দিল্লি, 16 জুলাই : পূর্ব লাদাখের কাছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর স্থিতিশীল অবস্থা পরিবর্তনের যে কোন একতরফা প্রচেষ্টা মেনে নেওয়া হবে না ৷ আজ সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিল বিদেশমন্ত্রক ৷ পাশাপাশি বিদেশমন্ত্রকের তরফে জানানো হয়, "প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারতের অবস্থানের কোনও পরিবর্তন হয়নি ৷ আমরা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখাকে সম্মান জানাতে ও পর্যবেক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ ৷ ভারত ও চিনের মিলিটারি কমান্ডাররা এর আগে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছেন ৷"
আজ পূর্ব লাদাখের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চতুর্থ দফায় বৈঠক করে ভারত-চিনা সেনা ৷ এই মিলিটারি বৈঠকের পর সেনার তরফে বলা হয়, ভারত ও চিন পূর্ব লাদাখ থেকে সম্পূর্ণভাবে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে দায়বদ্ধ ৷ কিন্তু, এই প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ায় তা যাচাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছে ভারতীয় সেনা ৷
সেনার তরফে বলা হয়, ভারতীয় ও চিনা সেনার সিনিয়র কমান্ডাররা সেনা প্রত্যাহারের প্রথম দফার বাস্তবায়নের বিষয়ে এবং সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপগুলি নিয়েও আলোচনা করেছেন ৷ দুই দেশের কর্পস কমান্ডাররা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার ভারত সীমান্তের ভিতর চুশুলে গতকাল টানা 15 ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেন ৷ মঙ্গলবার সকাল 11টা থেকে বুধবার রাত দু'টো পর্যন্ত এই আলোচনা চলেছিল ৷ এই বৈঠকে সেনা প্রত্যাহার প্রক্রিয়ার জটিলতা নিয়ে এবং হাজার হাজার সেনাবাহিনী সরানোর বিষয়েও আলোচনা করা হয় ৷
সেনা মুখপাত্র কর্নেল আমন আনন্দ একটি বিবৃতিতে জানান, "সেনা প্রত্যাহারের প্রথম দফার বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে সিনিয়র কমান্ডাররা পর্যালোচনা করেছেন ৷ পাশাপাশি সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের বিষয়েও পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছেন ৷ সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে উভয়পক্ষই দায়বদ্ধ ৷ এই প্রক্রিয়া জটিল ৷ তাই এটি যাচাইয়ের প্রয়োজন ৷ মিলিটারি পর্যায়ে নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টিকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ৷"
প্রসঙ্গত, অঞ্চলভিত্তিক অধিকারকে কেন্দ্র করে একাধিক বিতর্কিত বিষয়ের জেরে দুই দেশের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল ৷ চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এলাকায় তৈরি হওয়া সমস্যা সেই দ্বন্দ্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল ৷ দুই দেশই আস্তে আস্তে ওই এলাকায় সেনা মোতায়েন বাড়াতে থাকে ৷ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর বেশ কয়েকটি জায়গায় 1,200-1,500 চিনা সেনা মোতায়েন করা হয় ৷ কিন্তু, সরকারিভাবে কোনও দেশই উত্তেজক কোনও বিবৃতি দেয়নি বলেই মনে করেছিল সংশ্লিষ্ট মহল ৷ অন্যদিকে, জুনের শুরুতে কোরোনা ও লকডাউনের জেরে বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাদ দিয়ে শুধু ভারত থেকে কয়েক হাজার চিনা নাগরিককে দেশে ফেরানোর বিষয়ে মত প্রকাশ করেছিল বেজিং ৷ এর ফলে দুই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের (জনসংখ্যার বিচারে) দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বিবাদ ও অনৈক্যের ছবিটা প্রাথমিক পর্যালোচনাতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ৷
