হায়দরাবাদ, 21 অগাস্ট : পরস্পরের প্রতি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত ছেলে মেয়ে দুটি, কৈশোরের প্রেম ৷ বিয়েও করেছিল তারা অনেক বাধা পেরিয়ে ৷ অম্রুতা বর্ষিনী (21), প্রণয় পেরুমুল্লা (23) ৷ বাধা বলতে? একজন উচ্চবর্ণের, একজন দলিত ৷ শুধু এই কারণেই বিয়ের আটমাসের মধ্যেই শ্বশুর টি মারুতি রাওয়ের পাঠানো ভাড়াটে খুনি কুপিয়ে খুন করে প্রণয়কে ৷ অম্রুতা তখম তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা ৷ স্বামীর সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে গেছিলেন ৷ সেখানেই কুপিয়ে খুন করা হয় প্রণয়কে৷ এই মামলায় মূল অভিযুক্ত আসগর আলি সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেলেও নজর রাখা হয়েছে তার উপরে ৷ অভিজাত ও ধনী মারুতি রাও জামিনে মুক্ত ৷ তবে, বাবাকে শাস্তি দিতে যথাসাধ্য লড়ে যাচ্ছেন অম্রুতা ৷ প্রণয়ের সুবিচারের দাবিতে । 56 পাতার চার্জশিট তৈরি করেছে পুলিশ । সেই সঙ্গে আদালতে পেশ করা হয়েছে একটি কল রেকর্ডিং । সেই রেকর্ডিংয়ে ছিল রাওয়ের সঙ্গে এলাকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার কথোপকথন । যাতে ধরা পড়ে, ভাড়াটে খুনি ও রাওয়ের মাঝে 'মিডলম্যান' হিসেবে কাজ করেছিলেন ওই নেতা । গ্রেপ্তার হন তিনি । ফের ধরা পড়েন রাও ।
তদন্তে উঠে এসেছে, অম্রুতার বাবা টি মারুতি রাও 10 লাখ টাকা দিয়েছিলেন প্রণয়কে খুন করতে ৷ প্রথম থেকেই অম্রুতা কঠিন শাস্তির দাবি জানিয়ে এসেছেন তাঁর বাবার৷ সমাজের ভ্রূকুটি 2018 সালেও তাড়া করেছিল যুগলকে ৷ তবুও ভালোবাসার কাছে হার মেনেছিল সবকিছু ৷ হায়দরাবাদের আর্য সমাজে বিয়ে করেন প্রণয়-অম্রুতা৷ কিন্তু মারুতি রাও যে এজাতীয় কোনও পরিকল্পনা করেছেন, তা অম্রুতা ভাবতেও পারেনি ৷
ডাক্তারের চেম্বার ছেড়ে বেরোনোর পর প্রণয়ের উপর বিশাল ধারালো ভোজালি নিয়ে আচমকাই হামলা চালায় এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি ৷ এলোপাথাড়ি কোপ চলে মাথায়, ঘাড়ে । ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান প্রণয় । অন্তঃসত্ত্বা অম্রুতা জ্ঞান হারানোর আগে কেবল ফোন করতে পেরেছিলেন নিজের বাবাকে । ওইটুকু সময়ে তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছিল সবই । অম্রুতা ফোনে বলেন, ''প্রণয়কে মেরে ফেললে ৷ এটা তুমি কী করলে?'' মামলাও শুরু হয় এই জায়গা থেকেই ৷ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তেলাঙ্গানার এই ঘটনায় তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, অনার কিলিং অর্থাৎ পরিবারের সম্মান রক্ষার কারণে খুন করা হয়েছে প্রণয়কে । অম্রুতার বাবা স্বয়ং এই খুনের ছক সাজিয়েছেন বহু দিন ধরে । অস্পৃশ্য, মধ্যবিত্ত, দলিত সম্প্রদায়ের প্রণয়ের সঙ্গে নিজের আদরের মেয়ের সম্পর্ক মোটেই মেনে নিতে পারেননি অম্রুতার বাবা । তবে তিনি যে নিজের জামাইকে খুন করানোর জন্য ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করবেন, ভাবতে পারেননি কেউই ।