COVID-19 যে গতিতে প্রভাব ফেলে সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে এবং অর্থনীতির গতিপথ বদল করে দিয়েছে, তাতে এর প্রভাব আগামী বহু বছর ধরে ভুগতে হবে ৷ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট (2008)-এর প্রভাব পৃথিবী কাটিয়ে যখন উঠছিল, তখনই আরও বড় এই সংকট এসে হাজির হল ৷ ভারত এই সংকট থেকে মুক্ত নয় । এর উলটো দিকে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির বিশাল রাজস্ব এবং আর্থিক ঘাটতির কারণে ভারতীয় অর্থনীতি তার দুর্বলতম অবস্থানে ছিল ৷ বেসরকারি বিনিয়োগ ও সঞ্চয় হ্রাস পেয়েছে, রপ্তানি কমে গেছে, ঋণগ্রস্ত অবস্থা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে ৷ ব্যাঙ্কিং সংকট টাকাকে সর্বকালীন নিচে নামিয়ে দিয়েছে ৷ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় রেকর্ড পরিমাণ হলে, তা ভালো হয় ৷ এটা একটা মিথ্যা আত্মতুষ্টির জায়গা ৷ অন্যান্য আরও অনেক দেশের মতো এক্ষেত্রেও এটা সরকারের নিজস্ব উদ্বৃত্ত নয় ৷ এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যার ৷
উজ্জ্বল স্থান
গ্রামীণ অর্থনীতির সম্ভাবনা উজ্জ্বল ৷ আর এটাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা উচিত ৷ অর্থনৈতিক সংকটের এই কালো মেঘের মধ্যে এটাই এখন রূপোলী রেখা ৷ সার্বিক অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক দিক এখনও রয়েছে ৷ গ্রামীণ চাহিদা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ লকডাউন থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুতের চাহিদা কোরোনা পূর্ববর্তী সময়ের মতো অবস্থায় পৌঁছে গেছে ৷ পেট্রোলিয়াম পণ্যের চাহিদা মে মাস থেকে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে ৷ সড়ক পথে গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ দুই চাকার গাড়ির বিক্রির যতটা আশা করা হয়েছিল, তার থেকেও বেশি বিক্রি হতে শুরু করেছে ৷ গত বছরের তুলনায় এই বছর ট্রাক্টরের বিক্রি ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ ঘটনা হল গ্রামীণ অঞ্চলে ঋণের পরিমাণ কম ৷ এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্কগুলি ইচ্ছুক থাকলে, গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষদের কাছে ঋণ নেওয়ার সুযোগ থাকছে ৷ গ্রামীণ চাহিদা যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে যতটা আশা করা হয়েছিল, তার থেকে দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতির পুনরুদ্ধারে ভারতকে সহায়তা করবে ৷
গ্রামীণ চাহিদা নির্ভর করে কৃষি, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া, ঋণ এবং সরকারি সহায়তার উপর ৷ গত বছরের তুলনায় এই বছর ট্রাক্টরের বিক্রি বেশি হয়েছে ৷ এই বিষয়টি গ্রামীণ অর্থনীতির বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে ৷ যা খরচের যোগান দেবে এবং অর্থনীতির এই কঠিন সন্ধিক্ষণে সাহায্য করবে ৷ খরিফ শস্যের চাষ গত বছর ৪ কোটি হেক্টর জমিতে হয়েছিল ৷ এবার তা বেড়ে হয়েছে ৫.৮ কোটি হেক্টর জমি ৷ যা শুরুতেই আশা জাগিয়েছে ৷ তাছাড়া বছর ধান (২৬ শতাংশ), ডাল (১৬০ শতাংশ), খাদ্যশস্য (২৯ শতাংশ), তৈল বীজ (৮৫ শতাংশ) ও তুলোর (৩৫ শতাংশ) চাষ বৃদ্ধিও ভালো লক্ষণ ৷ যদি কোনওরকম পঙ্গপালের হানা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে এই গতি বজায় থাকে, তাহলে এবার অসাধারণ ফসল উৎপন্ন হবে ৷ এর মানে হল গ্রামীণ অঞ্চলে চাষের কাজে আরও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং রোজগারের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে ৷ এটা মাথায় রাখতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সবচেয়ে বেশি ফসল উৎপাদনকারী দেশেও গত বছরের তুলনায় কম উৎপাদন হচ্ছে ৷ ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কৃষিজ পণ্যের দাম খুবই সাহায্য করবে ৷ কৃষিকাজে যে কোনও ধরনের উন্নতিকেই স্বাগত জানাতে হবে ৷ কারণ, শহরাঞ্চলে কাজ করতে যাওয়া এবং অর্থের যোগান একেবারে ভেঙে পড়েছে ৷