এরপর 15 জুন রাতে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয় পূর্ব লাদাখের ভারত-চিন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ৷ দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষে শহিদ হন তিনজন ৷ গুরুতর জখম হয়েছিলেন 17জন ৷ ভারতীয় সেনার তরফে জানানো হয়েছিল, অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে ওই জখম 17জনের মৃত্যু হয় ৷ অন্যদিকে, এই সংঘর্ষে চিনের 43জন সেনা হতাহত হয়েছে বলে জানিয়েছিল ভারতীয় সেনা ৷ সেনার তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছিল, গালওয়ান ভ্যালিতে সেনা প্রত্যাহারের সময় সংঘর্ষ বাধে ৷ সংঘর্ষে ভারতের একজন আধিকারিক ও দুই জওয়ান শহিদ হন ৷ ঘটনার একদিন পর জানা যায়, এই সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে চিনের এক কমান্ডিং অফিসারের ৷ কিন্তু, বিষয়টি নিয়ে চিনের তরফে কোনও বিবৃতি দেওয়া হয়নি ৷
ঠিক কী ঘটেছিল 15 জুন ? একজন সেনা আধিকারিক বলেন, "আসলে এটা 15 জুন নয় ৷ তার কয়েকদিন আগেই চিনা সেনা অক্ষয় চিন এলাকায় প্রবেশ করেছিল ৷ পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতো এই সীমান্তের কোনও চিহ্ন নেই ৷ ওই উচ্চতায় বরফের মধ্যে দুই দেশই নিজেদের ধারণা মতো সীমান্ত নির্ধারণ করে ৷ সারা বছর ধরে সেনারা একদিক থেকে আর একদিকে যায় ৷ আবার ফিরে আসে ৷ কিন্তু, কয়েকদিন ধরে ভারতীয় সেনা লক্ষ্য করছিল যে, প্যাট্রল পয়েন্ট 14-তে যেখানে কোনও সেনা মোতায়েন থাকে না সেখানে সেনা রয়েছে ৷ এর 10 দিন আগে উচ্চ পর্যায়ে বৈঠক হয় গালওয়ানে ৷ সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ওরা প্যাট্রল পয়েন্ট 14 থেকে সমস্ত পোস্ট সরিয়ে নেবে ৷ চিনা পর্যবেক্ষণ পয়েন্টও ভারতীয় সীমান্তের ভিতরে ৷"
সংঘর্ষে শহিদ হয়েছিলেন ভারতীয় সেনার কর্নেল সন্তোষ বাবুও ৷ কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল ? ওই সেনা আধিকারিক বলেন, "15 জুন সকালেই চিনা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কর্নেল সন্তোষ বাবু ৷ বিকেল পাঁচটা নাগাদ চিনা সেনারা তাদের পোস্ট সরিয়েছে কিনা তা দেখতে সন্তোষ বাবু 16 বিহার রেজিমেন্টের আরও কয়েকজন অফিসারদের নিয়ে যান ৷ কিন্তু, কিছুটা যাওয়ার পরই তাঁরা বুঝতে পারেন একটাও পোস্ট সরানো হয়নি ৷ উলটে তারা ভারতের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় তাঁবু খাটিয়েছে ৷ কর্নেল সন্তোষ বাবু খুবই ঠান্ডা মাথার অফিসার ৷ কোনও সংঘর্ষ হতে পারে, সেই আশঙ্কায় তিনি অন্য কাউকে না পাঠিয়ে নিজেই গিয়েছিলেন ৷ সাতটা নাগাদ তিনি ভ্যালিতে পৌঁছান ৷ তবে, সেখানে তিনি আক্রমণের লক্ষ্য নিয়ে যাননি ৷ গিয়ে দেখেন, ওই তাঁবুগুলিতে চিনা সেনার কোনও পরিচিত মুখ নেই ৷ সবই নতুন ৷ তিনি তাদের কাছে জানতে চান কেন এখনও সরানো হয়নি পোস্টগুলি ৷ তারপরই ওই বাহিনী কর্নেলকে ধাক্কা মেরে চিনা সীমান্তে নিয়ে যায় ৷ তিনি জখম ছিলেন ৷ কর্নেলকে ওই অবস্থায় দেখে ভারতীয় জওয়ানরাও এগিয়ে আসেন ৷ তারপরই মুখোমুখি সংঘর্ষ শুরু হয় ৷ ততক্ষণে রাত 11টা বেজে গিয়েছে ৷ আমাদের 20জন শহিদ হয়েছেন ৷ ওদেরও কমপক্ষে 35জনের মৃত্যু হয়েছে ৷"
দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ এই প্রথম নয় ৷ তবে, 1962 সালের পর এটাই সবচেয়ে বড় সংকট ৷ 1962 সালে যুদ্ধের সময় চিনা সেনা পশ্চিম লাদাখের 38 হাজার কিলোমিটার দখল করে নেয় ৷ এটিই LAC ৷ না এটি ম্যাপে রয়েছে, আর না বাস্তবে কোনও সীমারেখা রয়েছে ৷ তাই দুই পক্ষের মধ্যেই এই নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে ৷ এছাড়া আরও অনেক অনুপ্রবেশ হলেও সেগুলি ছিল স্থানীয় ঘটনা ৷ তাই হিংসা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে মিটিয়ে নেওয়া হয়েছিল সমস্যাগুলি ৷ তবে 15 জুন সংঘর্ষের পর দুই দেশের অবস্থা একদমই আলাদা ৷ ভারতে চিনবিরোধী একাধিক মনোভাবে ক্রমশ প্রকাশ পাচ্ছে ৷ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে একাধিক চিনা অ্যাপ ৷ বিভিন্ন চুক্তিও স্থগিত করেছে ভারত সরকার ৷ তবে, দুই দেশের মধ্যে এই পরিস্থিতির সমাধান আসলে কী, তা সময়ই বলবে ৷