দূষণ । এই মুহূর্তে বিশ্বে অন্যতম একটি বড় সমস্যা । আর সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে বিশ্বের মধ্যে পরিবেশ দূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ভারতে সব থেকে বেশি । যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে । 40টি দেশের 400 সংস্থা দূষণ এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায় । তাতে দেখা গিয়েছে, 2017 সালে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার 15 শতাংশ পরিবেশ দূষণের কারণে । বিস্ময়করভাবে দেখা গিয়েছে, তালিকার সব থেকে উপরে রয়েছে ভারত এবং চিন । এই দুই দেশেই পরিবেশ দূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা সব থেকে বেশি ।
2017 সালে গোটা বিশ্বে হঠাত্ করে মৃত্যু হয়েছিল 83 লাখ মানুষের । এর মধ্যে 23 লাখ ভারতের । ভারতের বিভিন্ন শহরের মৃত্যুর সংখ্যাও মারাত্মক । ভারতের পরই রয়েছে চিনের স্থান । সেখানে মৃতের সংখ্যা 18 লাখ । সেখানে অন্যান্য দেশের দিকে একবার চোখ বোলানো যাক । নাইজেরিয়ায় 2.79 লাখ, ইন্দোনেশিয়ায় 2.32 লাখ, পাকিস্তানে 2.23 লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশ দূষণের কারণে মৃতের সংখ্যা 2 লাখ । GAHP-র রিপোর্টে মোট দশটি দেশের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে । উপরের ছয়টি দেশ ছাড়া আরও চারটি দেশ হলবাংলাদেশ, রাশিয়া, ইথিওপিয়া, এবং ব্রাজিল । বিশ্বে পরিবেশ দূষণের কারণে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার দুই-তৃতীয়াংশ হয় এই দশ দেশে । পরিবেশ দূষণের মধ্যে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং কলকারখানার নির্গত গ্যাসের কু-প্রভাব সব থেকে বেশি । মোট মৃত্যুর 34 লাখ (40 শতাংশ)-এর মৃত্যুর কারণ এটাই ।
হঠাৎ মৃত্যু কোন কোন দেশে সব থেকে বেশি হচ্ছে (সামগ্রিকভাবে), সেটা হিসেব করা যায়, দেখা যাবে এই তালিকায় সব থেকে উপরে রয়েছে চিন, শতকরা 12.42 লাখ । এর পরই ভারতের স্থান, শতকরা 12.40 লাখ ।তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হবে, দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে চিন সদর্থক পদক্ষেপ করেছে । কলকারখানা এবং যে সব প্রতিষ্ঠান দূষণের জন্য দায়ী তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করেছে, এর ফলে দূষণজনিত মৃত্যু চিনে গত দশ বছরে অনেকটাই কমে গিয়েছে । তবে এই সময়কালের মধ্যে ভারতে দূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা 23 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে । এর মূল কারণ, দূষণ রোধ এবং এ সংক্রান্ত পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা । গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি আটটির মধ্যে একটি করে মৃত্যু হয় পরিবেশ দূষণের কারণে । আর দূষণের জেরে একজন মানুষের আয়ুকাল 1.7 বছর করে কমে যাচ্ছে । গত বছর ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR) তাদের রিপোর্ট তুলে ধরেছে । যদিও কেন্দ্র এই রিপোর্টের বিষয়ে সহমত নয় । কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রী প্রকাশ জাওড়েকর দাবি করেছেন, এই তথ্য সঠিক নয় । পাশাপাশি তিনি আয়ুকাল কমে যাওয়ার বিষয়ে নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন । সম্ভবত, মন্ত্রী বছর দুয়েক আগে CSE রিপোর্ট সম্পর্কেও অবগত নন । সেই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, 30 শতাংশ মৃত্যুর কারণ পরিবেশ দূষণ । সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক স্তরে গবেষণাও এই দিকেই আঙুল তুলেছে । তাতে দাবি করা হয়েছে, এক লাখের বেশি পরিবারে বায়ু দূষণের কারণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলেছে ।
এখন প্রশ্ন এই হারে বায়ু দূষণের কারণ কী, এ প্রসঙ্গে GAHP কয়েকটি দিকের কথা উল্লেখ করেছে । তাতে বলা হয়েছে, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন এবং অপরিকল্পিত কলকারখানার কারণে দূষণের মাত্রা বেড়ে চলেছে । একই সঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে, বায়ুদূষণের প্রভাব পড়ছে জলের ক্ষেত্রেও । বলা হয়েছে, দূষিত জল খাদ্য শস্যের মধ্য দিয়ে মানব শরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলছে । এ-ভাবেই দূষণ থাবা বসাচ্ছে আমাদের রান্না ঘরে । এতদিনে কিছুটা হলেও সম্বিত ফিরেছে কেন্দ্রীয় সরকারের । দূষণ রোধে তারা সক্রিয় হতে শুরু করেছে । বেশ কিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে । যাতে দূষণ কোনওভাবেই মানব শরীরে আঘাত আনতে না পারে সে-জন্য আগাম সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে । মানব-সৃষ্ট এমন বিপর্যয়ের কথা 25 বছর আগেই সতর্কতা করেছিল ASEAN উন্নয়নশীল ব্যাঙ্ক । সে সময় তারা সতর্ক করে জানিয়েছিল,এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্রুত পদক্ষেপ করা না হলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে । এই বিপর্যয়েরকারণেই ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল, বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান একযোগে একটি রূপরেখা তৈরি করেছিল । কিন্তু, দুর্ভাগ্য এর কোনওটাই তেমনভাবে মানা হয়নি । ভারতের এই মনোভাবের আজ ফল ভুগতে হচ্ছে । এ বিষয়ে অন্য কাউক বলতে হবে না যে, বায়ু-স্থল-জল দূষণের কারণ কী । বিষয়টি নিয়ে আর কোনও তথ্যই তুলে ধরার দরকার নেই । সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত রিপোর্টেই এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, তাতে বিশেষভাবে জল দূষণের কথা বলা হয়েছে । সতর্কতা করা হয়েছে, পাণীয় জলের বিশুদ্ধতা নিয়েও ।
দূষণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা জল এবং বায়ু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এই দুই ক্ষেত্রে দূষণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে । কিন্তু, ভারতের প্রতিবেশী চিন এই দুই ক্ষেত্রেই দূষণে রোধে সদর্থক পদক্ষেপ করতে সক্ষম হয়েছে । ভারতের দূষণ নিয়ন্ত্রক পর্ষদ যে সব সংস্থা প্রয়োজনীয় নিয়ম মানছে না, তাদের প্রতি একটা নির্দেশিকা জারি করেছে । তবে, কী ভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব সেটা ভগবানই জানেন । দূষণ সমস্যা মোকাবিলায় চিন পাঁচ বছরের বিশেষ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে । আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ডের মতো দেশ পরিবেশসচেতনতা বাড়াতে প্রতিটি দেশবাসীকে বিশেষভাবে সংযুক্ত করছে । তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখারা চেষ্টা করে । ভারতের দূষণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শুধু সরকারে ভূমিকার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে চলবে না । প্রতিটি অফিস, রাস্তা, জলে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । শুধু আইন করে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, দূষণ রোধ করতে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটিকে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে । আর তাতেই একমাত্র সাফল্য সম্ভব ।