আর্থিক বছরের শেষ তিনমাসের জন্য অপেক্ষা না করে এখনই খরচ করা উচিত, সরকারের এই সিদ্ধান্ত গ্রামীণ অর্থনীতির উপর থেকে চাপ কমাতে সাহায্য করেছে ৷ সরকারি তথ্য বলছে যে কৃষি ও গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক এখনও পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে ৷ যেখানে গত বছর খরচ করা হয়েছিল ৪৪ হাজার কোটি টাকা ৷ গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রক বেশিরভাগ টাকাটাই (প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা) NREGS প্রকল্পের মাধ্যমে খরচ করেছে ৷ এছাড়া ঘোষণা হওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ রোজগার যোজনায় খরচ হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা ৷ চলতি আর্থিক বছরের প্রথম ১০০ দিনে সরকার তার বাজেট বরাদ্দের ৯৫ শতাংশ খরচ করে ফেলেছে ৷ ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এখনও পর্যন্ত ১৩০ জনের কাজের দিন সুনিশ্চিত করা গিয়েছে NREGS প্রকল্পের মাধ্যমে ৷ এর ফলে ছয় রাজ্যের ৮০ কোটি মানুষের কাজ সুনিশ্চিত হয়েছে ৷ তার সঙ্গে ৪.৮৭ কোটি পরিবার উপকৃত হয়েছে ৷ এই আর্থিক বছরে ১০০ দিনের মধ্যে মোট যতদিনের কাজ তৈরি হয়েছে, তা গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ ৷ সবচেয়ে বেশি সক্রিয় NREGS শ্রমিকের সংখ্যার নিরিখে AP হল সবচেয়ে উপরে ৷ TN এর থেকেও এগিয়ে৷ চার রাজ্যের সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা ১ কোটি ৷
সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা
এর মানে এই নয় যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে ৷ এর মানে শুধুমাত্র ভালো শুরু হয়েছে ৷ তবে এটাই যে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর দীর্ঘমেয়াদী ফল, তা বলা এখনই খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ৷ কোরোনা থেকে মুক্তি পাওয়ার রাস্তা কত তাড়াতাড়ি পাওয়া যাচ্ছে, তার উপর নির্ভর করছে স্বাভাবিক পরিস্থিতি কত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে ৷ এখানে অনেক বিষয় রয়েছে, যা নিয়ে সরকারের সতর্ক হওয়া উচিত ৷ ব্যাঙ্কগুলি ঋণ দিতে চাইছে না ৷ তাদের নতুন ঋণের বেশির ভাগটাই ‘চির সবুজ’ ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ যদিও নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে ৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি হল পুরনো ঋণ শোধ হলেই নতুন ঋণ দেওয়া হচ্ছে ৷ অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে গেলে নতুন ঋণ শুধু খাতায় কলমেই দেওয়া হচ্ছে ৷ যাঁদের ঋণের প্রয়োজন, তাঁদের হাতে টাকা খুবই কম পৌঁছচ্ছে ৷ যে সমস্ত ঋণে জামানত রাখা হচ্ছে, সেই সমস্ত ঋণগুলিই একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়াচ্ছে ৷ ঘটনা হল ব্যাঙ্ক যেহেতু ঋণ দিতে আগ্রহী নয়, তাই স্বর্ণঋণ সংস্থাগুলি থেকে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ৷ মধ্য ও নিম্নবিত্ত যে চাপে রয়েছে, এর থেকেই তার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ৷ যতক্ষণ না সময়মতো ঋণ দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ কৃষিক্ষেত্র দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা যাবে না ৷
সরকারি খরচের উপর ভিত্তি করে কোনও চাহিদা তৈরি হওয়া আসলে স্বল্পমেয়াদী, হঠাৎ প্রয়োজনে নেওয়া ব্যবস্থার ফল ৷ সরকারের সেই সম্পদ নেই, যেখানে অস্থায়ী ব্যবস্থায় প্রচুর পরিমাণে অর্থ খরচ করবে ৷ যে পরিমাণ আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে NREGS তাকে পুনরুদ্ধার করতে পারবে না ৷ আমাদের যেটা প্রয়োজন, তা হল বিনিয়োগ ৷ যা দীর্ঘমেয়াদী কর্মসংস্থান তৈরি করবে ৷ যতক্ষণ এটা হচ্ছে, ততক্ষণ ভারতের জনসংখ্যার মধ্যে সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা থেকেই যাবে ৷
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেখানে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, তা হল সরকার (রাজ্য ও কেন্দ্র) কিছু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে অতিরিক্ত কর নেয় ৷ যেখানে মানুষের কাছে করের উৎস খুবই কম ৷ এই পথে অবশ্যই চাহিদা কমে যায় ৷ যেহেতু প্রতিটি পরিবারে খরচের বিষয়টি এখন ক্রমশ চাপের মুখে পড়ছে, তাই GST এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য সহ অনেক ক্ষেত্রে কর কমিয়ে দেওয়াই সেরা উপায় ৷ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা হল পিছিয়ে পড়া ও গ্রামীণ এলাকায় বিনিয়োগে ১০ বছরের জন্য কর ছাড় দেওয়া ৷ এটা দীর্ঘমেয়াদী গ্রামীণ কর্মসংস্থান তৈরিতে কার্যকরী ভূমিকা নেবে ৷