আজকের দিনে প্রতিটি রান্না ঘরে বিস্ফোরণ হচ্ছে, 'পিঁয়াজ বোমায়' । দেড় মাস অতিক্রান্ত । তার পরেও কমছে না পিঁয়াজের দাম । দেওয়ালির সময় থেকেই এই সমস্যার সূত্রপাত । পিঁয়াজের দাম কেজি প্রতি 100 টাকা ছাড়িয়ে গেছে । তারপরেও যেভাবে দাম বাড়ছে , তাতে ভাবাচ্ছে গোটা দেশকে ।
পাইকারি বাজারেও পিঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে । আগের সব দামের রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে । মহারাষ্ট্রের সোলাপুর এবং সানগানের বাজারে পিঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে 110 টাকায় । দক্ষিণ ভারতের কোয়েম্বাটুরে বড় মাপের পিঁয়াজ 100 টাকা কেজি এবং ছোটো পিঁয়াজ 130 টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে । এমনকি, জাতীয় উদ্যানপালন বোর্ডের তরফে জানানো হয়েছে, দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলিতে 80 টাকা প্রতি কেজি দরে পিঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে । হায়দরাবাদ, নাগপুর, ভোপালের মতো শহরে পিঁয়াজের দাম গ্রাহকদের পকেটে টান ধরাচ্ছে ।
পিঁয়াজ উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে চিনের পর ভারতের স্থান । কিন্তু মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশে, গুজরাত, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, বিহারে প্রচণ্ড এবং অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করেছে । অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টি শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে । যার ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফসল । এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসওয়ান বলেন, "তিন সপ্তাহের মধ্যে বিদেশ থেকে পিঁয়াজ আমদানি শুরু করা হবে । বিগত সময় অধিক বৃষ্টির কারণে ফসল নষ্টের ফলে দেশের অভ্যন্তরে পিঁয়াজের হাহাকার তৈরি হয়েছে । মন্ত্রীর আশা, বিদেশ থেকে আমদানির ফলে সেই সমস্যার সমাধান হবে ।" আমদানি এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে । ডিসেম্বর মাসের মাঝ বরাবার NAFED (সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষিজ পণ্য বণ্টন সংস্থা ) বিভিন্ন রাজ্যে পিঁয়াজ বণ্টন সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে । পিঁয়াজের উপর থেকে ভরতুকি হ্রাস করার দাবি জানিয়েছে রাজ্য সরকার । তবে, এর ফলে সাধারণ মানুষ কতটা সুবিধা পাবেন, পিঁয়াজের দাম কতটা কমবে সে বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে এখনও স্পষ্ট নয় ।
একটু অন্য ভাবে বললে, ক্রেতার চোখ দিয়ে সারাক্ষণ জল গড়াচ্ছে, এর কৃতিত্ব দিতেই হবে আমাদের বাজারে পিঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে । বছর দুয়েক আগের কথা, যখন পিঁয়াজের দাম 60 টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তখন দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কেন্দ্র তার অক্ষমতার কথা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল । সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় পিঁয়াজ সরবরাহ করা হবে বলে প্রতিটি রাজ্য সরকারকে কেন্দ্রের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল । যাই হোক, প্রতিশ্রুতি মতো সরবরাহ না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়নি । দুই মাসের মধ্যে পিঁয়াজের দাম এতটাই অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়, পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে । তখন বাধ্য হয়ে রপ্তানির উপর থেকে ভরতুকি তুলে নেয় সরকার । খুচরো এবং পাইকারি বিক্রেতাদের পিঁয়াজ মজুত