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, এই সময় দাঁড়িয়েও যে জাত-ধর্মের কারণে ধনী ও স্বচ্ছল পরিবার, দলিত সম্প্রদায় বা অনগ্রসর সম্প্রদায়ের কাউকে খুনের ছক কষছে, এটা লজ্জার ৷ দক্ষিণ ভারতের তুলনায় উত্তর ভারতে অনার কিলিংয়ের সংখ্যাটা আরও বেশি ৷ উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ডে এ জাতীয় ঘটনার হার সবচেয়ে বেশি, বলছে রিপোর্ট ৷ 2017 সালের একটি গবেষণা-রিপোর্ট বলছে, দেশে যত বিয়ে হয়, তার মধ্যে মাত্র 5.8 শতাংশ অন্য জাতের বিয়ের ঘটনা সামনে আসে । শুধু তাই নয়, গত চার দশক ধরে দেশে আরও নানা রকমের পরিবর্তন ঘটলেও, এই সংখ্যার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি । অত্যন্ত হতাশাজনক ভাবে বেড়ে চলেছে শুধুমাত্র ভিন জাতে বিয়ের কারণে খুনের (অনার কিলিং) ঘটনা ৷
অমৃতার এই ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত ৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রণয় খুন হওয়ার পর থেকেই ঘটনায় সুবিচার চেয়ে প্রতিবাদ শুরু হয় তেলাঙ্গানায় ৷ অম্রুতা জন্ম দিয়েছেন পুত্রসন্তানের ৷ তাঁর কথায়, “মেয়ের মতোই স্নেহ করেন শ্বশুরমশাই । নাতি তাঁর চোখের মণি ।” অবশ্য এখন নয়, বিয়ের আগে থেকেই যখন প্রণয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় অম্রুতার, তখন থেকেই প্রণয়ের পরিবারের স্নেহের পাত্রী ছিলেন তিনি । প্রণয়ের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের দূরত্বেই অম্রুতার বাড়ি । কয়েক একর জায়গা নিয়ে বিলাসবহুল প্রাসাদ তাঁদের ৷ সেখানে প্রণয়ের সাধারণ বাড়ি ৷ তবে অম্রুতার বাবার কাছে অসমবর্ণ বিবাহ ছিল ঘৃণার কারণ ৷ অম্রুতার অভিযোগ, তিনি সন্তানসম্ভবা জানতে পেরে ভ্রূণ হত্যার পরামর্শও দিয়েছিলেন মারুতি । রাস্তাঘাটে সাবধানে থাকতেন তাঁরা ৷ প্রণয় ও অম্রুতা খানিকটা ভয়ও পেয়েছিলেন ৷ কিন্তু তাঁর বাবা যে প্রণয়কে খুন করবেন, তা অম্রুতা ভাবতে পারেননি, পুলিশের কাছে বাবার কঠিনতম শাস্তি চেয়ে একথা জানিয়েছেন তিনি ৷
অম্রুতা জানান, তিনি যখন খুব ছোটো ছিলেন, স্কুলে যেতেন, তখন থেকেই তাঁর বাবা-মা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তিনি আর্য বৈশ্য পরিবারের মেয়ে । যে কোনও জাতের ছেলেমেয়ের সঙ্গে যেন না মেশেন । বিশেষ করে দলিতদের নিয়ে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করত অম্রুতার পরিবার । স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্কুলের দামাল অ্যাথলিট প্রণয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন অম্রুতা । বন্ধুত্ব গড়ায় প্রেমে । একথা জানতে পেরে মেয়েকে বেধড়ক মারেন মারুতি রাও । কেড়ে নেওয়া হয় ফোন, ল্যাপটপ । এক রকম গৃহবন্দি করে রাখেন অম্রুতাকে। কিছু দিন পরে ভরতি করিয়ে দেন অন্য স্কুলে । এর পরে কেটে যায় আরও ছ’বছর । স্কুল পেরিয়ে কলেজে পড়তে শুরু করেন অম্রুতা । কিন্তু ভালোবাসা তাতে একটুও কমেনি । বরং আরও প্রত্যয়ী হয়েছিলেন তাঁরা।
