ছোট যোদ্ধা, যাঁরা এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে একটি বিভাগ তৈরি করেছেন, তাঁদের পূর্বসূরীরা পৃথ্বী নারাইনের নেতৃত্বে 1765 সালে নেপালিদের প্রথম ইউরোপের শৃঙ্খলা ও ব্যবহার রপ্ত করার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন ৷ তাঁরা পার্বত্য উপজাতিদের পরিমণ্ডলে নিজেদের শক্তিশালী হিসেবেও অনুভব করতে শুরু করেন ৷
নেপালের কাঠমান্ডু, ললিতাপাটন ও ভাটগাঁওকে পরাস্ত করে ৷ আর পৃথ্বী নারাইনের মৃত্যুর পর তাঁর সদ্যোজাত পুত্রকে শাসক হিসেবে সামনে রেখে তাঁর বিধবা স্ত্রী ও ভাই কুমাওন পর্যন্ত তাঁদের সাম্রাজ্য প্রসারিত করেন ৷ 1790 সালে তাঁরা আলমোরা দখল করে নেন ৷ আর রামগঙ্গা পর্যন্ত দেশের সমস্ত অংশের মালিক হয়ে যান ৷
কুমাওন থেকে তারা আরও পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয় ৷ আক্রমণের জন্য গোর্খারা গারওয়ালের দিকে চলে যায় ৷ কিন্তু নেপালে চিনা আক্রমণের খবর পেয়ে সেই আক্রমণে ছেদ পড়ে ৷ তারা গারওয়াল থেকে সরে আসে নিজেদের দেশকে রক্ষা করার কাজে সাহায্য করার জন্য ৷ কয়েক বছর পরে যদিও গোর্খারা আবার পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয় ৷ শ্রীনগর সেই সময় রাজা গারওয়ালের রাজধানী ছিল ৷ 1803 সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা আক্রান্ত হয় ৷ রাজা দক্ষিণের দিকে চলে যান ৷ তিনি বারাহাতে নিরর্থক অবস্থান নেন ৷ কিন্তু সেখান থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় ৷ প্রথমে তিনি আসেন দুনে ৷ তারপর সেখান থেকে সাহারণপুরে ৷ এখানে রাজা প্রদ্যুম্ন শাহ নিজের সমস্ত সম্পত্তি ও সিংহাসন বন্ধক রেখে দুই লাখ টাকা জোগাড় করেন ৷ ওই টাকায় তিনি নতুন সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন ৷ আর দুনে ফিরে যান ৷ সেই সময় উমর সিং থাপার নেতৃত্বে দেহরা দখল করে রেখেছিল আক্রমণকারীরা ৷ তিনি তাদের উপর আক্রমণ করেন ৷ কিন্তু হেরে যান এবং নিহত হন ৷
যমুনেত্রীর অদূরে একটি পবিত্র উপত্যকা পালিগড়ের পুরোহিতরা ব্রিটিশ পরাধীনতার ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন ৷ গারওয়ালের শেষ রাজা প্রদ্যুম্ন শাহের দুর্ভাগ্য এবং গোর্খা শক্তির উত্থানের ভিত্তিতেই তাঁরা এই ভবিষ্যৎ বাণী করেন ৷ ‘হিমালয়ান মাউন্টেন্স’-এ এর উল্লেখ করেছেন জে বি ফ্রেজ়ার ৷
ব্রিটিশ বাহিনী শিবালিক রেঞ্জের দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছেছিল ৷ অন্যদিকে এই পাদদেশের উত্তর অংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল গোর্খারা ৷ কর্নেল বার্ন যখন সাহারানপুর দখল করেন, সেই একই সময় 1803 সালের অক্টোবরে উমর সিং থাপা দেহরা দখল করেছিলেন ৷
গোর্খা শাসন ছিল ভয়ানক ৷ বহু স্থানীয় বাসিন্দাকে প্রবাসীতে পরিণত করে দিয়েছিল ৷ দাসত্ব দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছিল ৷ যে কোনও ধরনের খেলাপিদের যাবজ্জীবন দাসে পরিণত করা হয়েছিল ৷ বলা হয় যে অবিচার ও নৃশংসতা এই শাসনের সময় একেবারে চরমে পৌঁছে গিয়েছিল ৷ রাজস্ব আদায়ে খেলাপিদের পরিবারকে প্রায়ই বিক্রি করে দেওয়া হত ৷
গারওয়ালে গোর্খাদের আরেক নাম হয়ে যায় ‘গুর্খানি’ ৷ তাদের সম্পর্কে বলা হত যে রাতে এসে তারা সমস্ত দুধ খেয়ে যেত, তার পর সৈনিকরা সকালে এসে দইয়ের দাবি করত ৷
যদিও গোর্খা যুদ্ধের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল বিতর্কিত এলাকায় একটি থানা ধ্বংস করে দেওয়া ৷ যা শুরু হয়েছে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত দারোগার খুন দিয়ে ৷ যে ঘটনার প্রতিরোধ করতে গিয়ে আঠারো জন কনস্টেবল নিহত হন এবং ছয় জন আহত হন ৷ এর পর খুব তাড়াতাড়ি আরও একটি থানায় হামলা হয় ৷ সেই আবহাওয়া শাস্তিমূলক অভিযান করার জন্য অনুকূল ছিল না ৷ তাই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে নেপালের রাজার কাছে চিঠি পাঠানো হয় ৷ কিন্তু যে প্রতিক্রিয়া এসেছিল, তা ছিল অপমানজনক ৷ 1814 সালের 1 নভেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা করা হয় ৷ অভিযানের তথ্য পাওয়া যাবে "উইলিমাস মেমোয়ের অফ দ্য দুন"-এ ৷ গোর্খারা শত্রুদের নিরীহ প্রমাণ করল ৷ কলিঙ্গ নামে পরিচিত নালাপানি পাহাড়ের উপর কয়েকজন যুদ্ধ করার লোক নিয়ে একটি দুর্গ তৈরি করে ফেলল ৷ ইতিহাসে তাদের জেদি ও বীর হিসেবেই দেখানো হয়েছে ৷