করার ক্ষেত্রে সীমা বেঁধে দেওয়া হয় । খুচরো বিক্রেতারা 100 কুইন্টাল এবং পাইকারি বিক্রেতারা 500 কুইন্টাল পিঁয়াজ মজুত করতে পারবেন বলে নির্দেশ জারি করা হয় । মিশর থেকে জরুরি ভিত্তিতে পিঁয়াজ আমদানি করার উদ্যোগ নেয় । বেশ কিছু রাজ্য সরকার নিজেরা ভরতুকি দিয়ে পিঁয়াজ বিক্রির উদ্যোগ নেয় । কিন্তু, সেই ভরতুকি ক্রেতাদের মুখে খুব একটা হাসি ফোটাতে পারেনি । এই ধরনের পদক্ষেপ কেবল মাত্র ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা মাত্র । ক্রেতারা ভেবে উঠতে পারছেন না কবে দাম কমবে, অন্যদিকে, কৃষকরা চিন্তিত ফসল ফলাবেন কী করে, কম দামে বিক্রি করবেন কী করে, তা নিয়ে ।
গুজরাত, হিমাচল, হরিয়ানা এবং পঞ্জাবে চিনাবাদম, টমেটো এবং আলুর দাম আকাশ ছোঁয়া, এবার সেই তালিকায় যুক্ত হল আর একটি নাম । প্রতি বছরই ফল উত্পাদনের সময় কৃষকরা নানাবিধ সমস্যার সামনে পড়েন, কিন্তু সমস্যাটি যখন মারাত্মক আকার নেয়, তখনই সরকার একমাত্র পদক্ষেপ করার কথা ভাবনা-চিন্তা শুরু করে । ভারতে 14 বিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমি আছে । কিন্তু, কেন চিন তাদের প্রয়োজনীয় ফসলের 95 শতাংশ নিজেরা উত্পাদন করে আর ভারতকে পিঁয়াজের মতো আনাজ আমদানির উপর নির্ভর করতে হয় ?
যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারে । পঞ্চায়েত থেকে প্রয়োজনীয় এবং সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, কারণ, কোন গ্রামীণ এলাকায় ঠিক কত পরিমাণ ফসল উৎপাদিত হচ্ছে তার একটা সঠিক মাপ সর্বদা পঞ্চায়েতের কাছে থাকে । কৃষিক্ষেত্রে সহায়তার জন্য, কৃষকদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে । সরকারি দপ্তর, কৃষি গবেষণা বিভাগকে বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতে হবে । পরিবেশের সঙ্গে সমতা রেখে, তার ভারসাম্য বজায় রেখে কী ভাবে কৃষিকাজ করা সম্ভব, সে দিকে নজর দিতে হবে । কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে । কীভাবে জমি থেকে সর্বাধিক লাভ করা সম্ভব, সে দিকটা দেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে ।
সরকার যদি নির্ধারিত মূল্যে কৃষকদের কাছ থেক পুরো উৎপাদিত ফসল কিনে নেয়, তাহলে উৎপাদন থেকে বিক্রি কোনও স্তরেই মধ্যস্বত্বভোগীর অস্তিত্ব থাকবে না, ফলে লাভবান হবেন কৃষকরা । অগ্রিম দিয়ে কৃষকদের আশ্বস্ত যেসব শস্যের ফলন অত্যন্ত বেশি, সেগুলি বিদেশে রপ্তানির বিষয়টি দেখতে হবে । একই সঙ্গে রপ্তানির আগে পুরো বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ণ অত্যন্ত জরুরি । আসলে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে কৃষি দপ্তর বা মন্ত্রককে এগিয়ে আসতে হবে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদিভিত্তিতে কৃষকদের কথা মাথায় রেখে সরকারকে সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে । প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করতে হবে । শুধু তাই নয়, উৎপাদন এবং বিক্রয়ের মধ্যে যে ফাঁক তৈরি হচ্ছে, তা পূরণ করতে হবে সরকারকে । জেলাস্তরে ফসল মজুতের ব্যবস্থা, পরিবহন, বণ্টন-সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে নজরদারি চালাতে হবে । সুষ্ঠু ব্যবস্থা-নীতি-রীতি তৈরি করতে হবে । দেশের স্বার্থে, কৃষকের স্বার্থে কৃষি বিকাশ কেন্দ্র, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর-মন্ত্রক-বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে । আধুনিক প্রযু্ক্তির সঙ্গে নিজেদের মাননসই করে গড়ে তুলতে হবে । এই রকম একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রচলন করতে পারলে, আশা করা যায় আমরা পিঁয়াজের ঝাঁজ থেকে ক্রেতাদের চোখের জল পড়া মুছতে পারব ।