আদালত বলেছে যে পৌরসভার পদক্ষেপ ‘অসৎ উদ্দেশ্য পূর্ণ’। আদালত উল্লেখ করে, যাকে পৌরসভা অবৈধ নির্মাণ বলছে, তা রাতারাতি গজিয়ে ওঠেনি । যদিও পৌরসভা হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে উঠল কঙ্গনা যখন শহরের বাইরে, তখন তাঁকে নোটিস দিল এবং মাত্র 24 ঘণ্টা সময় দিয়ে নির্মাণ ভাঙার কাজ শুরু করল । এসব কিছু থেকেই ইঙ্গিত মিলছে যে পৌরসভার পদক্ষেপ অসৎ উদ্দেশ্যে । আদালত আরও বলে যে পৌরসভার আইনজীবী সময়ে পৌঁছননি এবং আদালত যখন টানা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল, তখন পৌর কমিশনারের ফোন সুইচড অফ ছিল । এর মধ্যেই ভাঙার কাজ চলতে থাকে । এছাড়াও আদালত বলেছে যে অজস্র আরও অবৈধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও পৌরসভা ‘একইরকম দ্রুততা’র সঙ্গে কাজ করবে কি না।
9 সেপ্টেম্বরের নির্দেশে, কীভাবে পৌরসভা শুনানি পিছিয়ে দিতে এবং ভাঙার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কঙ্গনার আবেদন না গ্রহণ করতে চেষ্টা করে গিয়েছে, আদালত তা বিশদে নথিবদ্ধ করে রেখেছে । এটা সরকারের ঔদ্ধত্য এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি অসম্মানের ইঙ্গিত ।
শিবসেনাকে বলতে হবে যে, তারা মুম্বইয়ের মালিক নয় । তারা দীর্ঘ সময় এই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই রয়েছে । সত্যি বলতে, যে সময় আলাদা মারাঠি ভাষী রাজ্যের জন্য আন্দোলন ক্রমশ সংগঠিত হচ্ছিল, তখন গুজরাতি ও অন্যান্যদেরও বম্বেতে (তখন যে নামে ডাকা হত) ততটাই অধিকার ছিল। তখন থেকে মারাঠি ভাষী মানুষ বম্বেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পক্ষে জোরালো সওয়াল করে । তখন থেকে এই শহরের জন বিন্যাসে একটা কসমোপোলিটান ধাঁচ রয়ে গিয়েছে । আর শিবসেনা যতই মুম্বইয়ের শরীরে বিষ ঢালার চেষ্টা করুক, এই শহর তার আন্তর্জাতিক ছোঁয়া হারাতে রাজি নয়।
যখন একটা আলাদা মারাঠিভাষী রাজ্য তৈরি হয়, তখন কসমোপলিটান চেহারা ও স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের জন্য বম্বেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পক্ষে জোরালো সওয়াল ছিল । 1948 সালে গুজরাত রিসার্চ সোসাইটির সভাপতি ভাষাভিত্তিক অঞ্চল কমিশনের কাছে একটি স্মারকলিপি জমা দেয়, যার বিষয় ছিল ‘মহা গুজরাতের ভাষাভিত্তিক সীমা’ । এখানে বলা হয়, যে মারাঠি ভাষী রাজ্য বাস্তবায়িত হলেও, বম্বেকে কেন্দ্রীয়ভাবে শাসন করা উচিত । ভাষাভিত্তিক রাজ্যের দাবি খতিয়ে দেখতে এই কমিশন নিয়োগ করেছিল ভারতের সংবিধান সভা । স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, “বম্বে শহর, তার বন্দর ও শহরতলী নিয়ে একটি আলাদা স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চল তৈরি করা উচিত কেন্দ্রের অধীনে । বম্বে একটি সর্বভারতীয় শহর, যার একটা আন্তর্জাতিক চেহারা রয়েছে । এর সংস্কৃতি গভীরভাবে অ-প্রাদেশিক, যেখানে ভারতের প্রতিটি প্রদেশের মানুষ, এমনকী বিদেশিরাও তাঁদের ভূমিকা পালন করেন । যেখানে একটি প্রাদেশিক ভাষার সংকীর্ণ ভিত্তিতে একটি প্রদেশ তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে বম্বের মতো একটি আন্তর্জাতিক বন্দরকে অন্তর্ভূক্ত করা অন্যায় হবেব।” এই আবেগের এখনও ভিত্তি রয়েছে। মুম্বই শিবসেনার সংকীর্ণ, কর্কশ রাজনীতিবিদদের নয়।