আদালতে অম্রুতা বলেন, “আমি একটু বড় হতেই আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে বাবা । বিয়ে নিয়ে আমার ইচ্ছের কোনও মূল্য ছিল না । বাবা এ-ও বলেছিল, ''উঁচু জাতের কোনও ভিখারির সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব তা-ও ভালো, তবু নিচু জাতে বিয়ে দেব না । সে যত ভালো ছেলেই হোক ।''
ফ্যাশন ডিজ়াইনিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন অম্রুতা । প্রণয়ও তত দিনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছেন অন্য কলেজে । 2018 সালের 30 জানুয়ারি, বাড়ির সকলের অগোচরে, ছোটো ব্যাগে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে পালান অম্রুতা । ঠিক করেছিলেন, বিয়ে সেরে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যাবেন । সেখানে ব্যবসা শুরু করবেন দু’জনে মিলে । সেই মতো খুব কাছের কয়েক জন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে হায়দরাবাদের আর্য সমাজে আইনি মতে বিয়ে করে নেন । আবেদনও করে দেন পাসপোর্ট-ভিসার । অম্রুতা তাঁর বাড়িতে জানিয়েও দেন সব কিছু । প্রণয়ের বাড়ি থেকে কোনও আপত্তি ছিল না অবশ্য । অম্রুতা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় স্থির হয়, এখনই বিদেশে যাবেন না । সামাজিক ভাবে ফের 17 অগাস্ট বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় তাঁদের । অম্রুতার বাবা-মা অবশ্য আসেননি সেই বিয়েতে । তারপর সেপ্টেম্বরেই খুন হন প্রণয় ৷ অম্রুতার নেতৃত্বে শুরু হয় ‘জাস্টিস ফর প্রণয়’ নামে প্রতিবাদ-আন্দোলন । এলাকায় একটি ছোটো মূর্তিও নির্মিত হয় প্রণয়ের । দলিত সম্প্রদায়ের তরফেও শুরু হয় আন্দোলন ৷
যদিও আর্য বৈশ্য সমাজের একটা বড় অংশ মারুতি রাওয়ের গ্রেপ্তারির বিরোধিতা করে মিছিল বের করে । আর্য বৈশ্য সমাজের সভাপতি ভূপতি রাজুর দাবি, “এত ছোটো বয়সের প্রেম কোনও ভাবেই সঙ্গত ছিল না । সে কারণেই খুন হতে হয়েছে প্রণয়কে । নিজের সন্তানের ভালোর জন্য বাবা-মা অনেক কিছুই করেন ।” এমন কী, 'পেরেন্টস প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন' তৈরি করা হয় মারুতি রাওয়ের সমর্থনে । মারুতি রাওয়ের পক্ষের উকিল, শ্যামসুন্দর চিলুকুরির বক্তব্য ছিল, ''নিম্নবর্ণের যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তাঁকে বিয়ে করেছেন অম্রুতা । এ ধরনের ঘটনাকে প্রশ্রয় দিলে সমাজের অন্য সব উচ্চ বর্ণের পরিবারের মেয়েরাও বিপথে যেতে পারে । প্রেমের অজুহাতে 'অন্যায়' ঘটে চলবে ।''
তবুও হাল ছাড়েনি প্রণয়ের পরিবার ৷ হাল ছাড়েননি অম্রুতা ৷ লড়ছেন সন্তানের জন্য ৷ নিজের ভালোবাসার জন্য ৷ তিনি চান, ছোট্ট নেহান বাবাকে দেখতে পায়নি ৷ বাবার খুনিদের যেন জেলের বাইরে দেখতে না হয় তাকে ৷