ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বিউরোর (NCRB) সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী , ভারতীয় নাগরিকদের জীবনরক্ষার সাংবিধানিক গ্যারান্টি নিজেই সড়কপথগুলিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে । এই ঘটনা রীতিমতো হৃদয়বিদারক যে দেশে গত বছরে 4.37 লাখের বেশি পথ দুর্ঘটনায় অন্তত 1.55 লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল । গতিবৃদ্ধি , বেপরোয়া গাড়ি চালানোর ঝুঁকির বিরুদ্ধে এবং পথ নিরাপত্তার একাধিক স্লোগান যেমন ‘পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে স্বর্গে তাড়াতাড়ি যাওয়ার আগে পৃথিবীতে গাড়ি ধীরে চালিয়ে, দেরি করে পৌঁছানো ভালো ’, ‘ গতি চমক দেয় কিন্তু মেরেও ফেলে ’, ‘দ্রুত গাড়ি চালানো , শেষ গাড়ি চালানোও হতে পারে’ প্রভৃতি প্রচার করা সত্ত্বেও NCRB রিপোর্টে , অন্তত 60 শতাংশ পথ দুর্ঘটনা এবং রাস্তাতেই 86 ,241 জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর জন্য দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানোকেই দায়ি করা হয়েছে । বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোয় অন্তত 25.7 শতাংশ পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং তাতে মৃত্যু হয়েছে 42 হাজার 557 জনের । সব মিলিয়ে দ্রুতগতিতে এবং বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর বিপজ্জনক কারণে 85 শতাংশেরও বেশি পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং এর পরে হাজার হাজার পরিবারে শোক এবং দুরবস্থা নেমে এসেছে ।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়করি দুঃখ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, পথ দুর্ঘটনায় অন্তত 65 শতাংশ ক্ষেত্রেই শিকার হয় 18-35 বছরের কোঠায় থাকা মানুষ ৷ আর এই ভয়াবহ পথ দুর্ঘটনাগুলির জন্যই ভারত তার GDP-র 3 থেকে 5 শতাংশ হারিয়ে ফেলছে। গড়করি এর আগে ঘোষণা করেছিলেন যে , তাঁর সরকার 2018 সালের মধ্যে অন্তঃদেশীয় পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা অর্ধেক করতে বহুস্তরীয় উদ্যোগ নেবে । সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতার কথা তাঁর মন্ত্রক গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্টকহোম সম্মেলনে স্বীকার করে নিয়েছে । কেন্দ্রের আনা নয়া মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট এখনও বাস্তবায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে কঠিন বাধার মুখে পড়ছে। সব ধরনের পথ দুর্ঘটনার দায় গতি এবং অবহেলায় গাড়ি চালানোর উপর চাপানোর সংকীর্ণ মানসিকতা মূল সমস্যার আসল কারণগুলিকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে এবং রাস্তাগুলিকে রক্তাক্ত করার হার বাড়িয়ে তুলছে। প্রতি বছর লাখ লাখ পরিবার তাদের অন্নদাতা সদস্যটিকে হারিয়ে ফেলছে এবং রাতারাতি তীব্র দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে রীতিমতো রাস্তায় এসে পড়েছে । আর কতদিন এই রকম অবর্ণনীয় অবস্থা চলবে আর এই সব নিরীহ মানুষদের এই পরিণতির জন্য কারা দায়ি থাকবেন উত্তর দিতে ?
পাঁচ বছর আগে , কেন্দ্রীয় সচিবরা ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা পথ দুর্ঘটনার হার নিয়ন্ত্রণ করবেন ডিজাইন স্তরে পথ নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে, উৎপাদন স্তরে বিপজ্জনক রাস্তা সারিয়ে , যানবাহনের নিরাপদ ও স্থায়ী চলাচল সুনিশ্চিত করে , চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে , আইন-কানুন কঠোরভাবে পর্যালোচনা এবং জারি করে। ছ’মাস আগে গড়করি বলেছিলেন যে , জার্মানি, অ্যামেরিকার মতো দেশে যদিও যানবাহন ভারতের থেকে দ্রুতগগিতে চলে, সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম । তিনি বলেছিলেন যে, এই কথা বলা ঠিক হবে না যে দ্রুতগতিই পথ দুর্ঘটনার একমাত্র কারণ । তাঁর নজরে যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিংগত গলদ , বিশদ প্রোজেক্ট রিপোর্টে ত্রুটি , রাস্তায় পর্যাপ্ত ইন্ডিকেটরের ঘাটতি প্রভৃতিই হল ক্রমবর্ধমান পথ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ ৷তাহলে কেন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনও সংশোধনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ?
চার বছর আগে ঘোষণা করা হয়েছিল যে জাতীয় সড়কে 786 টি স্থানকে সবচেয়ে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তাদের দু’বছরের মধ্যে 11,000 কোটি টাকা দিয়ে সারানো হবে ! গড়করির সাম্প্রতিকতম ঘোষণা অনুযায়ী, বর্তমানে এই সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্ল্যাক স্পটের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে 3000 । বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টে বলা হয়েছে ভারতের উচিত পথ নিরাপত্তায় অতিরিক্ত 10 হাজার 900 কোটি ডলার (আনুমানিক 8,17,000 কোটি) ব্যয় করতে , যাতে আগামী 10 বছরে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে আসে । এর ফলে আর্থিক লাভ প্রতি বছরে অন্তত 3.7 শতাংশ GDP হবে যদি সরকার এই বিপুল পরিমাণ খরচ করতে রাজি হয় ৷ এমন রিপোর্ট সত্ত্বেও যদি সরকার ব্যবস্থা না নেয় , তাহলে বর্তমানে কোরোনা সংকট থেকে বেরোনোর রাস্তা কীভাবে বের করবে ? যদি অটোমোটিভ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত যাঁরা , যাঁরা ক্রেতাদের ভেহিকল পিক আপ পাঁচ সেকেন্ডে 100 কিলোমিটার হয়ে যাওয়ার মতো লোভনীয় প্রতিশ্রুতি দিয়ে মন কাড়ে , তাঁরা যদি বাস্তব বোঝেন এবং ধৈর্য্য ধরে দেশের রাস্তার বর্তমান পরিস্থিতি বুঝে , তদনুরূপ ব্যবস্থা নেন , তাহলে পথ নিরাপত্তার হাল কিছুটা হলেও শুধরাবে ।