দুন উপত্যকায় দু’টো ছোট স্তম্ভ একেবারে রিসপানার পাড়ে অবস্থিত ৷ যা বিজয়ী ও পরাজিতর অনন্য স্মৃতি বহন করছে ৷ একটা জেনারেল গিলেসপি ও তাঁর সঙ্গীদের মৃত্যুর স্মৃতি বহন করছে ৷ আর অন্যটাই সম্মান জানানো হয়েছে সাহসী বলভদ্দর সিং ও তাঁর সাহসী গোর্খাদের ৷ তবে 1815 সালের 17 নভেম্বর সাহারণপুর জেলা দখল করে নেওয়া হয় ৷
1815 সালে ব্রিটিশ জেনারেল ওচটেরলোনি কালী নদী সংলগ্ন গারওয়াল ও কুমাওন থেকে নেপালিদের তাড়িয়ে দেন ৷ এর ফলে বারো বছরের দখলদারির পরিসমাপ্তি ঘটে ৷ উত্তরাখণ্ডের এই সময়কাল ভয়ঙ্কর নৃশংসতা ও দমনের সাক্ষী হয়ে থাকবে ৷ পূর্বদিকে সিকিমের তিস্তা থেকে পশ্চিমে সুতলেজ নদী পর্যন্ত নেপালিদের দখলে ছিল ৷
সাধারণ নিষ্পত্তির জন্য সমঝোতা সাক্ষর হয়েছিল 1815 সালের ডিসেম্বরে ৷ বিহারের চম্পারণের সাগাউলিতে তা সাক্ষরিত হয় ৷ যা কার্যকর হয়েছিল পরের বছর 1816 সালে ৷ এর ফলে নেপাল পূর্ব ও পশ্চিমে তাদের দখলে রাখা সমস্ত জমির উপর অধিকার ছেড়ে দেয় ৷ এর সঙ্গে পুরো তরাই অঞ্চলই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হয় ৷ এটাকে নেপালের সীমান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ৷ এই চুক্তি 1815 সালের 2 ডিসেম্বর সাক্ষরিত হয় ৷ রাজ গুরু গজরাজ মিশ্রর সঙ্গে নেপালের চন্দ্রশেখর উপাধ্যায় ও ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মধ্যে 1816 সালের 4 মার্চ অনুমোদিত হয় ৷ সেই চুক্তি মোতাবেক নেপালিরা ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং নেপালের পশ্চিম অংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিয়ে নেয় ৷
সিকিম, তরাই, কুমাওন এবং গারওয়াল ব্রিটিশদের দখলে চলে যায় এবং নেপালিরা তাদের নিজের সীমানার মধ্যে ফিরে যায় ৷ উত্তরাখণ্ডের পিত্তরাগড় জেলায় সারদা নদীকে (অথবা যে নদীকে নেপালিরা মহাকালী বলে ডাকে) দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ অবশ্যই পূর্ব দিকে পুরনো সীমান্তটি মেচি নদীতে পরিণত হবে, যা নীচে নেমে বিহারের কিষানগঞ্জে সমভূমিতে প্রবেশ করেছিল ।
লিপুলেখ পাস দিয়ে মানস সরোবরে তীর্থযাত্রীদের যাওয়ার ব্যবস্থাকে আরও সুগম করার জন্য বর্ডার রোড অর্গানাইজ়েশন যে রাস্তা তৈরি করেছে, তা নিয়েই বর্তমান বিতর্ক তৈরি হয়েছে ৷ মহাকালী নদীর তিনটি শাখা নদী রয়েছে : উত্তরাখণ্ডের পিত্তোরাগড় জেলার লিম্পিয়াধুরা, কালাপানি এবং লিপুলেখ ।
পশ্চিমে লিম্পিয়াধুরা হল সীমান্ত ৷ নেপালিরা এমনই দাবি করছেন ৷ আমাদের বিশ্বাস এটা লিপুলেখ ৷ হিমালয়ের মধ্যে অবস্থিত এই দেশের একটা অংশ চিন দখল করে নেয় ৷ আর চিনের দ্বারা কোণঠাসা নেপালের বামপন্থী সরকারও এই বিরোধকে বাড়িয়ে তোলে ৷
যখন হাতিদের মধ্যে যুদ্ধ হয়, তখন পৃথিবী কেঁপে ওঠে এবং ঘাস বিনষ্ট হয় ৷ এই প্রবাদের সত্যতা আবার ফিরে এসেছে যখন সাম্প্রতিক মতবিরোধের খবর ছড়িয়ে পড়ে ৷ সেই সময় আমাদের হিল স্টেশনে কর্মরত প্রত্যেক নেপালি নিখোঁজ হয়ে যায় ৷ তারা বাড়ি ফিরে গিয়েছে ।
লেখক : লিখেছেন গণেশ সাইলি ৷ গণেশ সাইলি পাহাড়েই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই বড় হয়েছেন ৷ তিনি সেই সমস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পড়েন যাঁরা নিজেদের বক্তব্য ছবির মতো ব্যাখ্যা করতে পারেন ৷ দুই ডজন বইয়ের লেখক ৷ কিছু কুড়িটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ৷ তাঁর কাজ সারা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে ৷