শিবসেনা দেখাতে চাইছে যে কঙ্গনা রানাওয়াত এমন একজন মহিলা যিনি মুম্বই, মহারাষ্ট্র ও মারাঠি মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন । এটা একেবারে ভিত্তিহীন । অভিনেত্রী এঁদের কাউকেই আক্রমণ করেননি । তাঁর আক্রমণ ছিল শিবসেনার উপর, যেভাবে এই দল গুণ্ডারাজে উৎসাহ দিচ্ছে এবং ভারতের সবথেকে মুক্ত মনোভাবাপন্ন এবং বিকাশশীল শহর মুম্বইকে ঘৃণার দুর্গে পরিণত করছে । ভারতের জনগণ কখনও শিব সেনাকে মুম্বইয়ের চাবি দেবে না । সেনা ছত্রপতি শিবাজির ঐতিহ্যের একচ্ছত্র উত্তরাধিকারীও নয় । বিশ্বজুড়ে ভারতীয়রা ছত্রপতি শিবাজিকে দেশের অন্যতম মহান রাজা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আইকন মনে করে । বহু শতক আগে তাঁর শৌর্য এবং ভারতীয় সভ্যতার মূল্যবোধগুলো রক্ষা করার জন্য তাঁর অমূল্য অবদানের জন্য ভারতীয়রা তাঁকে শ্রদ্ধা করেন । তাঁর মূল্যায়ন এবং তাঁকে মারাঠি গর্বের প্রতীকের স্তরে নামিয়ে আনতে শিবসেনার চেষ্টার প্রতিরোধ করতে হবে।
এছাড়াও শিবসেনা নেতারা বলছেন যে অভিনেতা, পরিচালক ও চলচ্চিত্র-টেলিভিশনের পেশাদারদের মুম্বই কী কী দিয়েছে । তাঁরা মনে হয়ে ভুলে যাচ্ছেন যে, এই ব্যক্তিত্বরা মুম্বইকে কী কী দিয়েছেন । বম্বে ওরফে মুম্বই এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে, কারণ শিল্প, বাণিজ্য, উৎপাদন, বিনোদন ও আতিথেয়তা শিল্পের সেরা প্রতিভারা এই শহরে এসেছেন, একে তাঁদের বাসভূমি করে নিয়েছেন, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এবং লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করেছেন । গুজরাট, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বিহার, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, জম্মু-কাশ্মীর, কেরালার মতো বিভিন্ন রাজ্য থেকে মানুষ তাঁদের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে এই শহরে পৌঁছেছেন এবং একে আজকের রূপ দিয়েছেন । উদাহরণ, যদি আপনি গুজরাতিদের সরিয়ে নেন, তাহলে মুম্বইয়ের শিল্প ও বাণিজ্যের ছবিটা কেমন দাঁড়াবে? অথবা, পাঞ্জাবিদের বাদ দিয়ে বলিউড কেমন হবে? শিব সৈনিকদের ড্রয়িং বোর্ডে ফিরে যাওয়া উচিত। তারা যদি তাদের সস্তা রাজনীতি চালিয়ে যায়, তারা গোটা দেশকে শত্রু তৈরি করবে ।
এটা দুঃখজনক, যে শিবসেনা বালাসাহেব ঠাকরের মতো জ্বলন্ত ব্যক্তিত্বের জীবদ্দশায় ভারতের জাতীয় আবেগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তারাই এখন ব্যঙ্গচিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ‘সনিয়া সেনা’-য় পর্যবসিত হয়েছে। যদি তারা সংযত হতে না পারে, তাহলে আরও বহু রাজ্য ও মুখ্যমন্ত্রীরা সুর চড়াবে । ভারতমাতা তাঁর মুকুটের রত্ন মুম্বইকে অযোগ্য হাতে পড়তে দেবেন না ।